2023 Shivratri Puja History & Significance, 2023 শিবরাত্রি পূজার ইতিহাস ও তাৎপর্য এবং জানুন শিবরাত্রি পূজা কেন পালন করা হয়? শিবরাত্রি পূজার বিধি কি? ভারতীয়দের জন্য শিবরাত্রি পূজার গুরুত্ব কতটা? জানুন সবকিছু এখানে।
Maha Shivratri 2023 (মহা শিবরাত্রি 2023): সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হল মহাশিবরাত্রি অথবা শিবরাত্রি পূজা। শৈব হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান। দেবাদিদেব মহাদেব শিবের মহারাত্রি অন্ধকার দূর করার জন্য এই ব্রত পালন পালিত হয়ে থাকে এবং এই ব্রত পালন করে থাকেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মহিলারা। তার মত স্বামী পাওয়ার উদ্দেশ্যে অনেকেই শিবরাত্রি ব্রত পালন করে থাকেন।
গ্রামাঞ্চলে মহাশিবরাত্রি বেশ ধুমধাম ভাবে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হয়। প্রচুর ভক্তগণ এইদিন শিবলিঙ্গে গঙ্গাজল, দুধ, বেলপাতা, ফুল দিয়ে পূজা করে থাকেন নিষ্ঠাভরে। সারা রাত দু চোখের পাতা এক জায়গায় না করে একাগ্রচিত্তে এই পূজায় নিয়োজিত থাকেন ভক্তগণ।
তো চলুন তাহলে জানা যাক, মহা শিবরাত্রি অথবা এই শিবরাত্রি পূজার ইতিহাস ও তাৎপর্য সম্পর্কে:
মহা শিবরাত্রির ইতিহাস 2023:
কাহিনী ও পুরাণ অনুসারে তিনটি গল্প পাওয়া যায় এই শিবরাত্রি সম্পর্কে। প্রথমত বলা যায় যে, এই শিবরাত্রির দিন এই শিব কে স্বপ্নে পেয়েছিলেন পার্বতী, আবার অন্যদিকে পার্বতীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল মহাদেবের তাই মহা ধুমধাম এর সঙ্গে হিন্দুরা এই দিনটিতে মহাদেবের পুজো করে থাকেন এই কারণে নেপালে মহা শিবরাত্রির দিন তিন দিন আগে থেকে মন্দিরগুলো কে সাজানো হয়।
2023 শিবরাত্রি শুভেচ্ছা বার্তা ও স্ট্যাটাস ছবি
তার সাথে সাথে এমন অনেক জায়গাতে পার্বতী এবং শিবের মূর্তি কে বর নতুন কনে রূপে সাজিয়ে ঘরে ঘরে ঘোরানো হয়ে থাকে। এমন রীতি অনেক জায়গাতেই আছে। মহা শিবরাত্রির দিন ওদের বিয়েও দেওয়া হয় আবার।
দ্বিতীয়তঃ আরেকটি ঘটনা অনুসারে সকলেই আমরা জানি যে দেবতারা যখন সমুদ্র মন্থন করেছিলেন তখন সমুদ্র থেকে ভয়াবহ বিষ উঠে আসে। এর এই বিষের তেজ সমস্ত সৃষ্টি কে নষ্ট করে দিতে পারত। তখন কিন্তু মহাদেব এই সুন্দর সৃষ্টিকে বাঁচানোর জন্য নিজেই সেই বিষ নিজের কন্ঠে অথবা গলায় ধারণ করেছিলেন।
সেই কারণে তার কন্ঠ নীল হয়ে যায়, আর সেই কারণে মহাদেবের আর এক নাম “নীলকণ্ঠ (Nilkantha)”। ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তে কালকূট বিষ পান করে মহাদেব বিশ্বের সমস্ত সৃষ্টি কে রক্ষা করেছিলেন। বলে এই দিনটিতে শিবরাত্রি হিসেবে পালন করা হয় প্রাচীনকাল থেকে আজও।
এছাড়া আরেকটি কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, অতি প্রাচীন কালে কাশিতে এক নিষ্ঠুর ব্যাধ বাস করত। একদিন শিকারে গিয়ে দেরি হওয়ায় সে সারারাত একটি গাছে আশ্রয় নেয়। যে গাছটিতে আশ্রয় নেয় সেটি ছিল বেল গাছ। সারারাত ধরে কোন শিকার না পেয়ে বেল গাছের একটা একটা করে পাতা ছিঁড়ে নিচে ফেলেছিল দুশ্চিন্তায়। আর সেখানে ছিল একটি শিবলিঙ্গ।
