হিংলাজ শক্তিপীঠ: যে স্থানে সতীর ব্রহ্মরন্ধ (মস্তিষ্কের অংশ) পতিত হয়েছিল

(Hinglaj Shakti Peeth in Bengali) হিংলাজ শক্তিপীঠের বর্তমান অবস্থান কোন স্থানে? দেবী সতীর কোন অঙ্গ এখানে পতিত হয়েছে? হিংলাজ শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী কি? কিভাবে আরাধনা করা হয়? এই মন্দিরের তাৎপর্য কি? জানুন সবকিছু বিস্তারিত।

সতী পার্বতীর প্রাণহীন দেহটি যখন ৫১ টি খন্ডে বিভক্ত করা হয়, তখন ভারত ছাড়াও ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতেও বেশ কিছু দেহ অংশ ছিটকে গিয়ে পতিত হয়েছিল।

এমনই দেহাংশ গুলির মধ্যে একটি হলো সতীর ব্রহ্ম্ররন্ধ (মস্তিষ্কের অংশ), যা কিনা পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশের মরুভূমিতে পতিত হয়েছিল। যা কিনা করাচি থেকে ১২৫ কিলোমিটার উত্তর- পূর্বে অবস্থিত।

Hinglaj Shakti Peeth in Bengali - হিংলাজ শক্তিপীঠ
Hinglaj Shakti Peeth in Bengali – হিংলাজ শক্তিপীঠ

এখানে বিখ্যাত হিংলাজ মাতার মন্দির সকলের কাছে খুবই জনপ্রিয় এবং পবিত্র একটি তীর্থস্থান আর দেবীর সেই দেহ অংশ অর্থাৎ ব্রহ্মরন্ধ এই স্থানে পতিত হয়েছিল, তারপরে এই স্থানটি একটি শক্তি পীঠে পরিণত হয়। মন্দিরের নামেই গ্রামটির নাম হিংলাজ অথবা হিঙ্গুলা রাখা হয়েছে।

হিংলাজ শক্তিপীঠ:

শক্তিপীঠের নাম হিংলাজ শক্তিপীঠ
স্থান হিংলাজ মন্দির, হিংলাজ, বেলুচিস্তানের লাসবেলা জেলার মাক্রান উপকূলের একটি শহর এবং হিংগোল জাতীয় উদ্যানের মাঝখানে অবস্থিত
দেশ পাকিস্তান
দেবীর অংশ ব্রহ্মরন্ধ্র (মস্তিষ্কের অংশ)
শক্তির নাম কোট্টরী

হিংলাজ মাতার মন্দিরের মাহাত্ম্য:

কাহিনী অনুসারে পাকিস্তানের বালুচিস্তানের লাসবেলায় মাখরান উপকূলের কাছে গিরিখাতে থাকা হিংলাজে সতীর সিঁদুর অথবা হিঙ্গুল মাখা মাথা পতিত হয়েছিল বলে জানা যায়। তাই হিন্দুদের কাছে এই হিংলাজ শক্তিপীঠ খুবই পবিত্র একটি তীর্থভূমি।

সম্পূর্ণ মরুভূমির উপরে অবস্থিত এই তীর্থস্থান, সারা বছর ধরে এখানে তীর্থযাত্রীরা আসেন মায়ের দর্শন করতে এবং পুজো দিতে। ভারত থেকেও এখানে প্রতিনিয়ত ভক্তদের আনাগোনা চলে। অনেকদিন আগে তীর্থযাত্রীরা সেখানে যেতেন উটের পিঠে চড়ে।

যাত্রা শুরু করা হতো করাচি শহরের কাছে ভাব নদীর ধার থেকে। সঙ্গে থাকতো এক মাসের খাবার দাবার, শুকনো খাবার। মরুভূমির দস্যু দের প্রতিরোধ করার জন্য থাকতো অস্ত্রশস্ত্রও, সাথে থাকতো পর্যাপ্ত পরিমাণ পানীয় জল। আর এই মন্দিরের প্রসাদ হিসেবে শুকনো নারকেল, মিছরি, বাতাসা ইত্যাদি খুবই প্রচলিত।

Hinglaj Shakti Peeth Location - হিংলাজ শক্তিপীঠের স্থান
Hinglaj Shakti Peeth Location – হিংলাজ শক্তিপীঠের স্থান

