গ্রীষ্মের দাবদাহে কি একটু ক্লান্ত। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে দূরে বা কাছে শান্ত পরিবেশ, কিংবা মনটা একটু পাহাড় পাহাড় করছে?কোনো চিন্তা না করেই কলকাতা থেকে কাছেই একটি অতি পরিচিত ভ্রমণ স্থানে ঘুরে আসুন! হ্যাঁ ডুয়ার্স যেতে পারেন।
ডুয়ার্স পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম রাজ্যের সংলগ্ন এলাকায়, পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত। জঙ্গল ও পাহাড়ি পথ,পাহাড়ি গ্রাম, উঁচু নীচু রাস্তা, অভয়ারণ্য সব মিলিয়ে ভারতের একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র ডুয়ার্স।
এখানকার অধিবাসীরা বাংলা,নেপালি ও অসমীয়া ভাষাভাষী। হিমালয়ের পাদদেশ তথা সমভূমি ও পর্বত অঞ্চলের মিলনস্থানে ডুয়ার্স এর অবস্থান।
এখানকার প্রধান নদীগুলি হল তিস্তা, তোর্সা, জলঢাকা, মহানন্দা, কলজানি, বালাসন প্রভৃতি। ডুয়ার্স’কথার অর্থ দুয়ার বা দরজা।
অর্থাৎ এর অর্থ হল ভুটান সহ গোটা উত্তর পূর্ব ভারতের প্রবেশপথ এই ডুয়ার্স অঞ্চল।
প্রচুর ফরেস্ট,নদী আর পাহাড়ের সংমিশ্রণে প্রায় ১০০টির কাছাকাছি দর্শনীয় স্থান রয়েছে এখানে।
১. ইতিহাস:
ডুয়ার্স ভারতের কোচ রাজবংশের অধীনে কামতা রাজ্যের একটি অংশ গঠন করেছিল। এরপরে এটি ভুটান এবং পরবর্তীকালে ১৮৬৫ সালে ব্রিটিশদের অধীনে আসে।
ব্রিটিশরা ১৯৪৭ সালে ভারত ত্যাগ করে এবং ১৯৪৯ সালে ডুয়ার্স আবারও ভারত ইউনিয়নের অঙ্গ হিসাবে পরিণত হয়।
এখানকার অধিবাসীরা হলেন মূলত বাঙালি নেপালি ও আসামী উপজাতিরা হলেন আসামীয়া।
এছাড়াও উপজাতিরা হলেন বোডো, রাভা, মেক, টোটো, কোচ রাজবংশী, তামাং / মুর্মি, লিম্বু, বাংলার লেপচা, ওরাওঁস, মহালি, মুন্ডা, খড়িয়া, লোহারা এবং চিক বারাইক এবং অভিবাসী সাঁওতালরা চা বাগানে কাজ করতে আসেন।
২. ডুয়ার্সের দর্শনীয় স্থান:
ক. গরুমারা ন্যাশনাল পার্ক:
এটি ডুয়ার্সের মালবাজার অঞ্চলে অবস্থিত।গোরুমারা জাতীয় উদ্যান মূলত গন্ডারের জন্য বিখ্যাত।
লাটাগুড়িতে থেকে গরুমারা দেখতে হয়। বনে প্রবেশের জন্য অনুমতি নিতে হয় বন দফতরের লাটাগুড়ি রেঞ্জ অফিস থেকে।
এই উদ্যানে রয়েছে চারিদিকে শাল সেগুনের গাছের ছায়া। এছাড়াও জঙ্গলে রয়েছে প্রচুর পাখি,হাতি,সম্বর ইত্যাদি।
মূলত ডুয়ার্স অঞ্চলের জলদাপাড়া-চাপড়ামারি-গোরুমারা রেঞ্জের অন্তর্গত এই জাতীয় উদ্যান।
এখানে চাইলে জিপ নিয়ে সাফারি করতে পারেন। সাফারি করার সময় ভাগ্য ভালো থাকলে ময়ূর,হরিণ, গন্ডারের দেখা পেতে পারেন।
খ. জলদাপাড়া ন্যাশনাল পার্ক:
