কেদারনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির, উত্তরাখন্ড – Kedarnath Jyotirlinga Temple

কেদারনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির (Kedarnath Jyotirlinga Temple): এই মন্দিরের কথা অনেকেই নিশ্চয়ই জানবেন। কেননা এখানে সারা বছর ধরে ভক্তদের সমাগম ঘটে না। তাছাড়া হিন্দু শাস্ত্রমতে সোমবার কে বলা হয় ভগবান শিবের আরাধনার দিন।

আর ১২ টি জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে সবথেকে অন্যতম এবং গুরুত্বপূর্ণ জ্যোতির্লিঙ্গ হল কেদারনাথ। এই কেদারনাথ মন্দিরে বহু জায়গা থেকে প্রচুর ভক্তরা ভিড় জমান। কেননা বছরের বেশিরভাগ সময় এই কেদারনাথ বন্ধ থাকে, আর এটাই হল এই মন্দিরের বিশেষত্ব।

কেদারনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির, উত্তরাখন্ড - Kedarnath Jyotirlinga Temple
কেদারনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির, উত্তরাখন্ড – Kedarnath Jyotirlinga Temple

উত্তরাখণ্ডের গাড়োয়াল শহরের কাছে হিমালয়ের একেবারে কোলে এই তীর্থভূমিটি অবস্থিত। একেবারে কাছ থেকে বয়ে চলেছে মন্দাকিনী নদী। তবে অনেক আগে এই মন্দিরের নাম ছিল কেদারখণ্ড। সেই জন্য ভগবান শিব এখানে কেদার খণ্ডের অধিপতি অথবা কেদারনাথ নামে পুজিত হয়ে আসছেন।

যেহেতু আমরা জানলাম যে, এই মন্দিরটি হিমালয়ের একেবারে কোলে অবস্থিত তাই বরফ পড়ার জন্য সারা বছর কেদারনাথ মন্দির খোলা থাকে না। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে অক্ষয় তৃতীয়ার দিন মন্দির খোলা হয়, আর বন্ধ হয় নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের প্রথম দিকে কার্তিক পূর্ণিমায়।

মন্দির বন্ধ হওয়ার পর কেদারনাথ মন্দিরের কিছু মূর্তি দোলায় চাপিয়ে ছয় মাসের জন্য রুদ্রপ্রয়াগের উখী মঠে নিয়ে গিয়ে পূজা করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা এই মূর্তি নিয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে “ডোলিযাত্রা” বলেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বহুবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কেদারনাথ মন্দির।

অনেকবার ধস নেমে ক্ষতি হয়েছে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের, কিন্তু একটা কথা সত্যিই ভাবায় যে, অলৌকিক শক্তির বলে এখানকার নন্দী মূর্তির গায়ে কখনো একটুও আঁচড় লাগেনি। যে নন্দী মূর্তি মন্দিরের বাইরে অবস্থিত যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ধস নেমে এসে সেটা আগেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে যাওয়ার কথা।

কেদারনাথ জ্যোতিরলিঙ্গ মন্দিরের ইতিহাস ও পৌরাণিক কাহিনী: 

মহাভারতে কথিত আছে যে, পাণ্ডবরা খবর পেয়েছিলেন মহাদেব এখানে ষাঁড়ের ছদ্মবেশে লুকিয়ে আছেন। ব্যাসদেবের নির্দেশে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পাপ ধুয়ে ফেলতে পান্ডবরা এখানে এসে তপস্যার দ্বারা মহাদেবকে সন্তুষ্ট করেছিলেন। সেই জন্য ষাঁড়ের পিঠে এই কুঁজকেই জ্যোতিরলিঙ্গ হিসেবে পূজা করা হয়। যা দেখতে ত্রিভুজ আকৃতির। আদি শঙ্করাচার্য এখানে মন্দির সংস্কারের কাজ করেছিলেন বলে জানা গিয়েছে।

এখানকার প্রধান পুরোহিত কে বলা হয় রাওয়াল যিনি বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের হয়ে থাকেন। কথিত আছে যে ভগবান বিষ্ণুর অবতার নরনারায়ন তাদের তপস্যায় ভগবান শিব কে সন্তুষ্ট করেছিলেন। তাদের প্রার্থনা অনুযায়ী ভক্তদের আশীর্বাদ দিতে ভগবান শিব এখানে জ্যোতির্লিঙ্গ হিসেবে বসবাস শুরু করেছিলেন। রাওয়াল মন্দিরের ভিতরে কোন আচার অনুষ্ঠান করেন না, তার নির্দেশ এই সমস্ত যাবতীয় কাজ করেন তার সহকারীরা।

