দোল পূর্ণিমা 2023: ইতিহাস ও তাৎপর্য | Dol Purnima 2023: History and Significance

ভালোবাসার সাথে শেয়ার করুন

2023 Dol Purnima History & Significance, 2023 দোল পূর্ণিমার ইতিহাস এবং জানুন দোল পূর্ণিমা কেন পালন করা হয়? দোল পূর্ণিমার তাৎপর্য কি? ভারতীয়দের জন্য দোল পূর্ণিমার গুরুত্ব কতটা? জানুন সবকিছু এখানে।

WhatsApp Channel Telegram Group

Dol Purnima 2023 (দোল পূর্ণিমা 2023): বসন্ত উৎসব বলতে দোল পূর্ণিমা, দোল উৎসব এবং হোলি। চারিদিকে প্রকৃতি যেন সুন্দর ভাবে সেজে ওঠে। তার সাথে বিভিন্ন রকমের ফুল প্রকৃতিকে আরো সুন্দর করে সাজিয়ে তোলে। বাতাসে উৎসবের আমেজ, মনে লাগে দোল পূর্ণিমার রঙিন হওয়া।

গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত  থাকে সেক্ষেত্রে বসন্তের আগমনী বার্তা বহন করে নিয়ে আসে, এই দোল পূর্ণিমায় অর্থাৎ দোলযাত্রা। কোন কিছু জিনিস যেমন খারাপ হয়ে গেলে সেগুলো কে আবার নতুন করে ছাড়িয়ে নতুন রঙে রাঙিয়ে তোলা হয়, আরো ভালো দেখানোর জন্য। তেমনি এই দোল পূর্ণিমা মানুষের জীবনে রঙিন হাওয়া লাগিয়ে দিয়ে যায়।

Dol Purnima History and Significance - দোল পূর্ণিমা ইতিহাস ও তাৎপর্য
Dol Purnima History and Significance – দোল পূর্ণিমা ইতিহাস ও তাৎপর্য

বিভিন্ন রং মানুষের জীবনে রঙিন অনুভূতি দিয়ে থাকে, সে কারণে দোল পূর্ণিমা খুবই আনন্দের উৎসব আমাদের কাছে। সেই কারণে এই দোল পূর্ণিমা কে নতুনের আহবানও বলা হয়ে থাকে। দোলের দিন আমরা সব রকম ভাবে বিপদ পেরিয়ে জাত-পাত, ধর্ম, বর্ণ, সবকিছু ভুলে একে অপরকে রাঙিয়ে তুলি। তাই এই উৎসবকে প্রেমের বা সৌন্দর্যের উৎসবও বলা হয় আর এক দিক থেকে।

তো আজ তাহলে জানা যাক, এই দোল পূর্ণিমার ইতিহাস ও তাৎপর্য সম্পর্কে:

দোল পূর্ণিমার ইতিহাস 2023:

যদিও দোল পূর্ণিমা (Dol Purnima) সকলের রাঙিয়ে তোলার উৎসব সেক্ষেত্রে বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী দোল পূর্ণিমার দিন শ্রীকৃষ্ণ রং ও আবির দিয়ে রাধা ও অন্যান্য গোপিনীদের সাথে রং খেলায় মেতে উঠেছিলেন। দোল খেলার উৎপত্তি সেখান থেকেই শুরু। আর আজও সেই উৎসব মানুষের মনে রঙিন হয়ে রয়েছে ভবিষ্যতে এমনই এভাবেই চলবে।

2023 হোলি উৎসবের শুভেচ্ছা বার্তা ও স্ট্যাটাস ছবি

আবার এই দোল পূর্ণিমার দিন টিকে গৌর পূর্ণিমা ও বলা হয়। কেননা ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে ১৮ ই ফেব্রুয়ারি শনিবার দোল পূর্ণিমা তিথিতে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম হয়েছিল। আর তার সাথে সাথে এই বঙ্গদেশে দোল উৎসবের সূচনা হয়েছিল শ্রীচৈতন্যদেবের হাত ধরে, ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি যখন গৃহ ত্যাগ করে বৃন্দাবনে গিয়ে সেখানকার রং খেলা দেখে অভিভূত হয়েছিলেন তখন বাংলায় দোল উৎসবের সূচনা করেন। তবে দোল খেলার ছলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই লীলাবিলাস কবে শুরু হয়েছিল তা কিন্তু সঠিকভাবে জানা যায় না।

