কন্যাকুমারী শক্তিপীঠ: যে স্থানে সতীর পীঠ পতিত হয়েছিল, পৌরাণিক কাহিনী জানুন

(Kanyakumari Shakti Peeth in Bengali) কন্যাকুমারী শক্তিপীঠের বর্তমান অবস্থান কোন স্থানে? দেবী সতীর কোন অঙ্গ এখানে পতিত হয়েছে? কন্যাকুমারী শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী কি? কিভাবে আরাধনা করা হয়? এই মন্দিরের তাৎপর্য কি? জানুন সবকিছু বিস্তারিত।

সতীর প্রাণহীন দেহ নিয়ে যখন মহাদেব তাণ্ডব লীলায় মত্ত ছিলেন সেই সময় পৃথিবীতে শুরু হয়েছিল মহাপ্রলয়। সেই প্রলয়ে পৃথিবী ধ্বংস হয়েই যেত। তাই কোন উপায় না দেখে বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে দেবীর দেহকে খন্ড-বিখন্ড করে দেন।

Kanyakumari Shakti Peeth in Bengali - কন্যাকুমারী শক্তিপীঠ
Kanyakumari Shakti Peeth in Bengali – কন্যাকুমারী শক্তিপীঠ

যাতে মহাদেব শান্ত হতে পারে। এমন ভাবে দেবীর দেহ খন্ড-বিখন্ড হয়ে ৫১ টি ভাগে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর বুকে। আর সেখানে সেখানে গড়ে ওঠে এক একটি পবিত্র তীর্থস্থান, শক্তিপীঠ অথবা সতীপীঠ

কন্যাকুমারী শক্তিপীঠ:

শক্তিপীঠের নাম কন্যাকুমারী শক্তিপীঠ
স্থান কন্যাশ্রম, কন্যাকুমারী, শ্রী কন্যা কুমারী ভগবতী আম্মান মন্দির, কুমারী মন্দির, তামিলনাড়ু
দেশ ভারত
দেবীর অংশ পীঠ
শক্তির নাম সর্বাণী

কন্যাকুমারী শক্তি পীঠের ভৌগলিক গুরুত্ব:

কন্যাকুমারী শক্তি পীঠ অথবা কন্যাকুমারী মন্দিরটি ভারতের মূল বিভাগের দক্ষিণতম প্রান্তে তামিলনাড়ু রাজ্যের অন্তর্গত কন্যাকুমারীতে অবস্থিত।

সতীর ৫১ টি পীঠের মধ্যে একটি অন্যতম শক্তি পীঠ অথবা সতীপিঠ অনুসারে এখানে সতীর মেরুদন্ড অথবা পীঠ পড়েছিল। এখানে প্রতিষ্ঠিত দেবী সর্বাণী এবং ভৈরব হলেন নিমিষ।

কন্যাকুমারী শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী:

পৌরাণিক কাহিনী শুনতে খুবই আকর্ষণীয় লাগে, তাই না ! তেমনি এই কন্যাকুমারী শক্তি পীঠ এর পৌরাণিক কাহিনী সম্বন্ধে জানতে গেলে জানা যায় যে, অনেকদিন আগে বানসুর নামে এক অসুর শিবের তপস্যায় বর পেয়েছিলেন যে, একজন কুমারী মেয়ে কেবলমাত্রই তাকে বধ করতে পারবে, অথবা মারতে পারবে।

এমন বর পেয়ে সারা পৃথিবীতে ভীষণ অত্যাচার শুরু করতে লাগলো বনাসুর। তার সেই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে, দেবতারা কোনরকম উপায় না দেখে আদ্যা শক্তি মহামায়া কে কুমারী মেয়ের রূপে জন্ম নিয়ে বানাসুরকে হত্যা করার জন্য অনুরোধ করলেন। তখন মা মহামায়া একটি কুমারী মেয়ের রূপে পৃথিবীতে জন্ম নেন।

পরবর্তী তে সময়ের সাথে সাথে সেই কুমারী মেয়ে বড় হতে থাকে, আর ভগবান শিব সেই কুমারী মেয়ের রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিবাহ করতে চান। ঠিক হয় সূর্যোদয় হওয়ার সময় তাদের বিবাহ হবে। নির্দিষ্ট দিনে শিব বর্তমান কন্যাকুমারীর কাছে সুচিন্দ্রাম নামে একটি জায়গা থেকে বিয়ের জন্য যাত্রা শুরু করলেন। আবার অন্যদিকে নারদ মুনি জানতেন যে, বানাসুরকে বধ করার জন্য দেবীর অবিবাহিত / কুমারী থাকাটা অনেকখানি জরুরী।