জলদাপাড়া একটি জাতীয় উদ্যান যা সেন্ট্রাল ডুয়ার্সে অবস্থিত। এখানে তোর্সা নদীটি জাতীয় উদ্যানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
এই পার্কটিতে রাজ্যের অন্যতম শিংযুক্ত ভারতীয় গণ্ডার বৃহত্তম জনসংখ্যা রয়েছে।
চিতাবাঘ, সাম্বর, হাতি, হরিণ, বুনো শূকর, দাগযুক্ত হরিণ এবং জলদাপাড়ায় পাওয়া অন্যান্য প্রাণীগুলির মধ্যে কয়েকটি।
এখানকার চিলাপাতা জঙ্গলটিও আকর্ষণীয় জঙ্গল সাফারি করার জন্য।
গ. চাপরামারি:
চাপরামারি উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ির অন্তর্গত চালসা এবং লাটাগুড়ি থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত চাপরামারি বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য।
১৯৯৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকার এই জঙ্গলকে জাতীয় বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্যের আখ্যা দিয়েছেন। মূর্তি নদীর পাশ দিয়ে এটি গড়ে উঠেছে।
এর কিছুটা দূরেই রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। এখানে রাত কাটাতে চাইলে রয়েছে চাপরামারি বন বাংলো।
এখানে এশীয় হাতি, বাইসন, সম্বর হরিণ, চিতাবাঘ এবং বন্য শুকোর চাপরামারি অভয়ারণ্যের মূল আকর্ষণ।
ঘ. চালসা গৌরীগাঁও:
লাটাগুরি থেকে ২০ কিমি দূরে অবস্থিত চালসা।একটি শান্ত নিরিবিলি সবুজের হাতছানি।
এখান থেকে ১কিমি দূরে রয়েছে গৌরীগাঁও। চারিদিকে চা বাগান,ও পাহাড়বেষ্টিত স্থান।
ঙ. বক্সা জাতীয় উদ্যান:
বক্সা জাতীয় উদ্যান ভারত-ভুটান আন্তর্জাতিক সীমান্ত ও সিঞ্চুলা পর্বতমালার কাছে অবস্থিত।
১৯৯৭ সালে রাজ্য সরকার বক্সাকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে।বক্সা জাতীয় উদ্যানের মধ্যে রয়েছে বক্সা দুর্গ।
এখানে গেলে আপনি দেখতে পাবেন ৩০০টির ও বেশি গাছ, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও বাঘ,হরিণ,বুনো মোষ,পাইথন,হাতি ইত্যাদি।
বক্সা জাতীয় উদ্যানের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে রায়ডাক ও জয়ন্তী নদী।বক্সা ট্রেকিং এর জন্য জনপ্রিয়।
চ. জয়ন্তী:
বক্সা জঙ্গলের ধার ঘেঁষে রয়েছে জয়ন্তী।জয়ন্তীকে ডুয়ার্সের রানী বলা হয়।
চারিদিকে পাহাড় আর জঙ্গলের সমারহ তবে জয়ন্তী থেকে মহাকাল মন্দির পর্যন্ত ট্রেকিং করার সুযোগ রয়েছে।
জয়ন্তী নদীর গা ঘেঁষে ভুটান সীমান্তে পাহাড়ের মাথায় আধ ঘন্টার ট্রেকিং পথে পৌঁছানো যায়।
ছ. ঝালং:
লাটাগুরি চালসা থেকে যেতে পারেন ঝালং গ্রামে।ঝালং এর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে জলঢাকা নদী।
ঝালং গ্রামে রয়েছে একটি মনেস্ট্রি।ঝালং থেকে ভুটানের ঝলক দেখা যায়।একটি প্রাইভেট গাড়ি বুক করে ঘুরে আসুন ঝালং,বিন্দু।
