লিচু একটি জনপ্রিয় ও পুষ্টিগুন সম্পন্ন গ্রীষ্মকালীন ফল। এতে প্রচুর পরিমাণ খনিজ পদার্থ ও ভিটামিন সি রয়েছে। এছাড়া এতে রয়েছে ঔষধি গুন।
মিষ্টি স্বাদযুক্ত এ ফল টি সকলের প্রিয়। বাজারে এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে।
আমাদের বাংলাভূমি সাইটে নিয়মিত আমরা আপনাদের সাথে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করে থাকি।
এর ফলে আপনারা কৃষি জমি, শিক্ষা, অর্থনীতি এসব বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে থাকেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রয়োজনে আপনারা এ সকল তথ্য থেকে উপকৃত হয়ে থাকেন।
এরই ধারাবাহিকতায় আজ আমরা আপনাদের সাথে লিচু চাষের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব। এতে করে আপনারা সহজেই লিচু চাষের বিস্তারিত জানতে পারবেন।
চলুন দেখে নিন লিচু চাষের বিস্তারিতঃ
জলবায়ুঃ
লিচু গাছ সাধারণত উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়াতে ভালোভাবে বাড়ে, কিন্তু ফুল ধারণের জন্য মৃদু ঠান্ডা আবহাওয়ার প্রয়োজন হয়।
যেসব অঞ্চলে শীতকালে তুষারপাত হয় না কিন্তু গ্রীষ্মকালে উষ্ণ ও আদ্র আবহাওয়া বিরাজ করে সেসব অঞ্চলে লিচু ভালো হয়।
মাটিঃ
যে কোন মাটিতে লিচু ভালো হয়। তবে প্রচুর পরিমান জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ উর্বর দো-আঁশ মাটি লিচু চাষের জন্য উত্তম।
লিচু গাছ স্যাতস্যাতে মাটি পছন্দ করে। সাধারণত যে মাটির পিএইচমান ৬.৫-৬.৮ সে মাটি লিচু চাষের জন্য সর্বোত্তম।
বেলেমাটিতে লিচু গাছ জন্মাতে পারেনা।
জমি তৈরিঃ
লিচু চাষের জন্য যে জমি নির্বাচন করা হয় তা লাঙল বা ট্রাক্টর দিয়ে ভালো করে চাষ করে পরে মই দিয়ে সমতল ও আগাছামুক্ত করে নিতে হয়।
এর ফলে মাটিতে সহজে বায়ু চলাচল করতে পারে। ফলে মাটিতে যে পুষ্টিগুন বিদ্যমান থাকে তা গাছের জন্য সহজলভ্য হয়।
রোপণ প্রণালীঃ
সমতল জমিতে বর্গাকার প্রণালী এবং পাহাড়ি জমিতে কন্টুর প্রণালীতে লিচু চারা লাগানো হয়ে থাকে।
চারা নির্বাচনঃ
গুটি কলম করে লিচু গাছের বংশবিস্তার করা হয়ে থাকে। লিচু ফলের মৌসুম শেষ হওয়ার সাথে সাথে ফলগাছ লাগানোর মৌসুম শুরু হয়ে যায়।
বর্ষাকালের পর যখন মাটিতে রসের পরিমাণ কমতে থাকে তখন লিচুর কলম রোপন করা হয়।
উঁচু, মাটি বেলে দো-আঁশ ধরনের,পানি জমে থাকে না এবং পর্যাপ্ত রোদ থাকে এমন মাটি লিচু চাষের উপযুক্ত।
চারা রোপণের দূরত্বঃ
সাধারণত ১০-১২ মিটার দূরত্বে বজায় রেখে লাগানো উত্তম। কারন ঘন করে লাগালে গাছ পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পায় না।
ফলে প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবে গাছ দূর্বল হয়ে পড়ে। ফলে রোগ ও পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়ে যায়।
চারা রোপনের সময়ঃ
জুন-জুলাই মাস লিচু চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। তবে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চারা লাগানো যায়।
প্রখর রোদে চারা লাগানো উচিত নয়। বিকেলে চারা লাগানো উত্তম।
সারের পরিমাণঃ
ভালো ফলন পেতে গাছে প্রয়োজনীয় সার প্রয়োগ করতে হবে।
