ছট পূজা 2024 (Chhath Puja 2024 Date Time and Significance) 2024 ছট পূজা ইতিহাস এবং জানুন ছট পূজা কেন পালন করা হয়? ছট পূজা তাৎপর্য কি? ভারতীয়দের জন্য ছট পূজা গুরুত্ব কতটা? জানুন সবকিছু এখানে।
বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ, প্রতিটি মুহূর্তে উৎসবের আমেজ লেগেই রয়েছে। আর সমস্ত উৎসব ও পূজা অনুষ্ঠানের পাশাপাশি হিন্দু ধর্ম অনুসারে ছট পূজা হলো মূলত সূর্যদেবের পূজা। ছট পূজা ভারতের উত্তর প্রদেশ, বিহার এবং ঝাড়খণ্ডের কিছু কিছু অংশে খুবই জাকজমকপূর্ণ ভাবে উদযাপন করা হয়।
তবে ছট পূজার ব্যাপকতা বাংলার থেকে বিহার রাজ্যের মানুষদের মধ্যেই সব থেকে বেশি লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া এই কারণে ছট পূজাকে বিহারীদের উৎসব বলে অনেকেই জানেন।
ছট পূজা 2024:
ছট পূজা হল সূর্য এবং তার স্ত্রী ঊষা দেবীর একটি পূজা। তবে ছট পূজার মধ্যে দিয়ে সূর্যদেবের উপাসনা করা হয়, প্রতি বছর কার্তিক মাসের শুক্ল তিথিতে চতুর্দশীর দিন অর্থাৎ কালী পূজার ছয় দিন পর থেকে সপ্তমী পর্যন্ত মোট চার দিন ধরে এই ছট পূজা পালন করা হয়।
এছাড়া চৈত্র মাসে একই রকম নিয়ম পালন করে আরো একবার ছট পূজা করা হয়। কার্তিক মাসের ছট পুজাকে কার্তিক ছট এবং চৈত্র মাসের ছট পূজা কে চৈতি ছট বলা হয়।
ছট পূজার পৌরাণিক কাহিনী:
হিন্দু ধর্মে রামায়ণ এবং মহাভারতের কাহিনীতে ছট পুজার বর্ণনা পাওয়া যায়। এছাড়া রামায়ণের শ্রীরামচন্দ্র লঙ্কা থেকে যখন অযোধ্যায় ফিরে আসেন, তখন অযোধ্যায় ফিরে এলে রামচন্দ্রের রাজ্য অভিষেক করা হয়েছিল। রামচন্দ্র তখন তার স্ত্রীর সীতার সঙ্গে প্রজা কল্যাণে রাম রাজ্য স্থাপনের জন্য কার্তিক মাসের শুক্ল ষষ্ঠীতে সূর্যের উপাসনা করেছিলেন।
2024 ছট পূজা শুভেচ্ছা বার্তা ও স্ট্যাটাস ছবি
এছাড়া মহাভারতের কাহিনীতে ছট পূজার যে উল্লেখ পাওয়া যায় সেখানে পঞ্চ পান্ডব দের স্ত্রী দ্রৌপদী কৌরব দের হাত থেকে হস্তিনাপুরের রাজপাট ফিরে পাওয়ার জন্য সূর্যের উপাসনা করেছিলেন। এছাড়াও সূর্য পুত্র কর্ণ প্রত্যেকদিন সকালবেলা স্নান সেরে অঙ্গরাজ্যের কল্যাণে সূর্যের উপাসনা করতেন।
ছট পুজোর প্রচলন সম্পর্কে ইতিহাস:
ছট পূজার এই “ছট” শব্দটি ষষ্ঠ থেকে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া ভোজপুরি, বিহারী এবং মৈথিলী ভাষায় ষষ্ঠকে ছঠী উচ্চারণ করা হয়। ব্রহ্ম বৈবর্ত পূরণে একটি কাহিনী অনুসারে অন্নপূর্ণার ছট পূজা করার উল্লেখ পাওয়া যায়।
একবার আষাঢ় মাসে বর্ষার আগমনে চাষিরা খেতে শস্য বুনে দিয়েছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে বর্ষা ক্ষীর্ণ হয়ে পড়ে তখন সূর্যের প্রবল দ্রাবদহে মাঠ ঘাড় সম্পূর্ণ শুকিয়ে গিয়ে পুড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। চাষীদের ঘরে ঘরে দেখা যায় অন্নের অভাব। তাই তখন মা অন্নপূর্ণা সূর্য দেবের স্মরণ নেন এবং উপায় না দেখে সূর্যদেবের ধ্যানে মগ্ন হন।
