(Tarapith Shakti Peeth in Bengali) তারাপীঠ শক্তিপীঠের বর্তমান অবস্থান কোন স্থানে? দেবী সতীর কোন অঙ্গ এখানে পতিত হয়েছে? তারাপীঠ শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী কি? কিভাবে আরাধনা করা হয়? এই মন্দিরের তাৎপর্য কি? জানুন সবকিছু বিস্তারিত।
কাহিনী অনুসারে আমরা সকলেই জানি যে, সতী যখন মহাদেবের অপমান সহ্য করতে না পেরে দক্ষযজ্ঞে নিজের প্রাণ ত্যাগ দিয়েছিলেন, তখন মহাদেব সতীর সেই মৃতদেহ কাঁধে করে নিয়ে তান্ডব নৃত্য শুরু করেন।
তারপরে পৃথিবীতে সৃষ্টি হয় মহাপ্রলয়। এমন ক্ষেত্রে পৃথিবীকে ধ্বংস হওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য আর মহাদেবকে শান্ত করার জন্য বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে দেবীর দেহকে খন্ড-বিখন্ড করে ৫১ টি খন্ডে বিভক্ত করে দেন।
সেই সমস্ত দেহ খণ্ড গুলি পৃথিবীর বুকে যে যে জায়গায় পতিত হয়েছিল সেখানে সেখানে গড়ে উঠেছে এক একটি সতীপীঠ অথবা শক্তি পীঠ। তবে তারামন্দির নামে একটি তীর্থস্থান রয়েছে যা কিনা সবার কাছে তারাপীঠ নামে প্রসিদ্ধ। আবার অনেকে তারামন্দির নামে ও চেনেন। সেখানে দেবী সতীর পূজা-অর্চনা করা হয়।
সতীর পীঠস্থান গুলির মধ্যে তারাপীঠ হল একটি সিদ্ধপীঠ অর্থাৎ এখানে সাধনা করলে সাধকগন জ্ঞান অর্জন করেন, আনন্দ ও সিদ্ধি লাভ করেন অথবা অলৌকিক ক্ষমতা প্রাপ্ত হন। লোক মুখে প্রচারিত অপর একটি কাহিনী অনুসারে জানা যায়, বশিষ্ট এখানে তারা দেবীর সাধনা করেছিলেন।
তারাপীঠ শক্তিপীঠ:
শক্তিপীঠের নাম | তারাপীঠ শক্তিপীঠ |
স্থান | তারা মন্দির, তারাপীঠ), দ্বারকা নদীর তীরে, রামপুরহাট শহর হতে ৬ কি.মি দূরে, বীরভূম, পশ্চিমবঙ্গ |
দেশ | ভারত |
দেবীর অংশ | তৃতীয় চক্ষু (নয়ন তারা) |
শক্তির নাম | উগ্রতারা |
তারাপীঠ শক্তিপীঠের অবস্থান:
তারাপীঠ পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার রামপুরহাট শহরের কাছে অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র মন্দির নগরী। এই শহর তান্ত্রিক দেবী তারার মন্দির ও মন্দির সংলগ্ন শশান ক্ষেত্রের জন্য বিখ্যাত। হিন্দুদের বিশ্বাস অনুসারে এই মন্দির ও শ্মশান একটি পবিত্র তীর্থক্ষেত্র।
এই স্থানটির নাম ও এখনকার ঐতিহ্যবাহী তারা আরাধনার সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে যুক্ত। এছাড়া বলা যায় যে, তারাপীঠ “পাগলা সন্ন্যাসী” বামাক্ষ্যাপার জন্যও প্রসিদ্ধ। বামাক্ষ্যাপা এই মন্দিরে পূজা করতেন, তার পাশাপাশি মন্দির সংলগ্ন শশান ক্ষেত্রে কৈলাসপতি বাবা নামে এক তান্ত্রিকের কাছে তন্ত্র সাধনা করতেন।
বামাক্ষ্যাপা তারা দেবীর পূজাতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। মন্দিরের খুব কাছাকাছি আটলা গ্রামে তার আশ্রম ছিল, আর তা এখনো পর্যন্ত অবস্থিত। তারাপীঠ দ্বারোকা নদীর তীরে অবস্থিত, প্লাবন সমভূমির সবুজ ধান খেতের মধ্যে এই তীর্থস্থান টি দাঁড়িয়ে রয়েছে।
