(Varanasi Shakti Peeth in Bengali) বারাণসী শক্তিপীঠের বর্তমান অবস্থান কোন স্থানে? দেবী সতীর কোন অঙ্গ এখানে পতিত হয়েছে? বারাণসী শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী কি? কিভাবে আরাধনা করা হয়? এই মন্দিরের তাৎপর্য কি? জানুন সবকিছু বিস্তারিত।
সতী দেবী যখন বাবার অমতে গিয়ে মহাদেবকে বিবাহ করেন তখন দক্ষ রাজা অর্থাৎ সতী দেবীর বাবা খুবই রেগে যান। আর সতী দেবীর সামনে মহাদেবকে খুবই অপমান করতে থাকেন। স্বামীর এমন অপমান সহ্য করতে না পেরে সতী বাপের বাড়িতেই প্রাণ ত্যাগ করেন।
তারপর এমন খবরে মহাদেব পাগল হয়ে গিয়ে দেবীর সেই মৃতদেহ কাঁধে করে তুলে নিয়ে তান্ডব নৃত্য শুরু করেন। সেই তান্ডব নৃত্য তে পৃথিবীতে ঘটে মহাপ্রলয়, যার ফলে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হয়।
এমন পরিস্থিতিতে বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে দেবীর দেহকে খন্ড খন্ড করে ৫১ টি খন্ডে বিভক্ত করে ছড়িয়ে দেন। দেবীর সেই দেহ অংশ গুলি পৃথিবীর বুকে যে সমস্ত জায়গায় পতিত হয়েছিল, সেখানে সেখানে দেবীর দেহ অংশ গুলি সাথে সাথে প্রস্তর খণ্ডে পরিণত হয়। তারপর পরবর্তীতে সেই জায়গা গুলিতে গড়ে ওঠে এক একটি শক্তিপীঠ অথবা সতী পীঠ।
বারাণসী শক্তিপীঠ:
শক্তিপীঠের নাম | বারাণসী শক্তিপীঠ |
স্থান | বারাণসী, গঙ্গাতীরে মনিকর্ণিকা ঘাট, কাশী, উত্তর প্রদেশ |
দেশ | ভারত |
দেবীর অংশ | কানের দুল |
শক্তির নাম | বিশালাক্ষী বা মণিকর্ণী |
বারাণসী শক্তিপীঠের ভৌগোলিক গুরুত্ব:
বারাণসী হলো ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের বারাণসী জেলার একটি শহর, শহরটি স্থানীয় ভাবে বেনারস নামে এবং বাঙ্গালীদের কাছে কাশি নামে বেশি পরিচিত। শহরটি গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। উত্তরপ্রদেশের রাজধানীর লখনৌ শহরের থেকে এই শহরের দূরত্ব প্রায় ৩২০ কিলোমিটার অর্থাৎ ২০০ মাইল বলা যায়। হিন্দু ধর্মের সাতটি পবিত্রতম শহরের মধ্যে একটি হলো এই বারাণসী।
শুধুমাত্র তাই নয়, বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশের ক্ষেত্রেও বারাণসী শহরের ভূমিকা রয়েছে অনেক খানি। এছাড়াও হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন যে, বারাণসীতে মৃত্যু হলে মৃত ব্যক্তি সাক্ষাৎ মোক্ষ লাভ করেন, বারাণসী ভারত তথা বিশ্বের প্রাচীনতম শহরগুলির মধ্যে একটি অন্যতম শহর।
কাশি হল একটি মহা পুণ্যময় হিন্দু পীঠ স্থান। প্রায় সবকটি পুরাণে এই নগরের মাহাত্ম্য উল্লেখ রয়েছে। এই নগরী শতাব্দী কাল ধরে ভারত তথা সনাতন হিন্দু ধর্মের পিঠস্থান। কথায় বলা হয় যে, কাশি নগর এই ভগবান শিবের ত্রিশূলের উপরে অবস্থিত। পীঠ স্থান মহা পূর্ণস্থান বলা যায়, বাঙালি হিন্দুদের সাথে এই নগরের রক্তের টান রয়েছে। বহু বাঙালি রাজা জমিদার এই নগরীতে নানান মন্দির, যাত্রী নিমাস, সড়ক নির্মাণ করেছেন।
এছাড়াও বলা হয় যে, কাশিতে মৃত্যুবরণ করলে তার আর পুনর্জন্ম হয় না, স্বর্গ লাভ হয়ে যায়। বহু সাধু, সন্ত, সাধক, সিদ্ধ মহাপুরুষ, মহাত্মার বসবাস এখানে। তাঁরা এখানে এসে সাধনা করেছেন আর সিদ্ধ লাভ করেছেন। শিব এবং মহাকালী উপাসক অঘোরী সাধুদের বাসস্থান এখানে। কাহিনী অনুসারে কাশিতে অর্থাৎ বারাণসী শক্তি পীঠে দেবীর কানের দুল পতিত হয়েছিল।