আর দিনটি ছিল মহা শিবরাত্রি। ব্যাধ সারাদিন কিছু না খেয়েই ছিলো, শিবের মাথায় বেল পাতা গুলি পড়ার ফলে অজান্তেই ব্যাধ সেদিন তার শিবরাত্রির ব্রত পালন করেছিল। পরে কিছুদিন পর তিনি মারা গেলে জম দূত তাকে নিয়ে আসে কিন্তু যেহেতু সে শিবরাত্রি ব্রত পালন করেছিল তাই যমরাজ তাকে মুক্তি দেন। এই হল শিবরাত্রির আর এক ইতিহাস।
মহা শিবরাত্রির তাৎপর্য:
শিবরাত্রির দিন লক্ষ লক্ষ নারী পুরুষ শিবের মাথায় দুধ, ডাবের জল, ঢেলে এবং ফুল ও বেল পাতা দিয়ে শিবের পূজা করেন। সারাদিনের উপবাস করার পর এই ব্রত পালন করে থাকেন তারা।
তবে যারা উপবাস করতে পারেন না, তারা ফল ও জল খেতে পারেন। তবে এই দিনে সারা দিন ও সারা রাতের মধ্যে কোনরকম ভাবে ঘুমানো যাবে না, তার সাথে খারাপ কোন কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং দূরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া যাবেনা।
শিবলিঙ্গ পূজার তাৎপর্য:
লিঙ্গ শব্দের অর্থ হলো চিহ্ন অথবা প্রতীক। এই প্রতীক অথবা চিহ্নতে আছে পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়, পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয়, পাঁচটি প্রাণ, মন ও বুদ্ধি। একটি দেশের পরিচয় যেমন বহন করে পতাকা, তেমনি এই লিঙ্গা অর্থের মূলকথা হলো প্রতীক অথবা চিহ্ন।আমাদের যখন মৃত্যু হয়, তখন জীবাত্মা সূক্ষ্ম শরীর বিচরণ করে এবং পুনরায় দেহ ধারন করে। তবে শিব, রুদ্র, মহাদেব, নামে আমাদের মধ্যে বেশি পরিচিত।
একটি শিবলিঙ্গ, আরেকটি নারায়ন শিলা এই পূজায় লাগে। শিব লিঙ্গের গঠন প্রণালী সহজ হওয়ার জন্য মূর্তি তৈরির থেকে লিঙ্গ পূজায় আমরা বেশি আগ্রহ দেখিয়ে থাকি। মাটি দিয়ে অতি সহজে অল্প সময়ের মধ্যে এই প্রতীক তৈরি করা যায় এবং পূজা শেষে বিসর্জন দেওয়া হয়ে থাকে।
এছাড়া একটি দুঃখজনক বিষয় হলো, প্রতীকটির নাম লিঙ্গ রাখার জন্য এটা কে অন্য মানে হিসেবে অনেকেই ধারণা করে থাকেন, তবে সেটা একেবারেই উচিত নয়।
শিব নীলকন্ঠ:
দেবতারা অমৃত লাভের আশায় সমুদ্র মন্থন করেছিলেন। সমুদ্রমন্থনের সময় প্রথমদিকে যে বিষ উত্তোলন হয়েছিল তা যেখানেই রাখা হোক না কেন সেটা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যেত। তাই সেই কারণে দেবাদিদেব মহাদেব নিজের কন্ঠে ধারণ করেছিলেন অর্থাৎ এই দিনে এমন তাৎপর্য বহন করে যে, মহাদেব আমাদের পৃথিবীর সৃষ্টি কে বাঁচিয়ে ছিলেন। সেই কারণে অনেকেই নীলকন্ঠ মূর্তিকে শিবরাত্রির দিন পূজা করে থাকেন।
আবার আরেক দিকে শিবের আরেক নাম ভূতনাথ, অর্থাৎ তিনি শ্মশানে-শ্মশানে ছাই, কালি মেখে পড়ে থাকতেন। ভূত অর্থ প্রাণী, তিনি প্রাণিজগতের পালক। তার কাছে উঁচু-নিচু কিছুই নেই, তিনি সর্ব জায়গাতেই বিরাজমান।
আর সেই কারণে শিব পূজায় জাতি কুলের কোনরকম বিচার নেই। এই পূজায় সকলেই অংশগ্রহণ করতে পারেন। তাছাড়া মহাদেব খুব অল্পতে সন্তুষ্ট হয়ে যান। যেমন খুব তাড়াতাড়ি রেগে যান, তেমনি একটু গঙ্গাজল, বেলপাতা, অর্পণ করলেন তিনি এতেই সন্তুষ্ট।
শিবের ত্রিশূল এর তাৎপর্য:
শিবের হাতে যে ত্রিশূল থাকে, সেই ত্রিশূলের তিনটে ফলক এবং সেই শক্তির আধার স্বরূপ হিসেবে চিহ্নিত। তিনটি ফলক সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় এর প্রতীক এবং সত্ত্ব গুণময় ফলকে আছেন বৃষ্ণু, রজ গুণময় ফলকে আছেন ব্রহ্মা এবং তমো গুণময় ফলকে আছেন সংহার দেবতা রুদ্র। আর সেই কারণেই শিবের ত্রিশূল ত্রি শক্তির আধার স্বরূপ।