তাই তিনি একটি মোরগের রূপ ধারণ করলেন এবং ভোর হওয়ার আগেই চিৎকার করে ডেকে উঠলেন, সেই ডাক শুনে শিব বুঝলেন যে ভোর হয়ে গেছে। আর শুভ সময় পেরিয়ে গেছে। তাই তিনি নিরাশ হয়ে সেই কুমারী দেবীকে বিবাহ না করেই ফিরে এলেন। আবার অন্যদিকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও যখন দেবী দেখলেন যে শিব তাকে বিয়ে করতে এলেন না, তখন তিনি ভাবলেন শিব তাকে মিথ্যা কথা বলেছে।

তখন দেবী অসহ্য অপমান, যন্ত্রণা, শোক এবং রাগে পাগলের মত হয়ে উঠলেন এবং সামনে যা পেলেন তাই ধ্বংস করে দিলেন। সব খাবার দাবারও ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে লাগলেন। পরবর্তীতে মন যখন একটু শান্ত হল তখন তিনি সারাজীবনবিবাহিতা থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং গভীর তপস্যা শুরু করলেন।

এরপর কিছুদিন যেতেই বানাসুর সেই স্থানে গিয়ে তপস্যারত দেবী কুমারীকে দেখে তার রূপে এতটাই মুগ্ধ হয়ে যায় যে, তাকে বিয়ে করতে চায়। নিজের বরের কথা ভুলে গিয়ে দেবীর উপর জোর করতে গেল।

তখন দেবী নিজের আসল রূপ ধারণ করলেন এবং ভীষণ যুদ্ধের পর বানাসুর কে বধ করলেন। অসুর মারা যাওয়ার পর মহামায়া দেবী আবার তিনি নিজের পার্বতী রূপে ফিরে গেলেন, আর শিবের সঙ্গে মিলিত হলেন।

বলা হয় যে, এই স্থানে তিনি কুমারী রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন অর্থাৎ এই কন্যাকুমারী শক্তি পীঠে তিনি কুমারী রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। দেবীর ফেলে দেওয়া খাবার থেকেই কন্যাকুমারী সমুদ্রের তীরে নানা রঙের বালি সৃষ্টি হয়েছে। যা কিনা দেখতে অনেকখানি সুন্দর

কন্যাকুমারী শক্তিপীঠ:

কন্যাকুমারী শক্তিপীঠ অথবা এই সতীপীঠ টি ভারত মহাসাগরের উপরে একটি ছোট্ট দ্বীপে অবস্থিত। সাধারণত খুবই সুন্দরভাবে ছিমছাম ভাবে সাজানো মন্দিরের গম্বুজ টি আকারে অনেক বড় এবং লাল পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অল্প কিছু পরিবর্তন হলেও মূল মন্দিরের স্থাপত্যের বিশেষ কিছু পরিবর্তন হয়নি বললেই চলে। এছাড়াও বলা হয় যে, মন্দিরটি নাকি ৩,০০০ বছরেরও বেশি পুরানো মন্দির। মন্দিরের ভিতরে একটি কুয়া আছে, এই কুয়ার জলে দেবীকে স্নান করানো হয়।

কন্যাকুমারী শক্তি পীঠে দেবীর আরাধনা:

এই মন্দিরে দেবী সর্বানি নামে পূজিতা হন, স্থানীয় মানুষজন দের কাছে দেবীর নাম “কুমারী আম্মা” অথবা “ভগবতী আম্মা”। দেবী কুমারী কন্যা রুপি মূর্তি যা কিনা পূর্বমুখী, গলায় ফুলের মালা, মাথায় রয়েছে মুকুট, দেবীর হাতে একটি রুদ্রাক্ষের জপমালা থাকে।

এছাড়াও অলংকার হিসেবে দেবীর নাকে রয়েছে একটি হীরের নাক চাবি। যাতে এতটাই দ্যুতি ছড়ায় যে, যা অসাধারণ বললেই চলে। দেবীর নাকের ওই নাক চাবি নিয়েও অনেক কাহিনী রয়েছে।

চলুন তাহলে দেবীর নাক চাবির একটি কাহিনী একটু জানা যাক:

আগে তো সমুদ্রপথে নাবিকেরা বাণিজ্য করতে যেতেন বা তখন সমুদ্রপত্রই ছিল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তখন নাবিকেরা ভারত মহাসাগর দিয়ে জাহাজ নিয়ে যেতে যেতে সেই নাক চাবির দ্যুতি দেখে ভাবতো যে ওখানে কোন বাতিঘর আছে হয়তো। যাকে এখন লাইট হাউস বলে জানবেন। অনেকবার দুর্ঘটনা ঘটার পর মন্দিরের পূর্ব দিকের সমুদ্রমুখী দরজা বরাবরের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়।

অবশ্য বছরের নির্দিষ্ট কয়েকটা দিন খোলা থাকে, সেই দরজাটি এই জায়গায় দেবী সর্বাণী ছাড়াও গণেশ, সূর্যদেব, ভগবান আয়াপ্পা স্বামী, দেবী বালা সুন্দরী এবং দেবী বিজয়া সুন্দরীর পূজা করা হয়। তবে প্রতিটি শক্তি পীঠে দেবী এবং ভৈরব অধিষ্ঠিত থাকেন। এখানে দেবী হলেন সতীর রূপ আর ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী। কন্যাকুমারী শক্তি পীঠে দেবীর নাম সর্বানি এবং ভৈরব হলেন নিমিষ।

কন্যাকুমারী মন্দির অথবা শক্তিপীঠের নিয়ম ও রীতি:

প্রতিটি মন্দিরের কোন না কোন নিয়ম মেনে চলতে হয়, ভক্তগণদের জন্য এই নিয়ম অনেকখানি গুরুত্বপূর্ণ আর তেমনিভাবে কন্যাকুমারী শক্তিপীঠের ক্ষেত্রেও সেটাই প্রযোজ্য। মাতা সর্বাণীকে দর্শন করার জন্য দিনে একটা সময় বেঁধে দেওয়া হয়।

প্রতিদিন দেবী সর্বানিকে দর্শন করার জন্য ভোর সাড়ে চারটা (৪:৩০) থেকে দুপুর সাড়ে বারোটা (১২:৩০) পর্যন্ত সময় থাকে। এরপর মন্দির বন্ধ হয়ে যায়। আবার বিকেল চারটে (৪) থেকে রাত ৮:৩০ পর্যন্ত ভক্তেরা আবার দর্শন করতে পারবেন দেবীর।

এছাড়াও চৈত্র মাসের পূর্ণিমার দিন দেবীর বিশেষ পূজা হয়। বৈশাখ মাসে এখানে ১০ দিন ধরে দেবীর পূজা চলে, এই সময় দেবীকে প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যাবেলায় শোভাযাত্রায় নিয়ে যাওয়া হয়।

খুলে দেওয়া হয় মন্দিরের পূর্ব দিকের দরজাটাও। আবার উৎসবের নবম দিনে দেবীকে নৌকাতে করে সমুদ্রের জলে ঘোরানো হয়। আশ্বিন মাসের শারদীয়া পুজোর সময়ও এখানে ভক্তদের ভিড় একেবারে উপচে পড়ে।

সারা বছর ধরে এই জায়গায় ভক্তদের আর পুণ্যার্থীদের সমাগম তো চলেই, তার সাথে সাথে দেশের প্রতিটি কোণ থেকে এমন কি দেশের বাইরে থেকেও পর্যটক ও পূর্ণার্থীদের সমাগমে ভরে ওঠে কন্যাকুমারী শক্তিপীঠের মন্দির প্রাঙ্গণ।

চারিদিকে জল থৈ থৈ, মাঝখানে একটি ছোট্ট দ্বীপে অবস্থিত এই কন্যাকুমারী শক্তি পীঠ, সত্যিই মনোমুগ্ধকর। যেখানে যাওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকেন বহু পর্যটক, ভক্তগণ এবং পুণ্যার্থীরা। এছাড়া উৎসবের দিনগুলোতে এখানের পরিবেশ আরো বেশি সেজে ওঠে। স্থানীয় মানুষজনরা মেতে ওঠেন উৎসবে ও আনন্দে। আপনি যদি এমন কোন তীর্থস্থানে যাওয়ার ইচ্ছা রাখেন, তাহলে কন্যাকুমারী শক্তিপীঠ আপনার জন্য সেরা হতে পারে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top