আনন্দ উৎসব ও হই-হুল্লোড়ের মাঝে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠান সমাপ্ত হওয়ার চার থেকে পাঁচ দিন কাটতে না কাটতেই প্রতিটি গৃহস্থ বাড়িতে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা শুরু হয়ে যায়।
বিজয়া দশমীর পর মন খারাপ টাকে একটু ভালো করার জন্য মা লক্ষ্মী সকলের বাড়িতে উপস্থিত হন। খুব কম সময়ের মধ্যেই এই লক্ষ্মী পূজার প্রস্তুতি নিতে হয়। ধন সম্পদের দেবী হওয়ার জন্য বিভিন্ন মন্দির ছাড়াও লক্ষ্মীর বরে সৌভাগ্য ফেরাতে প্রতিটি ঘরে ঘরে এই কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার আয়োজন চলে।
কেউ কেউ নিজেরাই ঘরোয়া ভাবে এই পূর্ণিমাতে দেবীর আরাধনা করে থাকেন, আবার কেউ কেউ পুরোহিত ডেকেও পূজা অর্চনা করে থাকেন। কোজাগরী লক্ষ্মী পূজাতে একটা জিনিস বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায় যে, জেলা ভিত্তিক আঞ্চলিক আচার অনুষ্ঠান বিভিন্ন জায়গা বিভিন্ন রকমের হতে পারে।
এক একটি বাড়িতে এক একটি রীতি মেনে এই লক্ষ্মী পূজার আয়োজন চলে, কিন্তু যেভাবেই পূজা করা হোক না কেন, কয়েকটি প্রয়োজনীয় উপকরণ ছাড়া এই কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা একেবারেই অসম্ভব বলা যেতে পারে।
কোজাগরী লক্ষ্মী পূজায় প্রয়োজনীয় উপকরণ
তো চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক কোজাগরী লক্ষ্মী পূজায় প্রয়োজনীয় উপকরণ গুলি সম্পর্কে:
কোজাগরী লক্ষ্মী পূজায় কোন উপকরণ গুলি প্রয়োজন পড়বে:
✨ ১) ধানের শীষ:
আমরা সকলেই জানি যে মা লক্ষ্মী ধন সম্পদের দেবী তাঁর পূজাতে প্রয়োজন হবে ধানের শীষ, তিনি শস্য শ্যামলা করে তোলেন এই পৃথিবীকে।
ধানের শীষ ছাড়া কোনভাবেই লক্ষ্মী পূজা করা সম্ভব নয়। এছাড়া যে সময়ে লক্ষী পূজা হয়ে থাকে সেই সময়ে মাঠ ভর্তি ধান এবং তাতে ধানের শীষ ও হয়ে যায়।
কোজাগরী লক্ষ্মী পূজায় যে কাজ গুলিতে প্রসন্ন হবেন দেবী লক্ষ্মী
✨ ২) বিভিন্ন উপকরণ:
ধানের শীষ ছাড়াও ঐশ্বর্যের দেবী হিসেবে লক্ষ্মী পূজায় টাকা-পয়সা, স্বর্ণমুদ্রা, পান, কড়ি, হলুদ, পাঁচ কড়াই, এক সরা, ঘট, আতপ চাল, দই, ঘি, মধু, চিনি, পূর্ণ পাত্র, চন্দ্র মালা ও হরিতকির প্রয়োজন পড়ে।
✨ ৩) কলা গাছের আঁশ:
লক্ষ্মী পূজার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল কলা গাছের আঁশ অথবা কলার পেটো। কলার পেটো দিয়ে তৈরি নৌকাকে সপ্ততরী বলা হয়।