কিন্তু সূর্যদেবের ধ্যান করে বিশেষ ফল পাওয়া যায় নি বলে মা অন্নপূর্ণার সূর্যের প্রখর রোধের তেজে জীর্ণ দশা হয়ে যায়। তখন দেবতারা মা অন্নপূর্ণার এই করুন অবস্থা দেখে সকলে মিলে সূর্যের শরণাপন্ন হন, সূর্যদেব তখন মা অন্নপূর্ণা কে কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষে ষষ্ঠীতে গঙ্গা তীরে গিয়ে সূর্য উপাসনা করার কথা বলেন।
এরপর মা অন্নপূর্ণা চাষীদের কল্যাণ সাধন করার জন্য ভক্তি ভরে গঙ্গা তীরে সূর্যের উপাসনা করতে লাগলেন এবং পৃথিবীকে পুনরায় শস্য শ্যামলা করে তোলেন এবং এইভাবে চাষীদের কষ্ট দূর করতে পেরেছিলেন মা অন্নপূর্ণা। সেই থেকে পরিবারের মহিলারা এই পূজাতে অংশগ্রহণ করে থাকেন, মূলত পরিবার ও বিশ্বের কল্যাণে ছট পূজার ব্রত পালন করা হয় বলে জানা যায়।
আরেকটি কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, প্রথম মনু প্রিয়বত সন্তানহীন ছিলেন, তার পিতা কাশ্যপ মুনি পুত্রেষ্ঠী যজ্ঞ করার পরামর্শ দেন। যার ফলে তার স্ত্রী মালিনি একটি মৃত পুত্র সন্তান প্রসব করেন।
মৃত শিশু হওয়ার দুঃখে তারা পাগল প্রায় অবস্থা হতে থাকায় আকাশ থেকে একটি দিব্যকন্যা প্রকট হন, যিনি নিজেকে ব্রম্ভার মানস পুত্রী বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি সেই মৃত শিশু কে স্পর্শ করার সাথে সাথে সেই পুত্র সন্তানটি জীবন ফিরে পায়। ভক্তরা তাই ঊষা দেবী বা ছটি মায়ের কাছে পুত্র প্রাপ্তির আশায় ব্রত উপাসনা করে থাকেন।
ছট পূজার বিধি – নিয়ম অথবা পূজার পদ্ধতি:
ছট পূজার জন্য চতুর্দশীর দিন থেকে সপ্তমী পর্যন্ত এই মোট চার দিন খুবই নিষ্ঠার সাথে ছট পূজার ব্রত উপবাসীরা ছট পূজার ব্রত পালন করে থাকেন। যারা ছট পূজার ব্রত করেন তারা ভাইফোঁটার পরের দিন থেকেই নিরামিষ খাবার খাওয়া শুরু করে দেন।
যেহেতু ছট পূজা চারটি দিন হিসাবে ভাগ করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে চলুন এই চার দিনের ছট পূজা সম্পর্কে জানা যাক:-
ছট পুজার প্রথম দিন:
এই পূজার প্রথম দিন মানে হল চতুর্দশীর দিন। যারা ব্রত পালন করবেন, তারা শুদ্ধ কাপড় পরে ছট পূজার জন্য ব্রতী হবেন এবং সেই দিন লবন ছাড়াই ছোলার ডাল, মিষ্টি কুমড়া, দিয়ে ভাত রান্না করে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
ছট পূজার দ্বিতীয় দিন:
ছট পূজার দ্বিতীয় দিন হল পঞ্চমীর দিন, যেটা খরনা ব্রত পালন করার দিন। এই দিন থেকে ছট পুজার একেবারে নির্জলা উপবাস ছত্রিশ (৩৬) ঘন্টার জন্য রাখা শুরু হয়। এই দিন ছট ব্রত পালনকারী মহিলারা কাঠের আগুনে মাটির উনুনে গুড়ের পায়েস রান্না করে খেয়ে, পরে ছট পূজা এবং ঠেকুয়া, নাড়ু ইত্যাদি প্রসাদ তৈরি করেন।