এক মাসের অত্যন্ত কঠোর যাত্রা করার পর একেবারে ক্লান্ত শীর্ণ তীর্থযাত্রীরা পৌঁছতেন হিংলাজ মাতার মন্দিরে। এরপর অভয় নদীতে স্নান সেরে তারা দর্শন করতে যেতেন হিংলাজ মাতার মন্দিরে।

তবে জানা যায় যে, এই মন্দির স্থানীয় বালুচ মুসলমানদের কাছেও পরম আদরের। তারাও নাকি এখানে পূজা দিয়ে থাকেন, তাদের কাছে এটি “নানি কি হজ” নামে পরিচিত।

হিংলাজ মাতার মন্দির:

প্রত্যেকটি শক্তি পীঠ খুবই দুর্গম জায়গাতে অবস্থিত। প্রাচীনকালে এখানে যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল খুবই কঠিন। তাই এই সমস্ত তীর্থস্থানে অনেকেই জীবনের শেষ ভাগে একেবারে জন্য যাওয়ার পরিকল্পনাও করে থাকেন। তবে বর্তমান এখন অনেকটাই উন্নত, হিংলাজে এই মন্দিরটি একটি গুহার মধ্যে অবস্থিত।

এটি আসলে একটি প্রাকৃতিক গ্যাসের অগ্নিকুণ্ড, একটি পাথর কে দেবীর রূপ বলে মনে করা হয়। বর্তমানে এখানে খুবই কম পর্যটক আসেন, এখানে হিঙ্গল ন্যাশনাল পার্ক বলে একটি অভয়ারণ্য রয়েছে সেখানে কুমির সংরক্ষণ করে রাখা হয়।

দেবীর ৫১ টি শক্তি পীঠের মধ্যে হিংলাজ এই তীর্থভূমিটি অনেকখানি রহস্যময়। তাছাড়া এই শক্তি পীঠের অন্যতম মরুতীর্থ হিংলাজ মাতার মন্দির হিন্দুদের পবিত্র ধর্মস্থল তো বটেই, তার সাথে সাথে এর প্রতিটি ক্ষেত্রে লুকিয়ে রয়েছে রহস্য।

এই রহস্যের টানে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েও এই মন্দিরে আনাগোনা চলে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের। রহস্যময় হওয়ার জন্য এই মন্দিরকে নিয়ে রয়েছে অনেক সিনেমা, যা দেখতে অনেকটাই রোমাঞ্চকর লাগে।

হিংলাজ মন্দিরের অবস্থান:

যেহেতু মরুভূমিতে অবস্থিত, তার উপরে দুর্গম গুহা বেষ্টিত এই মন্দিরে পৌঁছাতে হয় বিপদ সংকুল পথ অতিক্রম করে, লায়ারি তেহশিলের পার্বত্য এলাকা পেরিয়ে তবেই পৌঁছতে হয় হিংলাজমাতার মন্দিরে। তারপরেই আপনি দেবীর দর্শন করতে পারবেন।

Hinglaj Shakti Peeth Temple- হিংলাজ শক্তিপীঠ মন্দির
Hinglaj Shakti Peeth Temple- হিংলাজ শক্তিপীঠ মন্দির

মন্দিরের উপরেই থাকা হিঙ্গল ন্যাশনাল পার্কের সৌন্দর্য পর্যটকদের বিশেষ আকর্ষণ স্থল বলা যেতেই পারে। পুরান মতে শক্তির দেবী হিংলাজ ভক্তদের সমস্ত মনস্কামনা পূরণ করেন।

সাধারণত এই মন্দিরে গুজরাত ও রাজস্থানের পুণ্যার্থী দের ভিড় হয় সব থেকে বেশি। দক্ষযজ্ঞের পর পাকিস্তানের এই অঞ্চলেই সতীর মাথার অংশ পতিত হয়েছিল, তাই এই জায়গাটি এখন একটি শক্তি পীঠের মধ্যে অনেকটাই গুরুত্বপূর্ণ ও মাহাত্ম্য বহন করে।

হিংলাজ মাতার মন্দির প্রতিষ্ঠার ইতিহাস:

প্রতিটি শক্তিপীঠ গড়ে উঠেছে এক একটি ইতিহাস নিয়ে। তেমনি হিংলাজ দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠার পিছনে রয়েছে বেশ কয়েকটি লোককথা এবং ইতিহাস।