এই তরীকে বাণিজ্যের নৌকা হিসেবে ধরা হয়, আর প্রাচীনকালে রাজারা এবং বণিকরা বাণিজ্য করতে নৌকা অথবা জাহাজে করে বাণিজ্য করতে যেতেন যা ধনসম্পদ নিয়ে ফিরে আসত, আর সেই কারণে এটি লক্ষ্মী পূজার একটি বিশেষ উপাদান।
চঞ্চলা লক্ষ্মীকে প্রসন্ন করুন লক্ষ্মী পূজায় এই ভোগ নিবেদন করে
✨ ৪) পূজার ভোগ:
প্রতিটি পূজার মতো লক্ষ্মী পূজাতে ও ভোগ নিবেদন করতে হয়। এক্ষেত্রে ব্রাহ্মণরা দেবীকে খিচুড়ি ভোগ দিয়ে থাকেন আর অ-ব্রাহ্মণরা ভোগে লুচি এবং সুজি রাখেন। পূজার শেষে এই ভোগ ভক্তদের মাঝে বিতরণ করা হয়।
✨ ৫) দেবী লক্ষ্মীর পছন্দের ভোগ:
কোজাগরী লক্ষ্মী পূজাতে আরো একটি উপাদান বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায় অথবা ভোগ বলা যেতে পারে সেটি হল নারকেল দিয়ে তৈরি নাড়ু, গুড়ের নাড়ু যা দেবী লক্ষ্মীর খুবই পছন্দের আর এই পূজাতে সেগুলি অর্পণ করা হয় দেবীর উদ্দেশ্যে।
✨ ৬) এছাড়াও আরো অন্যান্য উপাদান:
এত কিছুর পাশাপাশি ধূপদানি, পঞ্চপ্রদীপ, প্রদীপ, কর্পূর, ধূপকাঠি, বেলপাতা, ধুনুচি, দুর্বাঘাস, একটি ঘট আচ্ছাদন গামছা, একটি কুণ্ডহাঁড়ি, একটি তেকাঠি, একটি দর্পণ, পঞ্চগব্য, পঞ্চ রত্ন, পঞ্চগুঁড়ি, একটি শিস সমেত ডাব, চারটি তীর, মায়ের পছন্দের ফুল ইত্যাদি প্রয়োজন হয় লক্ষ্মী পূজায়।
✨ ৭) দেবীকে সন্তুষ্ট করার জন্য উপকরণ:
নৈবেদ্য ও ভোগের পাশাপাশি দেবী লক্ষীকে সন্তুষ্ট করতে লক্ষ্মীর শাড়ি, নারায়ণের ধুতি, পেচক পূজোর ধুতি, লোহা, সিঁদুর চুবড়ী, শঙ্খ, কাঠ, বালি, ঘট, ঘি একপোয়া, হোমের জন্য ২৮ টি বেলপাতা প্রয়োজন পড়ে।
⭐ কোজাগরী লক্ষ্মী পূজায় খেয়াল রাখুন কিছু বিষয়ের প্রতি:
এই লক্ষ্মী পূজার মোট চৌদ্দটি পাত্রে উপাচার রাখা হয়। কলাপাতায় টাকা পয়সা স্বর্ণমুদ্রা কড়ি, ধান, পান, হলুদ ও হরিতকি দিয়ে সাজানো হয় পূজার স্থানটিকে।
পূজার স্থানে একটি তামার পাত্রে জল রাখতে হয় সেই জল সূর্য দেবতাকে অর্পণ করা হয়। তারপর ঘট স্থাপনের জন্য প্রয়োজন হয় ঘট, নারকেল ও আম পাতার। দেবী লক্ষ্মীর পুজো বেশি জাঁকজমকপূর্ণ হয় না, তবে খেয়াল রাখতে হবে কিছু বিষয়।
⭐ পৌরাণিক কাহিনী:
অনেকেই হয়তো জানবেন যে লক্ষ্মী পূজায় তুলসী পাতা ব্যবহার করা হয় না। বিষ্ণু পুরাণ, ভাগবত, মহাভারত প্রভৃতি গ্রন্থ অনুসারে দেবী লক্ষ্মীর উৎপত্তি হয়েছে সমুদ্র থেকে। দুর্বাসা মুনির অভিশাপে স্বর্গ শ্রী হীন বা লক্ষ্মীছাড়া হয়ে যায়। তখন বিষ্ণুর পরামর্শের স্বর্গের ঐশ্বর্য ফিরে পাওয়ার জন্য দেবগণ ও সূর্যের সাথে নিয়ে সমুদ্র মন্থন শুরু করেন।