১-৩ বছরের গাছের জন্য ১০-২০ কেজি জৈব সার, ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৪০০ গ্রাম টিএসপি, ৪-৬ বছরের গাছের জন্য ২০-৩০ কেজি জৈব সার, ৬০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫০০ গ্রাম টিএসপি, প্রয়োগ করতে হবে।
গাছের বয়স অনুযায়ী সারের পরিমান বৃদ্ধি পাবে।
যদি গাছে জিঙ্কের অভাব হয় তবে প্রতি বছর বসন্তকালে ৫০০লিটার জলের সাথে ২ কেজি চুন ও ৪ কেজি জিঙ্ক সালফেট গুলে জমিতে ছিটিয়ে দিতে হবে।
গাছের যত্নঃ
গাছের আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে। নিয়মিত মরা ডাল পরিষ্কার করতে হবে।
লিচু গাছে তেমন ছাটাইয়ের প্রয়োজন হয় না তবে গাছের আকৃতি ঠিক রাখার জন্য ছাটাই করতে হয়।
সেচ প্রয়োগঃ
শীত ও গ্রীষ্মকালে গাছের বেশি জলের প্রয়োজন হয়। চারার স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য ঘন ঘন সেচ দিতে হয়।
তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে সেচের পরিমাণ পর্যাপ্ত থাকে কারণ প্রয়োজনের বেশি বা কম রস গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য ক্ষতিকর।
পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হলে ফুল ফোটার সময় একবার এবং ফল মটরদানার সমান আকৃতিতে থাকার সময় একবার সেচ দিতে হবে।
সাধারণত শীতের বিকেলে সেচ দেওয়া গাছের জন্য উপকারী। গাছের গোড়ায় যেন জল জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
প্রয়োজনে নালা তৈরি করে দিতে হবে।
রোগ ও পোকা দমন ব্যবস্থাপনাঃ
লিচুর তেমন মারাত্নক কোন রোগ নেই। লিচু গাছে মাইট নামক এক ধরনের পোকার আক্রমন হতে দেখা যায়।
এ পোকা আকারে খুব ছোট এবং দেখতে অনেকটা মাকড়সার মতো। এ পোকা সর্বপ্রথম পাতায় আক্রমণ করে। আক্রান্ত পাতায় লালচে বাদামি বর্ণের দাগ দেখা যায়।
এর ফলে গাছের বৃদ্ধি ও ফলন কম যায়। আক্রান্ত ডাল ছেটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
১০ লিটার জলেতে ২০ গ্রাম থিয়োভিট মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এছাড়া ফল ছিদ্রকারি এক ধরনের পোকা দেখা যায়।
এই পোকা ফল পাকার সময় বোটার কাছে ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে যায় এবং বীজকে আক্রমণ করে। ফল পাকার সময় যদি বৃষ্টি হয় তখন এই পোকার উপদ্রব দেখা যায়।
এরা ছিদ্রের মুখে বাদামি বর্ণের এক প্রকার মিহি গুড়া সৃষ্টি করে। এর জন্য ফল নষ্ট হয় এবং বাজার মূল্য কমে যায়।
গুটি ধরার পর ১৫ দিন পর পর ২ বার সিমবুশ ১ মিলি হারে ১ লিটার জলের সাথে মিশিয়ে স্প্রে করতে হয়।
ফল সংগ্রহঃ
সাধারণত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে মার্চ মাসে গাছে ফুল আসে এবং মে মাস থেকে জুন মাসে ফল সংগ্রহ করা হয়ে থাকে।
ফল সংগ্রহের সময় ফলের খোসা লালচে বর্ণ ধারণ করে ও কাটা চ্যাপ্টা হয়ে খোসা প্রায় মসৃণ হয়ে থাকে।
বৃষ্টির পর পর কখনোই ফল সংগ্রহ করা উচিত নয়। ফল সংগ্রহের সময় কিছু পাতা রেখে সংগ্রহ করা উচিত এতে ফল বেশি দিন সংগ্রহ করা যায়।
ফলনঃ
একটি বয়স্ক গাছে প্রায় ৪-৫ হাজার লিচু পাওয়া যায়। জাত ভেদে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়।