বেনারস ভ্রমণ গাইড (Varanasi Travel Guide in Bengali): কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবেন বেনারসে? কি কি দেখার জায়গা রয়েছে বেনারসে? কিভাবে যাবেন? কত খরচ হবে? জানুন বেনারস ভ্রমণের সম্পূর্ণ গাইড ও টিপস।
হায় বেনারসিয়া…দুকলি গান গুনগুন করতে করতে মনে পড়ে যায় না গঙ্গার ঘাট, পুরনো ঐতিহাসিক শিব মন্দিরের স্থাপত্যের সেই ছবি গুলো!বেনারসের নাম এখন খুব প্রচলিত। মূলত এখন টলিউড থেকে বলিউড বিভিন্ন সিনেমার শুটিং বেনারস স্থানটিকে কেন্দ্র করে তৈরি হচ্ছে।
হ্যাঁ একটি ঐতিহাসিক ভ্রমণ স্থান এই বেনারস।বেনারাস ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের একটি শহর। উত্তর প্রদেশের লক্ষনৌ থেকে ৩২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই শহরটি গঙ্গা নদীর ধারে গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব অনুষ্ঠানে মহিমান্বিত ও গঙ্গার সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ একটি স্থান। একবার হলেও ঘুরে আসুন বেনারস।
ভারতের তথা বিশ্বের প্রাচীন শহরগুলির মধ্যে একটি বেনারস। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের মিলনস্থল এই স্থান। বারাণসী বিশ্বের অন্যতম পবিত্র শহর হিসাবে বিবেচিত হয়।বারাণসী” নামটি সম্ভবত দুটি নদীর নাম থেকে এসেছে: বরুনা (বারাণসীতে এখনও প্রবহমান) ও অশ্বি (অশ্বি ঘাটের কাছে প্রবাহিত একটি ছোটো নদী) নদী।
গঙ্গার উত্তর কূলে অবস্থিত বারাণসী শহরের সীমানা নির্দেশ করছে গঙ্গার এই দুটি উপনদী। ঘন্টাধ্বনি, মন্দিরের শঙ্খধ্বনি, গঙ্গার ঘাটে স্নান, সন্ধ্যার আরতি সব মিলিয়ে এই স্থান ভ্রমণ প্রিয় মানুষের মন কাড়বে।
১. বেনারসর ইতিহাস:
পুরান অনুসারে, শিব এই শহর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।বলা হয় হিন্দু মহাকাব্য মহাভারত এর নায়ক পাণ্ডব ভ্রাতারা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভ্রাতৃহত্যা ও ব্রহ্মহত্যাজনিত পাপ থেকে উদ্ধার পেতে শিবের খোঁজ করতে করতে এই শহরে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন।হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে, যে সাতটি শহর মোক্ষ প্রদান করতে পারে, সেগুলির একটি হল বারাণসী।
তাই বারানসীতে মৃত্যু হলে মোক্ষ লাভ হয়। গৌতম বুদ্ধের সময় বারানসী ছিল কাশীর রাজধানী।৫২৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বারাণসীর কাছে সারনাথে গৌতম বুদ্ধ প্রথম বৌদ্ধধর্ম প্রবর্তন করেন।
এই স্থানটি বানিজ্যিক ভাবেও বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল। এখানে রেশম, মসলিনের কাপড়, সুগন্ধি দ্রব্য ও হাতির দাঁতের কাজ করা ভাস্কর্য নির্মাণ এর মাধ্যমে বানিজ্যিক সফলতা লাভ করেছিল।
২. বেনারস শহরের সৌন্দর্য ও দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন:
পবিত্র শহর বারাণসী কাশী নামেও পরিচিত। এই শহরের প্রতিটি কোণে কোণে রয়েছে অসংখ্য মন্দির। গঙ্গার ঘাটে ভগ্ন মন্দির,বড় বড় ঐতিহাসিক স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন এই শহর।মোট ৮৪ টি ঘাট রয়েছে বারাণসীর গঙ্গার ধারে।
পায়ে হেঁটে ঘুরে ঘুরে দেখলেই এই স্থানের আসল স্বাদ উপভোগ করা যায়। সঙ্গে রয়েছে বেনারসের বিখ্যাত পান,সরবত ও স্ট্রিট ফুড অবশ্যই এই জিনিসগুলোর অভিজ্ঞতা নেবেন এখানে ঘুরতে গেলে। এবার জেনে নেওয়া যাক কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবেন:
i.কাশী বিশ্বনাথ মন্দির:
মণিকর্ণিকা ঘাটের কাছে বারাণসী জংশন রেল স্টেশন থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরের পবিত্র আকর্ষণ শ্রী কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে পৌঁছতে হিন্দু তীর্থযাত্রী ও পর্যটকরা ভিড় করেন।। পাঞ্জাবের মহারাজা রঞ্জিত সিং প্রায় সাড়ে আটশো কেজি ওজনের সোনার পাতে মন্দিরের উপরের অংশ মুড়ে দিয়েছিলেন।