আর সেই সমুদ্রমন্থন এর ফলে ক্ষীর সমুদ্র থেকে উঠে আসে নানা ধরনের রত্ন, মনি মানিক্য, অমৃত কলস, আরো কত কি। এসব ছাড়াও সমুদ্র মন্থনের ফলে উঠে আসলেন দেবী লক্ষ্মী এবং ঠাঁই পেলেন বিষ্ণুর বক্ষে।
আমরা যেহেতু নারায়ণের পূজা করি তুলসী পাতা দিয়ে, তাই তুলসী পাতাকে দেবী লক্ষ্মীর সতীন হিসেবে বিবেচিত করা হয় তাই লক্ষ্মীপূজায় তুলসী পাতা ব্যবহার করা যায় না।
⭐ রইল কিছু বিধি নিষেধ:
কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার নিষ্ঠা ভরে পালন করছেন অথচ এমন কিছু বিধি-নিষেধ রয়েছে সেগুলি আপনি জানেন না। তাহলে কিন্তু আপনি দেবী লক্ষীকে সন্তুষ্ট করার পরিবর্তে রুষ্ট করতে পারেন।
- একইভাবে দেবীর ভোগ তৈরি থেকে শুরু করে পূজোর কোন জায়গায় লোহার বাসন ব্যবহার করা যাবে না, এমনকি স্টিলের বাসনা ব্যবহার করতে পারবেন না। এটা কিন্তু দেবী লক্ষ্মী অসন্তুষ্ট হতে পারেন প্রয়োজনের কাঠের তৈরি বাসন ব্যবহার করতে পারেন।
- অন্যদিকে দেবী লক্ষ্মী পছন্দ করেন না কোন শব্দ, আড়ম্ভর, কোলাহল, তাই এই পূজা খুবই শান্তির সাথে নিঃশব্দে করতে হয় শুধুমাত্র শঙ্খধ্বনি দিয়ে। যেখানে কাঁসর ঘন্টা কোন ভাবেই বাজাতে নেই।
- নরম সুরে মন্ত্র পাঠের মাধ্যমেই দেবীর আরাধনা করতে হয়। লক্ষ্মীর পাঁচালী ও পড়তে হয় নরম ও মধুর সুরে।
- দেবীর আরাধনা করার সময় সাদা ও কালো বস্ত্রের ব্যবহার কোনোভাবে করবেন না।
- এমনকি যিনি দেবীর পূজা করবেন তিনিও যেন এই দুই রঙের বস্ত্র না পরে থাকেন সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে বিশেষভাবে।
বাড়িতে যেহেতু দেবী লক্ষ্মী পূজা নিতে চলে আসেন তাই তিনি অল্পতেই খুবই সন্তুষ্ট হন। আর শুধুমাত্র তাঁর পছন্দের উপকরন গুলি দিয়েই আপনি খুব সহজেই ভক্তি দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারবেন এবং নিজের বাড়িতে আজীবনের জন্য বন্দী করে রাখতে পারবেন।
কোজাগরী লক্ষ্মী পূজায় মনের মত ফল পেতে এই কাজগুলি ভুলেও করবেন না
তবে এই কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার একটি বিশেষ বিষয় হলো রাত জেগে দেবীর আরাধনা করা। আপনি যতই রাত জাগতে পারবেন দেবী কিন্তু ততই আপনার উপরে প্রসন্ন হবেন। হয়তো দেখা যেতে পারে যে আপনার পূজাতে সন্তুষ্ট হয়ে তিনি আপনার ঘরেতেই আগমন করলেন।
তাই লক্ষ্মী পূজা করার আগে আপনাকে বিশেষ কিছু বিষয়ের প্রতি খেয়াল রেখে দেবীকে আরাধনা করতে হবে, আর নিজের ভক্তি নিবেদন করতে হবে।