বীরভূমের একটি ছোট জায়গার নাম বোলপুর শান্তিনিকেতন। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি ঘেরা, সাহিত্য সংস্কৃতির স্থান এই শান্তিনিকেতন।
বিভিন্ন জায়গা থেকে শান্তিনিকেতন ঘুরতে আসেন মানুষজন এই প্রচলন অনেক দিনের। তবে বিদেশ থেকেও প্রচুর মানুষের আগমন ঘটে এখানে।
শান্তিনিকেতন ও রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর টানে প্রচুর মানুষ বছরের বিভিন্ন সময়ে রাঙামাটির এই জায়গায় সময় কাটান।
রাঙামাটির পথ,বাউল,কোপাই-খোয়াই,রবি ঠাকুর, বিশ্বভারতী,পৌষমেলা,সোনাঝুরি ঘেরা শান্তিনিকেতন যেতে কার না বারবার মনে চায়।
কিন্তু আজকাল ব্যস্ততার মধ্যে অনেক দিন হাতে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার অবকাশ হয়তো পাওয়া যায় না তাই ২দিনে কীভাবে ঘুরে আসা যায় ও উপভোগ করা যায় চলুন জেনে নিই।
১. ইতিহাস:
এখনকার এই শান্তিনিকেতন এর প্রথম নাম ছিল ভুবনডাঙা। কুখ্যাত ডাকাত ভুবন ডাকাতের নামে এই শহরটির নাম ছিল ভুবনডাঙ্গা।
এই সময় ১৮৬২ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর আশ্রম নির্মাণ করার জন্য একটি জায়গার সন্ধানে ছিলেন।
রায়পুর যাওয়ার সময় তিনি এই জমিটি দেখতে পান এবং তার মনে হয়েছিল আশ্রম নির্মাণ এর জন্য আদর্শ এই স্থান।
তখন তিনি ভুবনমোহন সিংহর কাছ থেকে এই জমি টি কিনে নিয়েছিলেন। সেখানে একটি বাড়ি নির্মাণ করেন যার নাম দিয়েছিলেন শান্তিনিকেতন।
কথিত আছে যে ডাকাত ভুবন সিংহের অত্যাচারে ওখানকার স্থানীয়রা ভয়ের জীবন যাপন করতেন।
ফলত তারা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে আত্মসমর্পণ করেন এবং শান্তিনিকেতন গড়ে তুলতে সহায়তা করেন।
এরপরে ওখানকার পুরো এলাকাটি শান্তিনিকেতন নামে পরিচিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতন ঘুরতে আসেন ১৮৭৩ সালে তখন তার বয়স মাত্র ১২ বছর।
এরপরে তিনি এখানে ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপন করেন যা পরবর্তীতে বিশ্বভারতী রুপে প্রতিষ্ঠিত হয়।
২. কীভাবে যাবেন?
কলকাতা বা বিভিন্ন জায়গা থেকে শান্তিনিকেতন যাওয়ার পরিকল্পনা করলে ট্রেন কিংবা বাস দুটো পরিবহনের মধ্যে দিয়েই যাওয়া যায়।
ট্রেনে করে যেতে চাইলে শিয়ালদহ কিংবা হাওড়া থেকে রামপুরহাটগামী ট্রেনের তালিকা দেখতে হবে।
হাওড়া থেকে:
গনদেবতা এক্সপ্রেস-6:05 am-8:42 am
শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস-10:10 am-12:25 am
সরাইঘাট এক্সপ্রেস-3:55 pm- 5:55 pm
বিশ্বভারতী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার- 4:35 pm – 7:45 pm
শিয়ালদহ থেকে:
কাঞ্চনজঙ্ঘা ফেস্টিভ্যাল স্পেশাল- 6:35 am- 9:11 am
মালদা টাউন স্পেশাল- 7:40 pm -10:15 pm
এছাড়া বাসে করে যেতে চাইলে কলকাতার এসপ্ল্যানেড থেকে বোলপুর যাওয়ার বাস পরিষেবা পাওয়া যায়।
এর মধ্যে যে কোনো ট্রেনে করে বোলপুর স্টেশনে নামতে হবে। স্টেশনের বাইরে টোটো পেয়ে যাবেন অনায়েসেই। তারাই আপনাকে হোটেলে নিয়ে যাবে।
৪০০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন রেঞ্জের গেস্ট হাউস, লজ, হোটেল, রেসর্ট পেয়ে যাবেন।
৩. শান্তিনিকেতনের সৌন্দর্য ও দর্শনীয় স্থান
শান্তিনিকেতনে বিভিন্ন উৎসব পালিত হয় বিভিন্ন সময়, এছাড়াও কুটির শিল্প, হস্তশিল্প,মেলা, হাঁট, বিশ্বভারতী সবসময় যেন শান্তিনিকেতনকে আলাদা আমেজে ভরিয়ে রাখে।
শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি, সাহিত্য, ওখানকার সংস্কৃতি এই স্থানকে বরাবর সমৃদ্ধ করেছে।
শান্তিনিকেতন ভবন:
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির আদলে এই বাড়িটি তৈরি হয়। ১৮৬৪ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বাড়িটি নির্মাণ করেন।
এটি শান্তিনিকেতনের আশ্রমের সবচেয়ে পুরনো বাড়ি। বাড়িটি ছিল দালান বাড়ি একতলা।
