দার্জিলিং এর কাছে দুটি অজানা হিল স্টেশন | Hill Stations Near Darjeeling

আমাদের বাঙালিদের একটি প্রবাদ আছে “দীপুদা” দীঘা পুরী দার্জিলিং! ঘুরতে যাওয়ার কথা ভাবলেই প্রথমেই এই তিনটি নাম আসে। তবে দার্জিলিং হিল স্টেশন তো বহু মানুষ বহু বার গিয়েছে। কলকাতা থেকে এত কাছে এত সুন্দর একটা পাহাড়ি ভ্রমণ স্থান সবার খুব প্রিয় তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

তবে দার্জিলিং এর এই পাহাড়ের আশেপাশে লুকিয়ে আছে আরও ছোট ছোট দার্জিলিং। যাদের খোঁজ আমরা খুব একটা রাখিনা। এমন কিছু কিছু হিল স্টেশন যারা তাদের নিজেদের সৌন্দর্যে ততটাই সুন্দর। আজকে আমার এই প্রতিবেদনে আমি দুটো অফবিট হিল স্টেশনের সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।

লেপচা জগৎ ও লামাহাট্টা। যারা পাহাড় চষে বেড়ায় তারা নিশ্চয়ই জানবে তবে বেশিরভাগ মানুষই এই অফবিট হিল স্টেশনের নাম শুনতে পায় না। আপনি যদি প্রকৃতি প্রেমী ও একই সঙ্গে পাহাড় প্রেমী হন তবে অবশ্যই একবার ঘুরে আসুন এই দুটি স্থান থেকে। প্রেমে পড়ে যাবেন!

আসুন আমরা জেনে নেই বাদবাকি সবকিছু…

1. লেপচাজগৎ: (Lepcha Jagat)

এটি দার্জিলিংয়ের নিকটবর্তী একটি ছোট্ট গ্রাম। দার্জিলিং থেকে এর দূরত্ব ১৯ কিমি। এই গ্রামের পথ কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। দার্জিলিং এর থেকে অনেক নির্জন একটি স্থান। পাইন এবং রোডোডেন্ড্রনে ঘেরা এই রাজ্যটি একসময় লেপচাদের রাজধানী ছিল।

Lepcha Jagat Hill Station
Lepcha Jagat Hill Station

কিন্তু তারা আস্তে আস্তে এখান থেকে সরে যাওয়ায় জায়গাটি অনেক জনশূন্য হয়ে গেছে। আপনি পাখির গান, শীতল বাতাস, পাতার স্খলন এবং আপনার নিজের শ্বাস, ভয়েস এবং হার্টবিট এর মতো প্রচুর মিষ্টি শব্দ শুনতে পাবেন প্রতি ক্ষণে ক্ষণে।

আপনি প্রকৃতিকে যদি সত্যই ভালোবাসেন তবে লেপচাজগতের প্রতিটি কোণায় আপনি এর সৌন্দর্য খুঁজে। পাইনের বনে পাখির আওয়াজ আপনাকে অন্য মায়ায় নিয়ে যাবে।

লেপচা জগৎ থেকে পাহাড়ের কোলে অসাধারণ সূর্যদয় ও সূর্যাস্ত উপভোগ করার সুযোগ পাবেন। ফরেস্ট ট্রেল ধরে যতদূর মন চায় হেঁটে বেড়ান ও ছবি তুলুন এই অপার সৌন্দর্যের। পাশেই রয়েছে বিশাল চা-বাগানও। বিরল প্রজাতির কিছু অর্কিডের ও দেখা মেলে এই গ্রামে।

কোথায় কোথায় ঘুরবেন:

১.ঘুম মনেস্ট্রি: ইগা চোলিং মনেস্ট্রি দার্জিলিং অঞ্চলের প্রাচীনতম বৌদ্ধ বিহারগুলির মধ্যে একটি। এটি নির্মিত হয়েছে ১৮৫০ সালে। ইয়াগা চোলিং মঠটি হল মূল ঘুম মনেস্ট্রি। এখানের মূল আকর্ষণ ১৫ ফুট লম্বা বিশালাকার বৌদ্ধ মূর্তি। মূর্তিটি মৈত্রেয় বুদ্ধের আদলে তৈরি করা হয়েছে।

২.জোড়পোখরি: ৭৪০০ উচ্চতায় অবস্থিত এই জোড়পখড়ি তার দুটি জোড়া দ্বীপের জন্য বিখ্যাত। “জোড়” অর্থ দুটি এবং ”পোখরি” অর্থ হ্রদ। হ্রদগুলিতে প্রচুর পরিমাণে রাজহাঁস সাঁতার কাটতে দেখা যায়। জায়গাটি কেবলমাত্র তার হ্রদগুলির জন্যই নয়, তার পাইন এবং ধূপি বনাঞ্চলের জন্যও পরিচিত।

৩.মানেভঞ্জন: এটি সান্দাকফু ট্রেকের জন্য বেস ক্যাম্প হিসেবে ধরা হয়। এই জায়গাটি সিংগিলা জাতীয় উদ্যানের জন্য পরিচিত।

৪.পশুপতি মার্কেট: বাজারটি ভারত-নেপাল সীমান্তে অবস্থিত। এই বাজারে শুধু মাত্র ভারতীয়দের প্রবেশের অধিকার আছে। এখানে বিদেশি পণ্যের প্রচুর সম্ভার পাওয়া যায়। তবে অবশ্যই কিছু জিনিস পত্র কেনার সময় যাচাই করে নেবেন।

কীভাবে যাবেন:

কলকাতা থেকে যাওয়ার জন্য শিয়ালদহ বা হাওড়া স্টেশন থেকে দার্জিলিং যাওয়ার ট্রেনে উঠতে পারেন। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নামতে হবে। সেখান থেকে শেয়ারে গাড়ি করে দার্জিলিং এর ঘুমে নেমে ওখান থেকে যেতে পারেন। লেপচা জগৎ ঘুরতে
গেলে কালিম্পং কার্শিয়াং,মিরিক,বাতাসিয়া লুপ এই সমস্ত জায়গায় ঘুরতে পারেন।

কোথায় থাকবেন:

লেপচা জগতে থাকার জন্য আপনি অনেক হোম স্টে পেয়ে যাবেন। আগে থেকে অনলাইনে বুকিং করতে পারেন কিংবা ওখানে গিয়েও বুক করতে পারবেন। তবে হোটেল হোম স্টে সীমিত পরিমাণে রয়েছে।

2. লামাহাট্টা: (Lamahatta)

লামাহাট্টা হিল স্টেশন, ২০১২ সালের শেষদিকে ইকো-ট্যুরিজম সাইট হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। স্থানীয় সরকারের সহায়তায়, গ্রামবাসী ও প্রকৃতি সংরক্ষণের দলগুলি একসাথে একটি সুন্দর পর্যটন স্পট তৈরি করতে কাজ করেছিল।

Lamahatta Hill Station
Lamahatta Hill Station

লামাহাট্টাটি প্রায় ৫,৭০০ ফুট উচ্চতায় এবং দার্জিলিং শহর থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। গাড়িতে করে এখানে যেতে প্রায় ১ ঘন্টার মত সময় লাগে। পাইনের জঙ্গলের ভিতরে গাছগাছালি, পাহাড় আর অসংখ্য ফুলের অপরূপ সমারোহ এই পার্কে।

এখানকার অধিবাসীরা সরকারের সাথে সহযোগিতায় একটি ইকো-ট্যুরিজম গঠন করেছে। মনোমুগ্ধকর সবুজের উদ্যান এবং নদীও ছোট ছোট পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত লামাহাট্টা একটি ছোট পাহাড়ী গ্রাম যা এখন আসন্ন প্রকৃতি প্রেমী পর্যটকদের পরিচিত হতে শুরু করেছে।

কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবেন:

১.দেওলো হিল: কালিম্পং বাস স্টেশন থেকে 10 কিলোমিটার দূরে, দেওলো মাউন্টেন পশ্চিমবঙ্গের কালিম্পংয়ের উত্তর-পূর্ব দিকে একটি পাহাড়ের চূড়া। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২ হাজার মিটার উঁচুতে অবস্থিত, দেওলো হিলটি শহরের দীর্ঘতম পর্বত এবং জনপ্রিয় কালিম্পং পর্যটন স্থানগুলির মধ্যে একটি।

২.তাকদহ: তাকদাহে বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে একটি দুর্দান্ত অর্কিড কেন্দ্র। এটি মূলত এলাকা থেকে আধা কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখানে আপনি বিভিন্ন ধরণের অস্বাভাবিক এবং রঙিন হিমালয়ান অর্কিডগুলি চাষ এবং জন্মানো দেখতে পাবেন। অনেক পর্যটক বিশেষত অর্কিড কেন্দ্রটি দেখতেই তাকদহ আসেন।

৩.পেশক টি গার্ডেন: পেশক চা বাগানটি তাকদাহ থেকে দেখতে আসা দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে একটি যেখানে পর্যটকরা পেশক চা বাগান পরিদর্শন করে এবং চা বাগানের সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন।

৪.তিংচুলে: লামাহাট্টা থেকে মাত্র 6 কিলোমিটার দূরে পাইন সুগন্ধযুক্ত বনের মধ্যে একটি গ্রাম।

এছাড়াও রয়েছে তিস্তা নদীর বয়ে চলা,তাকদহ মনেস্ট্রি,চা বাগান, ফুলের বাগান। রংলি রংলিয়ট চা বাগান,মংপু,বার্ড ভিউ পয়েন্ট। এছাড়াও আপনি এখান থেকে কালিম্পং এ যেতে পারবেন।

কীভাবে যাবেন:

লামাহাট্টা যাওয়ার পথ অনেকটা  লেপচাজগতের মতই। আপনাকে নিউ জলপাইগুড়ি যেতে হবে। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে পৌঁছে যেতে পারেন তাকদহ কিংবা লামাহাট্টা অথবা শিলিগুড়ি থেকে ও যেতে পারেন। শিলিগুড়ি থেকে তিস্তাবাজার হয়ে পেশক তারপরে লামাহাট্টা।

কখন যাবেন লামাহাট্টা:

বছরের যে কোন সময় যেতে পারেন। তবে অক্টোবর থেকে এপ্রিল মাস সব থেকে ভালো এই হিল স্টেশনে যাওয়ার জন্য।

সঙ্গে অবশ্যই শীতের পোশাক নিন। আর লামাহাট্টা পার্কে খুব বেশি সন্ধ্যা পর্যন্ত না থাকাই ভালো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘুরে নিন। অবশ্যই কোভিভ বিধি মেনে চলুন। মাস্ক স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন ভ্রমণের সময়।

মেঘের পরে মেঘ জমে, কুয়াশায় মাখামাখি উঁচু নীচু রাস্তা,পাহাড়ী গ্রামের সৌন্দর্য উপভোগ করতে অবশ্যই এই দুটি হিল স্টেশনে একবার হলেও ঘুরে আসুন। যারা দার্জিলিং ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত লেপচা জগৎ ও লামাহাট্টা তাদের নিরাশ করবে না!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top