দেবাদিদেব মহাদেবের পোশাক:
তিনি বাঘের ছাল পরিধান করতেন, আর সাপ দিয়ে সেই বস্ত্র বেঁধে রাখতেন। তার সাথে তার গলায় থাকতো সাপ, আর শিবের মাথায় জটার মধ্যে অবস্থান করতেন মা গঙ্গা। পুরান মতে কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, গঙ্গার উৎপত্তি এখান থেকেই, মহাদেব এর মাথার জটা থেকে।
শিবের বাহন ষাঁড় অথবা বৃষ (তাৎপর্য):
স্বাভাবিক অবস্থায় বৃষ (ষাঁড়) শান্ত নিরীহ এবং কারোর কোনো ক্ষতি না করে নিজের খেয়ালে চলে। আবার গৃহস্থবাড়ির নিত্য সহায়ক কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, কিন্তু যখন সে রেগে যায়, তার ধারেপশে কারো যাওয়ার ক্ষমতা থাকেনা। আর সেই কারণেই কিন্তু শিবের সাথে অনেকটাই মিল রয়েছে। মহাদেব যেমন শান্ত অবস্থায় থাকলে তৃতীয় চোখ বন্ধ থাকে বলতে গেলে তিনটে চোখই বন্ধ থাকে। রুদ্র নাম এই কারণে যখন তিনি রেগে যান তখন রুদ্র মূর্তি ধারণ করেন।
গ্রামাঞ্চলে অনেক জায়গায় বট অথবা অশত্থ গাছের তলায় শিবলিঙ্গ অথবা শিব ও পার্বতীর মূর্তি তে শিবরাত্রি পূজা করা হয়ে থাকে। এই পূজায় বিভিন্ন রকমের ফল, ফুল, তার সাথে অবশ্যই প্রয়োজন বেল ফল ও বেলপাতা। নীলকন্ঠ ফুল, আকন্দ ফুল, ধুতরা ফুল শিব ঠাকুরের সবচেয়ে প্রিয় ফুল। সেই কারণে বন জঙ্গল থেকে হলেও অনেকেই এই ফুল জোগাড় করতে ব্যস্ত থাকেন শিবরাত্রির দিন পূজার জন্য।
শিব যেমন পার্বতীকে খুবই ভালবাসতেন, সেই কারণে মেয়েরা এই পূজার মধ্যে দিয়ে মনের আকাঙ্ক্ষা জানয়ে থাকতেন যে, শিবের মতো স্বামী যেন তারা পেয়ে থাকে। সারা রাত্রি ব্যাপি এই পূজা হয়ে থাকে এবং সারারাত জাগরণ করতে হয় সকলকে। এদিন কেদারনাথে মহা ধুমধাম করে শিবরাত্রি পালন করা হয়। ভক্তদের ভিড় চোখে পড়ার মতো।
প্রতিবছর ফাল্গুনী চতুর্দশীতে শিবরাত্রি পূজা হয়ে থাকে, সারা বছর অপেক্ষার পর শিব চতুর্দশীতে অর্থাৎ এই ফাল্গুনী চতুর্দশীতে সকলেই এই পূজা করে থাকেন। দেবাদিদেব মহাদেব কোন ভক্তের উপর সন্তুষ্ট থাকলে তাকে সবকিছু উজাড় করে দান করেন, সে ক্ষেত্রে ভক্তগন নিষ্ঠাভরে শিবরাত্রি পূজা পালন করে থাকেন। এছাড়া শিব ভক্তগনের কামনা এবং মনের ইচ্ছা পূরণ করতে সর্বদাই তৎপর থাকেন।
সব দিক থেকে দেখলে, শিবরাত্রি অনেক তাৎপর্য বহন করে। তার সাথে সাথে মনের ইচ্ছা পূরণের জন্য শিব রাত্রি ব্রত পালন করে থাকেন বেশিরভাগ মহিলারা। বাংলায় শিবরাত্রি ব্রত আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করে থাকেন গ্রাম বাংলার সাধারন মানুষ জন।
কথায় আছে, “শিবির তৃতীয় চোখ খুললে পৃথিবী ধ্বংসের মুখে পড়তে পারে।” সেই কারণে শিব কে সন্তুষ্ট রাখতে বাঙালি হিন্দুরা সর্বদাই তৎপর থাকেন। দেবাদিদেব মহাদেবের মাথা ঠান্ডা রাখতে নিয়ম মেনে ডাবের জল, দুধ ও সাধারণ জল ঢেলে থাকেন শিবলিঙ্গের ওপর।
তাছাড়া এই পূজার মধ্যে দিয়ে আনন্দ উৎসব পালিত হয়ে থাকে অনেক জায়গায়। এই উপলক্ষে অনেক জায়গায় মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণ মানুষেরা সেখানে পূজার পাশাপাশি মেলাতে ভীষণভাবে আনন্দ করেন। তার সাথে সাথে ভক্তি ও শ্রদ্ধা মিলিত ভক্তদের মন খুশিতে ভরে ওঠে।