কেদারনাথ মন্দিরের তীর্থক্ষেত্রের কেদারনাথ পর্বত তীর্থযাত্রীদের সব থেকে আকর্ষণীয় জায়গা বলে মনে করা হয়। এখানে সাদা বরফ আর নীল আকাশ একেবারে একটা স্বর্গীয় দৃশ্য সৃষ্টি করে। পর্বতে স্বয়ং মহাদেবের বাস বলে মনে করা হয়। পুন্যার্থীদের বিশ্বাস কেদারনাথ মন্দির আসলে পঞ্চ কেদারের অংশ। যার সব কটি গাড়োয়াল হিমালয়ের মধ্যে পড়ে।

এছাড়া কাহিনী অনুসারে ভগবান শিব যখন ষাঁড়ের রূপ ধারণ করে ছিলেন এবং সেই রূপ থেকে নিজের রূপ ধারণ করেন, তখন তারা হাত দেখা গিয়েছিল তুঙ্গনথে, রুদ্রনাথে দেখা গিয়েছিল ভগবান শিবের মুখ, মধ্য মহেশ্বরে দেখা গিয়েছিল ভগবান শিবের পেট আর কল্পেশ্বরে দেখা গিয়েছিল শিবের জটা।

কেদারনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরে যাওয়ার জন্য ভক্তদের পায়ে হেঁটেই যেতে হয়। কেননা এই মন্দিরে যাওয়ার জন্য কোন সড়ক পথ নেই। পাহাড়ের ধাপ ভেঙে ভেঙে সেখানে পৌঁছাতে হয়। বলতে গেলে সবটাই পায়ে হাটা রাস্তা।

২০১৩ সালের ১৬ই এবং ১৭ই জুন কেদার খণ্ডে অর্থাৎ কেদারনাথের ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের একটা বড় অংশ। এই বিপর্যয়ের আগে গৌরী কুম্ভ থেকে ১৪ কিলোমিটার পথ পাহাড়ে চড়াই পথে ট্রাকিং করে মন্দিরে যেতে হতো। মানুষের বিশ্বাস অনুযায়ী আদি শঙ্কর বর্তমান স্থানে মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন।

যদিও মহাভারতের কেদারনাথ মন্দিরের উল্লেখ আছে। এটি একটি জ্যোতির্লিঙ্গ। তবে কাহিনী অনুসারে পাণ্ডবরা এখানে তপস্যা করে শিবকে সন্তুষ্ট করেছিলেন। এটি উত্তর হিমালয়ের ছোট চার ধাম তীর্থ চতুষ্টয় এর অন্যতম। কেদারনাথ মন্দিরে পৌঁছাতে গেলে আপনাকে বেশ কয়েকটি জায়গা অতিক্রম করে যেতে হবে।

যেমন ধরুন গৌরীকুণ্ড থেকে সাড়ে ছয় কিলোমিটার দূরে ভীম বলি, সেখান থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে লিঞ্চলি, লিঞ্চলি থেকে কেদারনাথ পাঁচ কিলোমিটার অর্থাৎ আগে ১৪ কিলোমিটার এবং এখন সাড়ে ২৩ কিলোমিটার সবমিলিয়ে আপনাকে হাঁটতে হবে। তবেই কিন্তু কেদারনাথ মন্দিরে পৌঁছাতে পারবেন।

কেদারনাথ মন্দিরে পৌঁছাতে গেলে অনেকটাই কষ্ট করতে হয় বলে জানা যায়। আর এটা থেকে বোঝা যায় যে এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ। তাছাড়া বছরের ৬ মাস এখানে মন্দির বন্ধ থাকে সেই কারণে এখানকার পরিবেশ খুবই সংকটময়। বরফ পড়ার কারণে ছয় মাস যাবত মন্দির বন্ধ থাকে আর মন্দিরের ভিতরে ঘি এর প্রদীপ এমনভাবে জালানো হয় যেটা ৬ মাস পর্যন্ত জ্বলতে পারে এমনটা জানা গেছে।

তবে যতই বাধা-বিপত্তি থাকুক না কেন, যতই এই মন্দিরের উপরে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার উপক্রম হোক না কেন, তবু কিন্তু আজও কেদারনাথের উপরে কোন রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঁচড় কাটতে পারেনি।

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এবং বিদেশি পর্যটকরাও এখানে ভ্রমণ করতে আসেন। তাছাড়া ভক্তদের পূজো দেওয়ার ধুম পড়ে যায় যে কদিন এই মন্দির খোলা থাকে। হিমালয়ের বরফ ঢাকা পাহাড়ের চূড়ার নিচে অবস্থিত এই কেদারনাথ জ্যোতিরলিঙ্গ মন্দির দর্শনার্থীদের জন্য চোখ জুড়ানো দৃশ্য বলা যায়।

পায়ে হাঁটা পথ তবুও ভক্তরা তাদের মনের ইচ্ছা নিয়ে সমস্ত বাধা পেরিয়ে এই কেদারনাথে এসে ভগবান শিবের কাছে মনের ইচ্ছা জানিয়ে থাকেন, আর এখানে নিষ্ঠা ভরে পূজা করলে মনের ইচ্ছা পূরণ হয় এমনটা অনেকেই দাবি করেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top