ছট পূজার তৃতীয় দিন:
ছট পূজার তৃতীয় দিন হলো ষষ্ঠীর দিন। এই দিনে ছট পূজার ব্রত পালনকারী মহিলারা সূর্যাস্তের সময় ডুবতে থাকা সূর্যকে গঙ্গাঘাটে অথবা বড় কোন জলাশয়ের ধারে ধামা ভর্তি করে গোটা আখ গাছ, হলুদ গাছে এছাড়া পূজার বিভিন্ন উপাদেও সামগ্রী নিয়ে গিয়ে সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য নিবেদন করে থাকেন।
ছট পূজার চতুর্থ দিন:
এই পূজা চতুর্থ দিন মানেই তো সপ্তমীর দিন, তাই না ! এই দিন সকালবেলা সূর্য উদয়ের সময় যারা ছট পূজার জন্য ব্রত পালন করছেন, সেই সমস্ত মহিলারা তাদের পরিবারের সঙ্গে ছট ঘাটে গিয়ে সূর্য দেবকে অর্ঘ্য নিবেদন করে ছট পূজার উপবাস ভঙ্গ করে থাকেন।
ছট পূজার বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব:
অনেক বিজ্ঞানীদের মত অনুসারে ছট পূজা বিশেষভাবে বিজ্ঞানসম্মতও বটে। মানব শরীর থেকে ক্ষতিকর টক্সিন এর নিঃসরণ করতে সাহায্য করে থাকে এই পূজার ব্রত এবং প্রথা। প্রথার নিয়ম অনুযায়ী সূর্যের সামনে উন্মুক্ত অবস্থায় জলে দাঁড়িয়ে থাকাকালীন দেহে সৌর তড়িৎ প্রবাহিত হয়ে থাকে, যা দেহে প্রবেশ করে দেহের কর্ম ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
আবার অন্যদিকে দেখা যায় যে, দেহ থেকে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস দূর করতে এই প্রথাটি ভীষণভাবে কার্যকরী। আসন্ন শীতের প্রকোপকে মোকাবেলা করার জন্য দেহকে তৈরি করে দেয়। এই ছট পূজার প্রথা ও ব্রত কিছু পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে ছট পূজা সর্বাধিক পরিবেশবান্ধব অথবা ইকো ফ্রেন্ডলি একটি ব্রত বলা যেতে পারে।
ব্রত পালন করার শেষ দিনে গঙ্গাঘাটে গিয়ে উদয় হওয়া সূর্যকে পবিত্র চিত্তে অর্ঘ্য প্রদান করার পর উপবাস ভঙ্গ করে ক্ষীর, মিষ্টান্ন, ঠেকুয়া, নাড়ু এবং আঁখ, কলা, মিষ্টি লেবু প্রভৃতি ফল দিয়ে উপবাস ভঙ্গ করতে হয় এবং পরিচিত সকলকে সেই প্রসাদ বিতরণ করতে হয়।
টানা ছত্রিশ (৩৬) ঘন্টার কঠোর উপবাস পালন করার মধ্য দিয়ে সূর্যের উপাসনা করা হয় যেমন, তেমনি শরীরের অনেক উপকার সাধন হয়ে থাকে এই ছট পূজার মধ্যে দিয়ে। অনেকেই এই পূজার ব্রত পালন করার জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন এবং এর জন্য বিশেষ ভাবে প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। শুধুমাত্র বাড়ির মহিলারাই নন, বাড়ির আরো অন্যান্য সদস্যরাও এই পূজাতে ভীষণ ভাবে আনন্দ উপভোগ করেন এবং পূজার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করে থাকেন।