নন্দীকেশ্বরী শক্তিপীঠ: যে স্থানে সতীর গলার হার (অলংকার) পতিত হয়েছিল

(Nandikeshwari Shakti Peeth in Bengali) নন্দীকেশ্বরী শক্তিপীঠের বর্তমান অবস্থান কোন স্থানে? দেবী সতীর কোন অঙ্গ এখানে পতিত হয়েছে? নন্দীকেশ্বরী শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী কি? কিভাবে আরাধনা করা হয়? এই মন্দিরের তাৎপর্য কি? জানুন সবকিছু বিস্তারিত।

সতী যখন বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের পছন্দমত এবং তপস্যায় পাওয়া মহাদেবকে বিবাহ করেছিলেন, সেই সময়ে সতীর বাবা দক্ষ রাজা খুবই রেগে গিয়েছিলেন। এরপর বাড়িতে অনুষ্ঠিত দক্ষযজ্ঞে তাদেরকে নিমন্ত্রিত না করে অপমান করেন।

এই কথা জানতে গিয়ে সতী নিজের বাপের বাড়িতে খুবই খারাপ ভাবে অপমানিত হন, তার সাথে সাথে মহাদেব কেও অপমান করা হয়। স্বামীর সেই অপমান সহ্য করতে না পেরে তিনি দক্ষযজ্ঞের অগ্নিকুণ্ডে নিজের জীবন ত্যাগ দেন। এই খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছাতেই তিনি সেই স্থানে তৎক্ষণাত গিয়ে হাজির হন।

Nandikeshwari Shakti Peeth in Bengali - নন্দীকেশ্বরী শক্তিপীঠ
Nandikeshwari Shakti Peeth in Bengali – নন্দীকেশ্বরী শক্তিপীঠ

তারপর দক্ষ রাজাকে বধ করে সতীর প্রাণহীন দেহ কাঁধে করে তুলে শুরু করেন এক তান্ডব নৃত্য। যার ফলে পৃথিবীতে সৃষ্টি হয় মহাপ্রলয়।

এমন মহাপ্রলয় যা পৃথিবীকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেবে, পৃথিবী কে বাঁচানোর জন্য আর মহাদেবকেও শান্ত করার জন্য বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে দেবীর দেহকে ৫১ টি খন্ডে বিভক্ত করে দেন।

দেবীর সেই ৫১ টি দেহ খন্ড যে যে জায়গায় পতিত হয়েছিল সেই সমস্ত জায়গায় গড়ে উঠেছে এক একটি সতীপীঠ অথবা শক্তিপীঠ। কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, নন্দীকেশ্বরী মন্দির যে স্থানে অবস্থিত সেই স্থানে সতীর গলার হার পড়েছিল অর্থাৎ গলার অলংকার (কন্ঠ হার) পড়েছিল।

নন্দীকেশ্বরী শক্তিপীঠ:

শক্তিপীঠের নাম নন্দীকেশ্বরী শক্তিপীঠ
স্থান নন্দীকেশ্বরী মন্দির, ময়ূরাক্ষী সরণি, সায়ন্তিয়া রেলওয়ে স্টেশনের পাশে, সাঁইথিয়া শহর, বীরভূম, পশ্চিমবঙ্গ
দেশ ভারত
দেবীর অংশ গলার হার (অলংকার)
শক্তির নাম নন্দিনী

নন্দীকেশ্বরী মন্দিরের ভৌগলিক গুরুত্ব:

৫১ টি শক্তি পীঠের মধ্যে নন্দী কেশরী মন্দির হলো একটি অন্যতম শক্তি পীঠ। এটির বীরভূম জেলার সাঁইথিয়া শহরের মধ্যভাগে অবস্থিত। বলা যেতে পারে সাঁইথিয়া রেলওয়ে স্টেশন থেকে খুবই কাছাকাছি।

এছাড়া মন্দির থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে ময়ূরাক্ষী নদী, আর এক কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে সাঁইথিয়া জংশন স্টেশন।

তবে জানা যায় যে সাঁইথিয়া জায়গাটি আগে নন্দীপুর নামে পরিচিত ছিল সবার কাছে। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে দেবী নন্দীকেশ্বরীর নাম অনুসারে এই শহরের নাম হয়েছিল নন্দীপুর।

নন্দীকেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাস:

কাহিনী অনুসারে এবং প্রচলিত লোককথা অনুসারে জানা যায়, সাধক বামাক্ষ্যাপা এই মন্দিরে পূজা দিয়ে সিদ্ধি লাভ করেন। বলা হয় যে, যখন তিনি মায়ের দেখা পাওয়ার জন্য তারাপীঠে সাধনা করছিলেন তখন মা তাকে স্বপ্নে দেখা দেন এবং বামাক্ষ্যাপা কে মা নন্দীকেশ্বরী স্বপ্ন দিয়ে বলেন যে, তার পূজা করতে, তারপরেই তিনি সিদ্ধি লাভ করতে পারবেন।