দেবী ও ভৈরব:
এই মন্দিরে দেবীর নাম বিশালাক্ষী অথবা মনিকর্নি আর দেবীর ভৈরব হলেন কালভৈরব অথবা মহাকাল।
শিবপুরাণ মতে এটি একটি উপ পীঠ, কেননা এখানে দেবীর কোন দেহের অংশ পড়েনি, দেবীর গহনা অথবা অলংকার পড়েছিল। দেবী হলেন অন্নপূর্ণা আর ভৈরব হলেন বিশ্বনাথ।
মনিকর্নিকার ঘাট:
বারানসের কাশিতে মনিকর্নিকার ঘাট অত্যন্ত পুণ্যস্থান বলে মনে করা হয়। আর জানা যায় যে, এখানে ভগবান বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে একটি পুষ্করিণী খনন করেছিলেন। তিনি সেখানে বসে হর গৌরীর তপস্যা করেন। সেই সময় ভগবান বিষ্ণুর শরীর থেকে ঘাম নির্গত হয়ে এই পুষ্করিণী টি জলে পূর্ণ হয়।
সন্তুষ্ট হয়ে হর গৌরী যখন দেখা দিলেন, সেই সময় মা গৌরীর কানের দুল এই জলে পতিত হয়েছিল। আর সেই থেকে এই স্থানের নাম মনিকর্নিকা, পরবর্তীতে এই জলাশয় গঙ্গাতে মিলিত হয়। যেহেতু আমরা আগেই জানলাম যে, এই কাশীধাম মহাদেবের ত্রিশূলে অবস্থিত, তাই এই স্থান কোন রাজার রাজত্বের মধ্যে পড়ে না।
একটি কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, কাশির মহা শ্মশানে হরিশচন্দ্র নিজের নিহত পুত্র রোহিতের সাথে সাথে নিজের স্ত্রী শৈব্বার দেখা হয়। ভগবান শিবের কৃপায় রাজকুমার রোহিত বেঁচে ওঠে, রাজা রাজত্ব ফিরে পান। যুগ যুগ ধরে নানান হিন্দু কাহিনীতে পরিপূর্ণ কাশীধামের এই জায়গা।
বারানসীর কাশিধামে যে ব্যক্তি মারা যান তিনি স্বর্গ লাভ করেন বলে জানা যায়। সেই সময় শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব রানী রাসমনির জামাই মধুরা নাথ বাবুর সাথে কাশিতে এসেছিলেন। তিনি মথুরা নাথ বাবুর সাথে নৌকাতে মনিকর্নিকা ঘাটের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় শ্মশানের ধোঁয়া দেখে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
কথায় আছে যে, কাশি নগরীতে কখনোই কেউ অভুক্ত থাকেন না, অর্থাৎ কাশীনগরী হল মা অন্নপূর্ণার ক্ষেত্র, মা অন্নপূর্ণা সকলকে অন্ন বিতরণ করেন। অন্যদামঙ্গল কাব্য অনুযায়ী ভগবান শিবের নির্দেশে দেব শিল্পী বিশ্বকর্মা এখানে অন্নপূর্ণা মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।
এছাড়াও এই শক্তি পীঠ বারাণসী কাশিধাম হলো মহা পুণ্যময় ক্ষেত্র। সাধক তৈলঙ্গ স্বামী এই কাশীধামে গঙ্গার ঘাটে থাকতেন, মহাপুরুষ তৈলঙ্গ স্বামীর কৃপায় অনেক ভক্ত সার্থক হতেন। লোকনাথ বাবা ও তার বাল্যবন্ধু বেণীমাধব এই স্থানে এসে তৈলঙ্গ স্বামীর সাথে দেখা করেন। আর লোকনাথ ব্রহ্মচারীর গুরুদেব ভগবান গাঙ্গুলী দেহত্যাগের পূর্বে লোকনাথ ও বেণীমাধব কে এই স্থানে নিয়ে এসেছিলেন। এছাড়াও মহাসাধক বামদেবও এই জায়গায় এসেছিলেন।
এই শক্তি পীঠের পাশাপাশি আশেপাশের পরিবেশ আপনাকে মুগ্ধ করবেই। এখানে যতই ভক্ত গনের সমাবেশ ঘটুক না কেন, কখনোই কেউ অভুক্ত অবস্থায় থাকে নি। কেননা এখানে বিরাজ করছেন অন্নপূর্ণা দেবী। তিনি সকলকে অন্ন প্রদান করেন।
এখানে উৎসব অনুযায়ী বহু ভক্ত এবং পূর্ণ্যার্থী দের সমাগম ঘটে। এছাড়া কাশিতে তীর্থস্থান ঘুরতে প্রতিবছর বহু মানুষের সমাগম দেখা যায়। পুণ্য অর্জনের আশায় এবং মোক্ষ লাভের আশায় এই শক্তি পীঠ, তীর্থ স্থানে বহু মানুষের আনাগোনা চলে সারা বছর ধরে।