আবার অন্যদিকে পুরাণ মতে প্রায় ২ হাজার বছর আগে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন গোকুলে হোলি খেলার প্রচলন করেছিলেন। তবে সে ক্ষেত্রে কিন্তু ইতিহাসে একাধিক ইন্দ্রদ্যুম্ন থাকায় সঠিকভাবে এনার কোনো পরিচয় আজও পাওয়া যায়নি। এছাড়াও সপ্তম শতাব্দীতে সম্রাট হর্ষবর্ধনের লেখা “রত্নাবলী” নাটকটি তে আমরা হোলি খেলা দেখতে পাই। এছাড়াও “আল-বারুনী”র লেখাতেও ভারতবর্ষের দোল উৎসবের বর্ণনা পাই।

শুধু উত্তর ভারতেই নয়, দক্ষিণ ভারতের বিজয় নগরের একটি মন্দিরের গায়ে এক রাজকুমার রাজকুমারীর রং খেলার চিত্রকলা করা আছে। তবে আমরা যেমন বর্তমানে এই উৎসবকে দোল উৎসব (Dol Utsab) বলে থাকি, অনেকে হোলি (Holi) হিসেবেই চেনেন, তবে প্রাচীন ভারতে এই উৎসবকে হোলিকা উৎসব (Holika) বলা হত।

আবার পুরান মতে ভগবান বিষ্ণুর পরম ভক্ত ছিলেন প্রহ্লাদ। কিন্তু তার পিতা অসুররাজ হিরণ্যকশিপু পছন্দ করতেন না পুত্রের এই বিষ্ণু ভক্তি। অহংকারী হয়ে ওঠেন অমরত্ব লাভ করে হিরণ্যকশিপু। আর পুত্র বিষ্ণুর পূজা করতে চাওয়ায় তিনি তার পুত্রকে বিভিন্নভাবে হত্যার চেষ্টা করেন।

আর এর জন্য হিরণ্যকশিপু তার বোন হোলিকার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। হোলিকার কাছে এক বিশেষ পোশাক ছিল, যা তাকে আগুনে পুড়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করত। সেইমতো হোলিকা তার দাদার এই পুত্র হত্যার পরিকল্পনায় সম্মত হয়ে প্রহ্লাদ কে তার দাদার কোলে বসিয়ে তার গায়ে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন।

যাতে প্রহ্লাদ পুড়ে মারা যায়। তাহলে তার কাছে থাকা বিশেষ আগুন না লাগা বস্তু থাকার কারণে সেজন্য তারা বেঁচে যাবেন। কিন্তু সেই আগুন জ্বালতেই হোলিকার বিশেষ সেই বস্ত্র খুলে গিয়ে প্রহ্লাদকে আবৃত করে এর ফলে হোলিকা পুড়ে মারা যায়। এর পর বিষ্ণুর এক নরসিংহ অবতারের হাতে হিরণ্যকশিপুর মৃত্যু হয়।

আর সেই থেকে হোলিকারে অগ্নিদগ্ধ হওয়ার কাহিনী হোলিকা দহন বা হোলি উৎসবের সঙ্গে যুক্ত। স্কন্দ পুরাণ গ্রন্থে হোলিকা উপাখ্যানে বর্ণনা করা হয়েছে আর এই কাহিনী অশুভ শক্তির পরাজয় এবং শুভশক্তির সূচনার কথাই বলে দেয় সকলকে।

আবার এই দোল পূর্ণিমার দিনে পুরান মতে শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করার কথা বলা হয়েছে। আর এক্ষেত্রে হোলিকাকে বলা হয় পুতনা, পুতনা রাক্ষসী। শিশু কৃষ্ণ শুধুমাত্র পুতনার বিষ দুধই পান করেননি, তার রক্ত পান করেন এবং পুতনা আগুনে জ্বলে যায়, আর শ্রীকৃষ্ণের গায়ের রং নীল হয়ে যায়।

আর সেই কারণেই দোল উৎসবের আগের রাতে পুতনার দহন পালিত হয়। আর ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণে আছে কৃষ্ণের ভজন করার জন্যই শ্রী রাধার জন্ম হয়। হিন্দু পুরাণ অনুসারে কৃষ্ণ তার শ্যাম বর্ণের জন্য হতাশ হয়ে পড়েন, তখন তার মা তাকে বলেন তিনি যেন রাধার মুখমন্ডল রং দিয়ে রাঙিয়ে দেন।