যেহেতু আমরা আগেই জেনেছি যে, প্রতিটি শক্তি পীঠ এমন এমন জায়গায় গড়ে উঠেছে অর্থাৎ এমন এমন জায়গাতে দেবীর দেহ অংশগুলি পতিত হয়েছিল, সেখানে ছিল গভীর ঘন জঙ্গল। এমনকি পাহাড় পর্বতের চূড়া এবং জন মানবহীন এলাকা।

আর সেই মতো এই নন্দীকেশ্বরী মন্দির টি যেখানে অবস্থিত সেটি আগে ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল এবং পাশে ছিল মহাশ্মশান। তার পাশ দিয়ে বয়ে যেত ময়ূরাক্ষী নদী। বনের মধ্যে বট গাছের নিচেই মায়ের অবস্থান ছিল। যদিও তখনও এই স্থান নন্দীকেশ্বরী সতীপীঠ রূপে পরিচিতি পায়নি সকলের কাছে।

নন্দীকেশ্বরী মন্দিরে দেবীর রূপ
নন্দীকেশ্বরী শক্তিপীঠ মন্দিরে দেবীর রূপ

এরপর স্বয়ং মা নন্দিকেশ্বরী দাতারাম ঘোষ নামে এক ব্যক্তিকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে মায়ের মন্দির নির্মাণ ও মায়ের পূজা প্রচারের আদেশ দিয়েছিলেন। এরপর থেকে এই মন্দির সতীপীঠ বলে পুজো পেতে শুরু করে। কেননা যেহেতু এখানে দেবীর অলংকার পতিত হয়েছিল তাই এটা কে অনেকেই উপপীঠও বলে থাকেন। দাতারাম ঘোষ ছিলেন সাঁইথিয়ার জমিদার পঞ্চানন ঘোষের পূর্বপুরুষ।

তিনি জন্মসূত্র তে ছিলেন দক্ষিণেশ্বরের বাসিন্দা, সাহেবদের কাজে তিনি যুক্ত ছিলেন এবং সেই সুত্রে সাঁইথিয়ায় যাতায়াত করতেন। যাওয়ার পথে ক্লান্ত হয়ে বটগাছের নিচে যখন তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন, তখনই তিনি মায়ের এই স্বপ্নটি দেখেছিলেন। তারপর মন্দির নির্মাণ করেন মায়ের আদেশ অনুসারে। এই শক্তিপীঠকে তন্ত্র চূড়ামণি গ্রন্থে মূলপীঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

নন্দীকেশ্বরী শক্তিপীঠ মন্দিরে দেবীর রূপ:

এই মন্দির গুলি পরবর্তীতে নির্মাণ করা হয়, ৮০ দশকের সাঁইথিয়া শহরের ব্যবসায়ীরা সতীপীঠ নন্দিশেশ্বরীর অনেক সংস্কার করে বর্তমান যে মন্দিরটি রয়েছে সেই মন্দিরটি গড়ে তুলেছেন।

একটি বিশাল বড় বটগাছ ছাতার মতো ঘিরে রেখেছে মন্দিরের প্রাঙ্গণকে। এখানে দেবী মূর্তি বলতে গেলে আছে শুধুমাত্র একটি পাথর। পাথরের গায়ে রয়েছে দেবীর তিনটি চোখ আর মাথায় রয়েছে মুকুট পরানো।

নন্দীকেশ্বরী শক্তিপীঠ মন্দির
নন্দীকেশ্বরী শক্তিপীঠ মন্দির

মুকুটটি রূপালী এবং তিনটি চোখ হলো সোনালী, যদিও মায়ের মূর্তিটি কাল পাথরের কিন্তু বর্তমানে এর রং প্রায় লাল বলাই যায়। কারণ ভক্তরা প্রার্থনার জন্য পাথরের গায়ে সিঁদুর দিয়ে থাকেন আর তার ফলে দিন বদলের সাথে সাথে পাথরটি সম্পূর্ণ লাল আকার ধারণ করেছে।

প্রত্যেকটি সতীপীঠ অথবা শক্তি পীঠে দেবী এবং ভৈরবের অধিষ্ঠান থাকে, তা তো আমরা সকলেই জানি। দেবী হলেন সতীর রূপ, ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী। সেই অনুযায়ী এই মন্দিরে দেবীর নাম নন্দিনী অথবা নন্দিকেশ্বরী আর ভৈরবের নাম হলো নন্দিকেশ্বর।

নন্দীকেশ্বরী শক্তিপীঠে যাত্রীনিবাস:

প্রতিটি শক্তি পীঠে দূর দূরান্তর থেকে ভক্তগণ দের আনাগোনা থাকে। তাই সে দিকটা বিবেচনা করে অনেক শক্তি পীঠে তাদের থাকার জন্য এবং অনেক সুযোগ-সুবিধা করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

তেমনি এই শক্তিপীঠ অর্থাৎ নন্দীকেশ্বরী মন্দিরে স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে থাকার ব্যবস্থা তো থাকবেই না, তবে দূর দূরান্ত থেকে যারা আসবেন এই মন্দিরে তাদের জন্য বালানন্দ যাত্রী নিবাস” রয়েছে। স্টেশনের কাছেও অনেক ঘর পাওয়া যায়।