তার মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত ইতিহাসটি হল, ত্রেতা যুগের চীন সীমান্তের কাছে তাতার মঙ্গল রাজত্বে হিঙ্গলসুন্দর নামে দুই রাজকুমার ছিলেন। দুজনেই ছিলেন অসম্ভব অত্যাচারী, এদের অত্যাচার থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্ত করতে গণেশ সুন্দরকে হত্যা করেন।

হিঙ্গলের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে রাজ্যের প্রজারা দেবীর আরাধনা করতে শুরু করেন। তখন হিঙ্গল কে দেবী এই গুহার মধ্যে তাকে নিয়ে আসেন এবং সেখানেই তার হত্যা করেন। মৃত্যুর আগে হিঙ্গলের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী এই জায়গার নাম হয় হিংলাজ।

সিন্ধু প্রদেশের রাজা জয়দ্রথ হিংলাজ মন্দিরের আশেপাশে অনেক মন্দির স্থাপন করেছেন। এই মন্দিরে প্রতিবছর এপ্রিল মাসে চার দিনের জন্য যে তীর্থ যাত্রা হয়, তাতে অংশ নেন প্রচুর মুসলমানও। এই তীর্থস্থানকে তারা “নানি কি হজ” বলে অভিহিত করেন।

হিংলাজ মাতার মূর্তি:

হিংলাজ মাতার মৃত্তিকা নির্মিত অর্থাৎ মাটি দিয়ে নির্মাণ করা নিচু পূজা বেদীটি একটি ক্ষুদ্র প্রাকৃতিক গুহার মধ্যে অবস্থিত। এই বেদীটি তে দেবীর কোন মানুষ দ্বারা নির্মিত মূর্তি নেই।

তবে একটি ক্ষুদ্র অনিয়তাকার পাথরকে হিংলাজমাতা হিসেবে পূজা করা হয়। এর পাশাপাশি পাথরটি সিঁদুর দিয়ে সম্পূর্ণভাবে লিপ্ত। তাই পাথর থেকে সম্পূর্ণ লাল রঙের দেখতে লাগে। এই তীর্থ স্থানে দেবী হলেন কোট্টরী এবং ভৈরব হলেন ভীমলোচন।

আশেপাশের অন্যান্য মন্দির:

হিংলাজ মাতার মন্দিরের আশেপাশে আপনি আরো অনেক গুলি ধর্মস্থান খুঁজে পাবেন। সেখানেও অনেক মন্দির আপনার চোখে পড়বে।

যেমন ধরুন গণেশ দেবের মন্দির, মাতা কালীমন্দির, গোরক্ষনাথ, ব্রহ্মকুণ্ড, গুরু নানক খাড়াও তীর, চোরাশি পর্বতে অনিলকুণ্ড চন্দ্রগোপ, খারি নদী ও অঘোর পুজা স্থান।

দেবীর মাথার অংশ বিশেষ অর্থাৎ ব্রহ্মরন্ধ পাকিস্তানের এই স্থানে পড়ে এমনই একটি তীর্থভূমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যা কিনা ৫১ টি শক্তি পীঠের মধ্যে একটি অন্যতম শক্তি পীঠ।

তীর্থক্ষেত্র দিয়ে পাকিস্তানের হওয়া সত্বেও দুর্গম পথ অতিক্রম করে ভারত তথা আরও অন্যান্য দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটক ও ভক্তদের সমাগম সারা বছর ধরেই চলে।

এই মন্দিরের সাথে জড়িয়ে রয়েছে অনেক রহস্য এবং তখনকার রাজত্ব কালে রাজাদের গুপ্তধন এর কথাও শোনা যায়। তবে সেটা কতটা সত্য তা নিয়ে রয়েছে অনেক খানি ধোঁয়াশা। তবে সম্পূর্ণ মরুভূমির উপরে অবস্থিত এই হিংলাজ মাতার মন্দির দর্শনার্থীদের জন্য একটি পবিত্র তীর্থভূমি।

যেখানে পৌঁছাতে গেলে আপনাকে অনেকটাই পরিশ্রম ও কষ্ট স্বীকার করতে হবে, তার সাথে মনের জোরও রাখতে হবে। এই মন্দিরে আশেপাশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বলতে গুহা এবং মরুভূমির বালিই দেখতে পাবেন।

সবদিক থেকে বিচার করে দেখা যায় যে, দেবের ব্রহ্মরন্ধ পড়ে জন্ম হওয়া এই শক্তি পীঠ হিন্দু ধর্মাবলম্বী দের কাছে খুবই পবিত্র একটি তীর্থভূমি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top