এছাড়া বিবাহিত নারীরা তাদের পরিবারের কল্যাণ সাধনের জন্য মঙ্গল কামনায় রাকা পূর্ণিমায় রঙের উৎসব করতেন। এছাড়া ভারতের বাইরে ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত দের মধ্যে এই উৎসব দেখা যায়। যেমন ধরুন- দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপের অনেকাংশে মরিশাসে এবং বেশ কিছু ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে এই দোল উৎসব পালিত হয়।

এই দোল পূর্ণিমার দোল উৎসব অথবা হোলি নিয়ে অন্য একটা পুরান মতে আরো একটি গল্প আছে, যা ভালোবাসার জন্য আগুনে পুড়ে আত্মত্যাগের সাথে সম্পর্কিত রয়েছে। সতীর মৃত্যুর পর মহাদেবের সাথে পার্বতীর বিয়ের আগে দেবী পার্বতী শিব কে যোগ ধ্যান থেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনার জন্য বসন্ত পঞ্চমীর দিন প্রেমের দেবতা কামদেবের সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন।

দেবী পার্বতী কে সাহায্য করার জন্য মহাদেবের দিকে প্রেমের তীর ছুড়ে দেন। দেবাদিদেব মহাদেব প্রচুর রেগে যান এবং তার সাথে তার তৃতীয় নয়ন খুলে দেন এবং তার সেই তৃতীয় চোখের চাহনিতে কামদেব পুড়ে ভষ্মিভূত হয়ে যান।

এই ঘটনায় রতিদেবী ভীষণভাবে ভেঙে পড়েন এবং পরবর্তীকালে শিব ও রতিদেবীর বিয়ে হয়, এই বিয়ের সময় রতিদেবী শিবের কাছে প্রার্থনা করেন যাতে কামদেবকে তিনি পুনরায় তার কাছে ফিরিয়ে দেন এবং কামদেব কে সত্যি সত্যি আবেগের একটা বাস্তব সত্য হিসেবে ফিরিয়ে দেন। প্রেমের দেবতার এই ফিরে আসা বসন্ত পঞ্চমীর ৪০ দিন পর হোলি হিসেবে পালিত হয়।

বৈষ্ণব ধর্ম ছাড়াও কিন্তু শাক্ত ও শৈবধর্ম এও এই উৎসব পালিত হয়। এই উৎসবে একদিকে যেমন প্রেমের, অন্যদিকে তেমনি অশুভ শক্তির পরাজয়ের মাধ্যমে শুভশক্তির সূচনা, শত্রু বিনাশ কারক উৎসবও বলা হয়ে থাকে। এটা হিন্দু ধর্মের একটি সামাজিক বন্ধনের উৎসব ও বটে। এখানে সবকিছু ভুলে সবাই সবাইকে রঙিন রঙে রাঙিয়ে তোলেন।

দোলযাত্রার ইতিহাস ও তাৎপর্য 2023:

দোল পূর্ণিমা সুন্দর বৃন্দাবনে রাধা কৃষ্ণ একসঙ্গে খেলে রঙিন হয়ে উঠেছিলেন সেই প্রথমে। আজ দোল পূর্ণিমার পবিত্র এই রঙের খেলায় মেতে ওঠেন প্রায় সকলেই। আর হয়ে ওঠেন রঙিন। কাউকে চেনার উপায় থাকে না।

দোল পূর্ণিমার ধর্মীয় তাৎপর্য:

দোল হোক অথবা হোলি, আমরা যে নামেই পালন করে থাকি না কেন, এই উৎসবের ধর্মীয় তাৎপর্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের মঙ্গল কামনার কথা মাথায় রেখে বাড়িতে বিশেষ দোল পূর্ণিমার পূজার আয়োজন করেন অনেকেই। কিন্তু যেভাবে সেভাবে পূজার আয়োজন করলে তো হবে, তা তো হতে পারে না! এই পূর্নিমায় চন্দ্র সহ চার গ্রহ অবস্থান করবে, চন্দ্রের নক্ষত্রের আরাধনায় শুভফল পাবেন।