মন্দির খোলার সময় ভোর ৩টে। মন্দিরের আশেপাশের কঠোর সুরক্ষা ব্যবস্থার জন্য পর্যটকরা কাছাকাছি কোনও ভাড়াযোগ্য লকারে তাদের ক্যামেরা, ফোন, ব্যাগ এবং অন্যান্য জিনিসপত্র রেখে দেন। শিবের মূর্তি দেখাই এখানকার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ।
ii. দশ্বমেধ ঘাট:
দশ্বমেধ ঘাটের প্রাণবন্ত পরিবেশ এটি বারাণসীতে দেখার মত সেরা স্থানগুলির মধ্যে একটি।এই ঘাটের আকর্ষণ প্রচুর রঙের ফুল, নৌকা বাইচ,সাধু সন্ন্যাসীদের সমাবেশ।
হিন্দু পুরোহিতরা প্রতি রাতে দশ্বমধ ঘাটে গঙ্গা আরতি করেন, সন্ধ্যা ৭ টার দিকে এই আরতি শুরু হয়।কয়েক হাজার পর্যটক এখানে জড়ো হন এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে।এই আরতি আপনাকে সারাজীবনের একটি সুন্দর অভিজ্ঞতা দেবে।
iii. অশ্বি ঘাট:
বারাণসীর বিখ্যাত জায়গাগুলির ক্ষেত্রে, শহরের দক্ষিণতম প্রধান ঘাটগুলির মধ্যে তালিকার শীর্ষে রয়েছে অশ্বি ঘাট।অশ্বি ঘাটের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ একটি পবিত্র ডুমুর গাছের নীচে শিব লিঙ্গ। যেখানে পুজো দেওয়া হয়।
গঙ্গা নদীতে স্নান সেরে শত শত পর্যটক এখানে পুজো দিতে আসেন।এখানেও আপনি সন্ধ্যা আরতি উপভোগ করতে পারবেন।যদিও এই ঘাটটি দশ্বমেধ
ঘাটের তুলনায় ছোট।
iv. সারনাথ:
বারানসী থেকে মাত্র ১০ কিমি দূরে সারনাথে বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তন হয়েছিল।বোধগয়ায় ‘বোধি’ লাভের পর বুদ্ধদেব সরনাথে এসে এখানকার মৃগ উদ্যানে সবার প্রথমে ধর্মীয় উপদেশ দান করেন।আপনি এখানে ধামেক স্তূপ দেখতে পাবেন, একটি বিশাল পাথর এবং ইটের কাঠামো যা 43.6 মিটার লম্বা এবং এর ব্যাস 28 মিটার।
এছাড়াও সারনাথের প্রবেশের পথেই বাদিকে এই বিশাল স্তূপকে ছোটখাটো টিলা রয়েছে যার নাম চৌখুন্ডি স্তুপ। সম্রাট অশোক ২৩৪ খ্রি: পূর্বাব্দে এখানে এসেছিলেন। উনি এই সুবিশাল স্তূপটি নির্মাণ করান।
v. দুর্গা মন্দির:
বারাণসীর আশেপাশে আধ্যাত্মিক কর্মকাণ্ড কেবল ঘাটে সীমাবদ্ধ নয়। আসি ঘাটের পশ্চিমে মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ ধরে, দুর্গা দেবীকে শ্রদ্ধা জানাতে ইচ্ছুক হিন্দুদের জন্য শ্রী দুর্গা মন্দির একটি জনপ্রিয় আকর্ষণ।
এই মন্দিরটি ৩০০০ বছরের পুরনো এবং এই মন্দিরটি পুরো লাল রঙের। মন্দিরটির ডাকনাম হনুমান মন্দির। এবং এই এলাকায় আশেপাশে দৃশ্যমান অনেক হনুমানের সমাবেশ আপনি দেখতে পাবেন।
vi. রামনগর ফোর্ট:
শহরের কেন্দ্র থেকে প্রায় 14 কিলোমিটার দূরে, আপনি রামনগর দুর্গ থেকে ঘুরে আসতে পারবেন।অষ্টাদশ শতাব্দীর এই দুর্গটি বেলেপাথরের দুর্গ। এখানে একটি মিউজিয়াম রয়েছে যা সকাল ৯টা থেকে ১২টা এবং ২টো থেকে ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
vii. বিন্ধ্যাচল:
৫১ সতীপীঠের অন্যতম নিদর্শন এই বিন্ধ্যাচলের বিন্ধ্যাবাসিনীর মন্দির। এখানে সতীর বাম আঙুলের অংশ পড়েছিল।এই স্থানটিও বেনারসের বিশেষ উল্লেখযোগ্য একটি স্থান।
এছাড়াও আছে চুনার,সারনাথ মিউজিয়াম,মনিকর্নিকা ঘাট,তুলসী ঘাট,ভারত কলা ভবন, বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি,মূলগন্ধকুটি বিহার,অষ্টভুজা মন্দির।
বেনারস যাবেন কীভাবে:
আপনি যে কোনো শহর থেকে বেনারস যেতে পারেন। দিল্লি, লক্নৌ, এলাহাবাদ, কানপুর ও কলকাতা থেকে বেনারস যাওয়ার ট্রেন রয়েছে। কলকাতা থেকে বেনারস যাওয়ার কয়েকটি ট্রেন হল- দুন এক্সপ্রেস, বিভূতি এক্সপ্রেস, কুম্ভ স্পেশাল,পূর্বা কোভিড ১৯ স্পেশাল ইত্যাদি।
আপনি চাইলে প্লেনেও যেতে পারবেন কলকাতা বিমানবন্দর থেকে বারানসী বিমানবন্দরে যেতে হবে।বারানসী বিমানবন্দর মূল শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
বেনারস কোথায় থাকবেন:
বেনারসে প্রচুর ধর্মশালা রয়েছে।শত শত পর্যটকরা এখানে ধর্মশালায় থাকেন।তবে দামি, কম দামি বিভিন্ন রেঞ্জের হোটেল রয়েছে থাকার জন্য।
এখানে খুব বেশি আমিষ জাতীয় খাবার পাওয়া যায় না। বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে নিরামিষ আহার গ্রহণ করেন পর্যটকরা।তবে এখানকার সরবত,লস্যি,পান খুব নাম করা, ঘুরতে গেলে অবশ্যই একবার স্বাদ নিতে ভুলবেন না যেন।