বাড়ির উপরিভাগে খোদাই করা ‘ সত্যাত্ম প্রাণারামং মন আনন্দং ‘ মহর্ষির প্রিয় উপনিষদের এই উক্তিটি। তিনি নিজে বাড়ির একতলায় ধ্যানে বসতেন।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এখান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখতেন। এখন এই বাড়িটির সামনে রামকিঙ্কর বেইজের একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে যার নাম’অনির্বান শিখা’।
উপাসনা মন্দির:
উপাসনা গৃহটি প্রতিষ্ঠা করেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বেলজিয়াম রঙিন কাঁচের কারুকার্য খচিত এই উপাসনা মন্দিরটি ভ্রমণ প্রেমীদের প্রিয়।
এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র দিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন থেকেই ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসাবে প্রতি বুধবার সকালে উপাসনা করা হয় এই মন্দিরে।
যেকোনো ধর্মের মানুষই এই উপাসনাগৃহতে প্রবেশ করতে পারে। তবে তার জন্য তাকে বিশেষ সাদা পোশাক পরতে হয়।
ছাতিমতলা:
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন রায়পুরে আসছিলেন তখন তিনি এই ছাতিম গাছের নীচে বসতেন।
তিনি যখন এই জমিটি পাট্টা নিয়েছিলেন তখন তিনি এই গাছের নীচে তার মনের আরাম প্রানের আরাম প্রিয় এই গাছটির তলায় বসতেন তবে এই গাছ দুটি পরবর্তী কালে মরে গেলে নতুন করে এখানে গাছ রোপণ করা হয় যেখানে প্রবেশ নিষেধ ভ্রমণকারীদের।
দক্ষিণ দিকের গেটে “তিনি আমার প্রাণের আরাম মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি” এই কথাটিও লেখা আছে।
আম্রকুঞ্জ:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরে তাকে এই আম্রকুঞ্জে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে।
মহারাজা মহতাব চাঁদ তার মালি রামদাস কে পাঠিয়ে এই বাগানের পত্তন ঘটান। বর্তমানে এখানে পাঠভবনের ক্লাস, সমাবর্তন অনুষ্ঠান, বসন্ত উৎসব এখানেই পালিত হয়।
কলাভবন:
রবীন্দ্রনাথ কলা শিক্ষা বিষয়ক, দেশীয় শিল্পকে গুরুত্ব দিয়ে গড়ে তোলেন কলা ভবন।
এরপর নন্দলাল বসু ও রামকিঙ্কর বেইজের এর কলাকুশলীদের সহায়তা পেয়ে একটি মূল্যবান অঙ্গ হিসেবে গড়ে ওঠে শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন “এটি আশ্রমের বিশেষ সম্পদ”।
গৌরপ্রঙ্গন:
শান্তিনিকেতনের ছাত্র বিশিষ্ট খেলোয়াড় গৌরগোপাল ঘোষের নামানুসারে এই প্রাঙ্গণটির নামকরণ হয়েছে।
উত্তর পূর্ব কোনে প্রবেশ দ্বারে একটি বেদী রয়েছে যার নাম ঘন্টাতলা। এখানেও বিশ্বভারতীর ক্লাস নেওয়া হয়।
সোনাঝুরি হাঁট:
শান্তিনিকেতন ঘুরতে যাবেন আর সোনাঝুরি না গেলে হয়!এই হাঁটটি শনিবারে বসে। খুব জমজমাট একটি হাঁট।
কুটির শিল্প হস্তশিল্প এর এই মেলায় স্থানীয় মানুষের বানানো শাড়ি গয়না ব্যাগ বিভিন্ন জিনিসপত্র পাওয়া যায়।
এছাড়াও সোনাঝুরি বনের নিজস্ব সৌন্দর্য সঙ্গে বাউল গানের পসরা আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য মহিমায়।
প্রচুর বাউল সমাবেশ ঘটে এখানে দুপুর ৩টের পর থেকেই হাঁট জমজমাট হয়।
এছাড়াও আছে আরও অনেক দর্শনীয় স্থান যেমন
উত্তরায়ণ,দেহলি,তালধ্বজ,রবীন্দ্র ভবন,চিনা ভবন,পাঠভবন,কলাভবন,বকুলবীথি,তিনপাহার, মালঞ্চ,কঙ্কালীতলা,কোপাই নদী, সংগীত ভবন,কালো বাড়ি,শাল বীথি,চিনা ভবন ইত্যাদি।
৪. কোথায় থাকবেন?
প্রচুর হোটেল, রেসর্ট,হোম স্টে,মাড হাউস রয়েছে বিভিন্ন দামের। আপনারা স্টেশনে নেমে টোটোতে বললে ওরাই নিয়ে যাবে এছাড়াও আপনি অনলাইনে বুকিং করতে পারবেন।
আর যদি পৌষ মেলা, বসন্ত উৎসব, জয়দেবের মেলা এই সব সময়ে যেতে চান অন্তত কয়েকমাস আগে থেকে আপনাকে হোটেল বুকিং করতে হবে।
যদি আপনি হাতে দুদিন নিয়ে শান্তিনিকেতন ঘুরতে যান তবে আপনি শনিবার সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়ুন। বোলপুরে গিয়ে পৌঁছবেন দুপুর দুপুর করে।
খেয়ে দেয়েই বেরিয়ে পড়ুন সোনাঝুরির হাট দেখতে যা শনিবারের হাট নামেও পরিচিত।
টোটোতে যাওয়ার জন্য একটু দর কষাকষি করতে হবে হয়তো কিন্তু ওনারাই আপনাকে সোনাঝুরি কোপাই দেখাতে নিয়ে যাবে সুন্দর সহযোগিতার সাথে।
তবে অবশ্যই আগে জেনে নেবেন কোন কোন স্থান তারা দেখাবে। হাতে রইল একদিন ওইদিন বাদবাকি স্থান ঘুরে দেখলেই শান্তিনিকেতন ভ্রমণ কিন্তু ভালোভাবেই সম্পন্ন হবে!