জেলা রামপুরহাট মহাকুমার সদর রামপুর হাট শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে তারাপীঠ তীর্থস্থান। রামপুরহাট ও চাঁদপাড়ার তারাপীঠ রোড রেল স্টেশন দুটি তারাপীঠের খুব কাছাকাছি দুটি স্টেশন। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে জানা যায় সতীর তৃতীয় নয়ন অথবা নয়ন তারা তারাপুর বা তারাপীঠ গ্রামে পড়ে এবং সেটি প্রস্তরীভূত হয়ে যায়।
পরবর্তীতে ঋষি বশিষ্ট প্রথম এই রূপটি দেখতে পান এবং সতীকে তারা রূপে পূজা করতে থাকেন। চোখের মনি অথবা চোখের তারা থেকে এই স্থানের দেবীর নাম হয়েছে মাতারা আর তীর্থ স্থানের নাম হয়েছে তারাপীঠ।
দেবী ও ভৈরব:
৫১ টি শক্তি পীঠের মধ্যে অনেকেই এই তারাপীঠকে সতী দেবীর অন্যতম একটি পিঠ হিসেবে ধরে থাকেন। যদিও অনেকের মতে সেটা ঠিক নয় অর্থাৎ এটি একটি সতীপীঠ নয়, একটি সিদ্ধ পীঠ।
এই পীঠের ভৈরব অর্থাৎ পীঠ রক্ষক হলেন শিব যিনি এখানে চন্দ্রচূড় হিসেবে পূজিত হয়ে থাকেন আর দেবী হলেন উগ্রতারা।
“কৌশিকী অমাবস্যা” তারাপীঠে পালিত হওয়া উৎসব গুলির মধ্যে অনেক বেশি উল্লেখযোগ্য বলা যায়। এই তীর্থস্থান হিন্দুদের পবিত্র তীর্থক্ষেত্র, তার পাশাপাশি বাঙ্গালীদের প্রিয় ভ্রমণের জায়গা গুলোর মধ্যেও এটি বেশ জনপ্রিয়।
তারাপীঠ মন্দির এর ইতিহাস:
প্রতিটি তীর্থ স্থানের পিছনে থাকে অনেক ইতিহাস, তেমনি এই তারাপীঠ অথবা সিদ্ধ পীঠ এর ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। লোকশ্রুতি অর্থাৎ লোকের মুখে শোনা কথা থেকে জানা যায় যে, আজ থেকে প্রায় ৫০০ থেকে ৭০০ বছর আগে দ্বারকা নদী পার হয়ে জয় দত্ত নামে এক বানিক বাণিজ্য করতে যাচ্ছিলেন।
আর সেই সময় সন্ধ্যা হয়ে আসলে মাঝিরা একটি ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে দিয়ে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেটি ছিল তারাপীঠের শ্মশান সংলগ্ন একটি ঘাট। রাতের বেলা বৃদ্ধার বেশ ধরে বণিক জয় দত্তের কাছে স্বয়ং মা তারা ভিক্ষা চাইতে আসেন। কিন্তু জয় দত্ত বৃদ্ধাকে ভিক্ষা না দিয়ে খুবই খারাপ ভাবে অপমান করে তাড়িয়ে দেন।
এরপর ওই রাতে জয় দত্তের একমাত্র ছেলেকে সাপে কামড়ায়, মৃত ছেলেকে ভেলায় ভাসিয়ে প্রাণ ত্যাগ করে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছিলেন তার কাছে ছেলে হারিয়ে আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোন পথ ছিল না।
এমন ক্ষেত্রে পরের দিন মাঝিরা যাত্রার আগে রান্না করার জন্য মাছ কিনেছিলেন। সেটি কেটে ধোয়ার জন্য সামনের অমৃতকুম্ভের জলাধারে নিয়ে গেলে কাটা মাছটি জ্যান্ত হয়ে যায়। বণিক জয় দত্ত ভাবলেন, কাটা মাছ যদি জ্যান্ত হতে পারে, তাহলে তার মরা ছেলেও কেন বেঁচে উঠতে পারবে না !