আর একটা কথা এখানে উল্লেখ করে রাখা জরুরি যে, স্টেশন থেকে মন্দির পর্যন্ত কিন্তু পায়ে হাটা পথ, তবে ঘর বুকিং এর আগে ভালো করে খোঁজ নেওয়া ভালো। কেননা বেশ কিছু হোটেল অথবা ঘর খুবই অপরিষ্কার থাকে, তাই সেখানে গিয়ে আপনি তীর্থস্থান ভ্রমণের মতো পরিবেশ নাও পেতে পারেন। তাই আগে থেকে ঘর ভালো করে যাচাই করে নেবেন।

মন্দিরে পূজা দিতে পারেন আপনি সারা বছরই। এছাড়া এখানে পূজার প্রসাদ হিসেবে কলা আর বাতাসা খুবই পরিচিত। দেবীর মন্দির এবং ভৈরবের মন্দির ছাড়াও আরো অনেক দেব দেবীদের মন্দির রয়েছে এই স্থানে।

যেমন ধরুন, মহালক্ষ্মী, বিষ্ণু লক্ষ্মী, মহা সরস্বতী, হনুমান মন্দির, জগন্নাথ দেবের মন্দির প্রভৃতি মন্দির গুলি আপনি ঘুরে দেখতে পারেন নন্দীকেশ্বরী মন্দিরে মায়ের পূজা দেওয়ার পাশাপাশি।

নন্দীকেশ্বরী শক্তিপীঠে অনান্য মন্দির
নন্দীকেশ্বরী শক্তিপীঠে অনান্য মন্দির

কেননা এই সমস্ত মন্দির ভ্রমণ করতে আপনার বেশ ভালোই লাগবে। আশেপাশের পরিবেশ আপনাকে মুগ্ধ তো করবেই, তার পাশাপাশি এখানকার আবহাওয়া আপনাকে অনেকখানি চিন্তা মুক্ত করতে পারে। বিশাল বড় বট গাছটিতে ভক্তরা তাদের ইচ্ছা পূরণের জন্য লাল আর হলুদ সুতো বেঁধে থাকেন।

নন্দীকেশ্বরী মন্দিরের পূজা-অর্চনা:

সারা বছর ধরে এখানে তো পূজা অর্চনা চলেই। সেই কারণে অনেক দূর দূর থেকে মানুষজন এখানে এসে ভিড় জমান। মন্দির টি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খোলা থাকে।

রথযাত্রা এবং বিপত্তারিণী পুজোর সময় এই মন্দিরে ১০,০০০ থেকে ১৫ হাজার ভক্তের সমাগম হয়ে থাকে মন্দির প্রাঙ্গণে এছাড়া দুর্গাপূজা, কালী পুজোতে ও মায়ের বিশেষ পুজোর ব্যবস্থা করা হয় এই শক্তি পীঠে।

আমরা যেটা আগে জানলাম, সেটা হল এই মন্দির যখন প্রতিষ্ঠা হয়নি বা এখানে যে দেবীর একটি দেহ অংশ পড়েছে সেটা যখন কারোর লক্ষ্যে আসেনি, তখন এই জায়গাটি সম্পূর্ণ ঘন নির্জন জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল।

যখন দেবীর এই শক্তি পীঠের আবিষ্কার হয় তখন মন্দির প্রাঙ্গণ তৈরি করার জন্য আশেপাশের কিছুটা জঙ্গল পরিষ্কার করা গেলেও দূর দূরান্তর আপনি শুধুমাত্র ঘন জঙ্গলে ঢাকা জায়গাই দেখতে পাবেন। যেখানে সূর্যের আলোটুকু পর্যন্ত খুব কষ্টে শিষ্টে প্রবেশ করে।

আর বুঝতেই পারছেন যে এমন একটা পরিবেশে এমন তীর্থযাত্রা আপনার জন্য কতটা রোমাঞ্চকর হতে পারে !  এছাড়া পুণ্য অর্জনের জন্য, ধ্যান সাধনার জন্য অনেকেই এমন নির্জন জায়গা পছন্দও করবেন। আশেপাশের আরও সব মন্দির গুলির পাশাপাশি এই শক্তি পীঠে গিয়ে আপনি কয়েকদিন কাটিয়ে আসতেই পারেন।

তাছাড়া দূর থেকে যাওয়া ভক্তগণদের জন্য থাকার ব্যবস্থা তো রয়েছে এখানে। বিশেষ বিশেষ উৎসব গুলিতে মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে শুরু করে আশেপাশের পরিবেশ খুবই সুন্দরভাবে সেজে ওঠে।

আর স্থানীয় মানুষজন খুবই আনন্দ উপভোগ করে থাকেন এখানে, আপনিও যদি এই আনন্দের ভাগ নিতে চান এমন বিশেষ উৎসবে এখানে গিয়ে হাজির হতে পারেন।

1 thought on “নন্দীকেশ্বরী শক্তিপীঠ: যে স্থানে সতীর গলার হার (অলংকার) পতিত হয়েছিল”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top