জলঢাকা নদীর গা ঘেঁষে রয়েছে তাঁবুর ব্যবস্থা। সেখানেও চাইলে থাকতে পারবেন।
তবে এখানে থাকতে হলে কলকাতা পশ্চিমবঙ্গ বনদপ্তর থেকে তাঁবু বুক করতে হবে।
জ. বিন্দু:
ঝালং গ্রাম হয়ে আপনি যেতে পারেন বিন্দুতে।ভারত ও ভুটান বর্ডার সীমান্তে অবস্থিত বিন্দু।
চা বাগানের গ্রাম এই বিন্দু। বিন্দুতে আছে জলঢাকা জলবিদ্যুৎ ব্যারেজ। ওপারেই রয়েছে ভুটান।
চা বাগান, সবুজ জঙ্গল,ভুটানিয়া মানুষের দেখাও মেলে এই বিন্দু গ্রামে।
জ. সুলতানখোলা:
সুলতানখোলা কালিম্পং জেলার অন্তর্গত একটি গ্রাম। ঝুলন্ত ব্রিজ পেরিয়ে সুলতানখোলায় পৌঁছাতে হয়।
এখানে পাহাড়ি ঝর্ণা রয়েছে আর অবশ্যই চারিদিকে সবুজ প্রান্তর।
ঝ. রকি আইল্যান্ড:
সুলতানখোলা হয়ে সামসিং হয়ে ঘুরে আসতে পারেন রকি আইল্যান্ড থেকে। বড়ো বড়ো পাথরের চাঁই তার মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে মূর্তি নদী।
অসম্ভব সুন্দর এক প্রাকৃতিক দৃশ্যের সৃষ্টি করে যা সামনে থেকে না দেখলে বোঝার উপায় নেই।
তবে বর্ষাকালে এখানে যেতে দেওয়া হয় না কারণ তখন জলের স্রোত প্রবল থাকে তাই বিপজ্জনক কিছুটা।
এছাড়াও যে জায়গাগুলো খুব জনপ্রিয় সেগুলো হলো- সামসিং,গোরুবাথান,খয়েরবাড়ি,ডামাডিম,চেইন খোলা,ফাগু,রসিকবিল,রাজাভাতখাওয়া ইত্যাদি।
৩. কীভাবে যাবেন ডুয়ার্স:
ট্রেনে করে যেতে চাইলে শিয়ালদহ থেকে নিউ জলপাইগুড়ি যাওয়ার যে কোনো ট্রেনে উঠতে হবে যেমন কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস, পদাতিক কোভিড ১৯ স্পেশাল, দার্জিলিং মেল, তোর্সা ফেস্টিভ্যাল স্পেশাল ইত্যাদি।
NJP/নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নামতে হবে সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে শিলিগুড়ি হয়ে ডুয়ার্স।
বিমানে যেতে চাইলে আপনাকে দমদম বিমানবন্দর থেকে প্লেনে করে বাগডোগরা এয়ারপোর্টে নামতে হবে। তারপর গাড়ি করে যেতে হবে।
৪. কোথায় থাকবেন:
এত জনপ্রিয় জায়গায় হোটেলের অভাব নেই! আপনি বনদপ্তরের বন বাংলোতে থাকতে পারবেন এছাড়া রেসর্ট হোটেল ও হোম স্টে বিভিন্ন রেঞ্জের পেয়ে যাবেন।
অনলাইনে অ্যাপ ব্যবহার করে বুকিং করে যেতে পারেন কিংবা ওখানে গিয়ে দেখেও হোটেল বুক করতে পারেন।
গরমের এই সময়ে এপ্রিল মাসে ডুয়ার্স ভ্রমণ কিন্তু সত্যি অসাধারণ। তবে বর্ষাকালে ডুয়ার্স ভ্রমণ এড়িয়ে চলুন কারন অনেক স্পট বর্ষার কারনে বন্ধ থাকে।
হিম শীতল আমেজ, বনাঞ্চল,সারি সারি পাহাড়, উঁচু নীচু রাস্তা, শহরের কোলাহল ছেড়ে নির্জনে কাটিয়ে আসতে পারেন ডুয়ার্স থেকে