তারপর তিনি ওই অমৃত কুন্ডের জল মরা ছেলেকে খাওয়ালেন। সে আবার জীবিত হয়ে ওঠে, এই ঘটনায় হতবাক সবাই তাদের যাত্রা বন্ধ রাখেন আর ওই রাত্রে মা তারা জয়দত্ত কে স্বপ্ন দিয়ে বলেন,
“তুই যেখানে অবস্থান করছিস, সেটি হলো মোক্ষতীর্থ তারাপীঠ এখানে শ্বেত শিমুল গাছের গোড়ায় আমি শিলা মূর্তি আকারে রয়েছি। তুই আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করে প্রতিষ্ঠা কর। আর আমার সাথে চন্দ্রচূড় মহাদেবের পূজার ব্যবস্থা করে দিবি”।
স্বপ্নে পাওয়া মায়ের আদেশ অনুসারে শিমুল গাছের পাশে শ্মশানের মধ্যে বণিক জয়দেব একটি ছোট্ট মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন ও তারা মা এবং চন্দ্রচূড় মহাদেবের পূজার ব্যবস্থা করেন। তবে বন্যায় এই মন্দিরটি ধ্বংস হয়ে যায়। কেননা অনেকদিন আগের মন্দির ছিল এটা।
তারাপীঠ মন্দিরের নির্মাণ:
বর্তমানে যে তারাপীঠ মন্দির রয়েছে বা তৈরি করা হয়েছে সেটি হল ১২২৫ বঙ্গাতে। এই তারাপীঠ টি কেন্দ্র করে রয়েছে অসংখ্য কাহিনী।
এরপর ১২৪৪ সনের ১২ ই ফাল্গুন তারাপীঠে জন্মালেন সেই সাধক বামাক্ষ্যাপা। তিনি তারাপীঠে নানা ঘটনার সৃষ্টি করেছিলেন। মায়ের মন্দির আর তারাপীঠ শ্মশানের মধ্যে বামা ক্ষ্যাপার জীবন কেটে গেছে।
তারাপীঠ মন্দির এবং মায়ের রূপ:
তারাপীঠের তারা মায়ের এই মন্দিরটি উত্তরমুখী, এই মন্দিরের স্থাপত্য খুবই সাধারণ ভাবে তৈরি করা হয়েছে এবং গ্রাম বাংলার স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। মন্দিরটি চারচালার ধাঁজে নির্মাণ করা হয়েছে। এর চারটি কোনে চারটি চূড়া রয়েছে।
মা তারার আসল যে পাথরের মূর্তি রয়েছে সেটি তিন ফুট উঁচু একটি ধাতব মূর্তির মধ্যে রাখা আছে। এই আসল পাথরের মূর্তিটির ছবি হলো, শিশু শিবকে তারামা স্তন্যপান করাচ্ছেন। এটি মা তারার আসল মূর্তি। আবার দর্শনার্থীরা মায়ের ধাতব মূর্তিতেই দর্শন করে থাকেন।
এই ধাতব মূর্তির রূপটি হল এখানে দেবী চতুর্ভূজা, এলোকেশী, কপালে রয়েছে সিঁদুর একেবারে লেপা, লাল জিহ্বা, পরনে রয়েছে টুকটুকে লাল রঙের শাড়ি, আর মাথায় রয়েছে রুপার মুকুট।
বিগ্রহের নিচে রাখা থাকে দুটি রুপার পাদ পদ্ম, যে জায়গায় ভক্ত তাদের মনের ইচ্ছা জানিয়ে মা তারার কাছে পূজা দিয়ে থাকেন। এই মূর্তির ছবি অনেকের ঘরে তারামা রূপে পুজিতা হয়।
তারাপীঠে উৎসব:
আমরা আগেই জেনেছি যে, তারাপীঠে উৎসবগুলির মধ্যে “কৌশিকী অমাবস্যা” খুবই উল্লেখযোগ্য। এই কৌশিকি অমাবস্যায় দশমহাবিদ্যার দ্বিতীয় মহাবিদ্যা তারা দেবীকে মহাকালী রূপে পূজা করা হয়। বলা হয় যে, এই দিন সাধক বামাক্ষ্যাপা তারা মায়ের দর্শন পেয়ে সিদ্ধি লাভ করেছিলেন।
আর সেই অনুসারে ভক্তরা মনে করেন যে, এই দিন পূজা দিলে তাদেরও সকল মনস্কামনা পূর্ণ হবে এবং সিদ্ধি লাভ হবে। এই দিন তারাপীঠ শ্মশানে তান্ত্রিকদের ভিড়ও চোখে পড়ার মতো। এর পাশাপাশি বিভিন্ন জেলা থেকে, এমন কি দূর দূরান্ত থেকেও অনেকেই আসেন এখানে তীর্থ ভ্রমণ করতে।
সবদিক থেকে দেখতে গেলে দেখা যায় যে, তারাপীঠ হিন্দু ধর্মাবলম্বী দের কাছে একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ সতী পীঠও বলা যেতে পারে আবার সিদ্ধ পীঠ ও বলা যেতে পারে। যেখানে মনস্কামনা পূরণ করার পাশাপাশি একটু মনের শান্তি খুঁজে পাওয়ার জন্য ছুটে আসেন হাজার হাজার পুর্নার্থী ও ভক্তগণ।