আর এই দিনে ভক্তিসহকারে রাধা কৃষ্ণ ভগবান, বিষ্ণুর এবং মহাদেব এর উপাসনা, প্রেম, বিদ্যা এবং আর্থিক সাফল্য প্রদান করতে পারে। সেই কারণে প্রতিটি বাঙালির ঘরে দোল পূর্ণিমার দিন জাঁকজমক পূর্ণ ভাবে এই পূজা করা হয়ে থাকে।

তবে হ্যাঁ এই পূর্ণিমাতে অর্থাৎ দোল পূর্ণিমাতে সামান্য কিছু পূজা-অর্চনা আপনার জীবনের অনেকটা শুভ ফল এনে দিতে পারে।

দোল পূর্ণিমার সংস্কৃতির তাৎপর্য:

ভারতবর্ষে বিভিন্ন হিন্দু ঐতিহ্য হিসেবে সংস্কৃতি তাৎপর্য রয়েছে। এই দিনটি উৎসবের সাথে পালিত হয়ে থাকে। সবচেয়ে বেশি আনন্দ হয়ে থাকে শান্তিনিকেতনে।

“ওরে গৃহবাসী..
খোল দ্বার খোল, লাগলো যে দোল,
স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল,
দ্বার খোল, দ্বার খোল,ওরে গৃহবাসী।”

রবীন্দ্রনাথের এই দোল পূর্ণিমার আহ্বান সকলে নিশ্চয়ই অজানা নয়! এই দিনটি একটি উৎসব মুখর দিন। একজন মানুষ তাঁর অতীতের সব কষ্ট দুঃখ ভুলে গিয়ে এই দিনে একে অপরের সাথে রং খেলায় মেতে ওঠেন। কারোর মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ যদি থেকে থাকে, সেটাও মিটমাট হয়ে যায় এই দিনে।

প্রেমের রঙ রঙিন, সেই কারণে একজনের প্রতি আরেকজনের প্রেম নিবেদন এবং সামাজিক মেলবন্ধনের জন্য এই উৎসব সমাজে অনেক কিছু পরিবর্তন ঘটাতে পারে, অথবা দোল উৎসব একই সাথে বসন্তের আগমন বার্তা নিয়ে আসে। আর এই উৎসব মানুষের কাছে ঋতু পরিবর্তনের একটি উৎসব হিসেবেও পরিচিত। তার সাথে সাথে নতুন বন্ধু বানানোর উপযুক্ত সময়।

ছোটরা সারাদিন রং, আবির, এই সব নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বড়রাও কাজের ফাঁকে এই খেলায় মেতে ওঠেন। কেউই বাদ পড়েন না এই উৎসব থেকে। সকলের মুখ ও শরীর রঙে রঙে রাঙানো। উৎসবের অনেক আগে থেকেই দোকানে দোকানে বিভিন্ন রঙের আবির রং বিক্রি হয়, যার মাধ্যমে জানা হয়ে যায় যে, দোল পূর্ণিমা আর বেশি বাকি নেই।

দোল পূর্ণিমা উপলক্ষে উৎসব ও মেলা:

দোল পূর্ণিমাতে শুধুমাত্র রং খেলা হয় তা কিন্তু নয়, তার সাথে পূজা-অর্চনা তো রয়েছেই এবং বিভিন্ন জায়গায় খুব বড় আকারে উৎসব ও মেলা, যেখানে সাধারন মানুষ প্রচুর পরিমাণে আনন্দ করে থাকেন। মেয়েরা সবাই ফুলের গয়না তে সেজে, একই রকমের পোশাকে, বিভিন্ন রকমের গানে নৃত্য পরিবেশন করেন, বিশেষ করে রবীন্দ্রসঙ্গীতে, এদিনের উৎসব কে আরো বেশি রঙিন করে তোলে।

এই দোল পূর্ণিমার দিন কাউকে রঙে রাঙিয়ে দেওয়ার আনন্দটাই অন্যরকম। সারা বছর এই উৎসবের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন সমস্ত বাঙালি হিন্দু। তার সাথে এদিনে চলে মিষ্টিমুখ, একজনের প্রতি আরেকজনের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, জানানো আর সব কিছু ভুলে নতুন করে জীবন যাপন শুরু করা। এক কথায় বলতে গেলে দোল পূর্ণিমা এবং দোল উৎসব যাই বলে থাকি না কেন, প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসার উৎসব, যা মানুষের জীবনে থাকাটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।


ভালোবাসার সাথে শেয়ার করুন

Leave a Comment