আনারস একটি সুস্বাদু ফল। এটি বহুল পরিচিত ও পুষ্টিকর একটি ফল। আনারস সাধারনত পাহাড়ি অঞ্চলে বেশি চাষ হয়ে থাকে। বর্তমানে আনারস দিয়ে জ্যাম, জেলি ও আচার তৈরি করা হয়ে থাকে।
আমাদের বাংলাভূমি সাইটে নিয়মিত আমরা আপনাদের সাথে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করে থাকি। এর ফলে আপনারা কৃষি জমি, শিক্ষা, অর্থনীতি এসব বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে থাকেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রয়োজনে আপনারা এ সকল তথ্য থেকে উপকৃত হয়ে থাকেন।
এরই ধারাবাহিকতায় আজ আমরা আপনাদের সাথে আনারস চাষের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব। এতে করে আপনারা সহজেই আনারস চাষের বিস্তারিত জানতে পারবেন।
চলুন দেখে নেই আনারস চাষের বিস্তারিতঃ
জমি ও মাটিঃ
আনারস চাষের জন্য উচু জমি দরকার হয়। জমিতে জল জমে না এমন জমি নির্বাচন করতে হবে। সাধারনত দোআঁশ বা বেলে দোআঁশ মাটি আনারস চাষের জন্য খু্বই উপযোগী।
রোপন সময়ঃ
অক্টোবর মাস থেকে নভেম্বর মাসে আনারস চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়।। তবে সেচের সুবিধা থাকলে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত চারা রোপন করা যেতে পারে।
বংশবিস্তারঃ
আনারসের বংশ বিস্তার বীজের মাধ্যমে হয় না। বিভিন্ন ধরনের চারার মাধ্যমে আনারসের বংশ বিস্তার হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে পার্শ্ব চারা , বোটার চারা, মুকুট চারা ও গুড়ি চারা দিয়ে আনারসের বংশ বিস্তার করা হয়ে থাকে।
এদের মধ্যে পার্শ্ব চারা সবচেয়ে ভালো । বিভিন্ন জায়গা থেকে চারা পাওয়া যায়। পাতার কক্ষ থেকে, মাটির কাছের পাতা থেকে, বোটার পাশ থেকে, মুকুট থেকে বা পুরনো গাছের গোড়া থেকে ও চারা পাওয়া যায়।
তবে পাতার কক্ষ থেকে যে চারা পাওয়া যায় সেটি সবথেকে ভালো হয়ে থাকে।
জমি তৈরিঃ
জমি ভালোভাবে মই দিয়ে তৈরি করে নিতে হবে। জমির মাটি সমতল করে নিতে হবে। জমিতে যেন বৃষ্টির জল জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এরপর বেড তৈরি করতে হবে।
বেড জমি থেকে ১৫ সেমি উচু হবে এবং ১ মিটার প্রশস্ত হবে। এক বেড থেকে অন্য বেডের মাঝে ৫০-১০০ সেমি জায়গা রাখতে হবে। আনারস সাধারনত পাহাড়ের ঢালে ভালো হয়।
তবে পাহাড়ের ঢালে চাষের সময় জমি কখন ও আলগা করা যাবে না। শুধু আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে।
চারা রোপন ও সার ব্যবস্থাপনাঃ
আনারসের ভালো ফলন পেতে হলে পরিমিত মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হবে। জৈবসার সহ অন্যান্য সব ধরনের সার ই প্রয়োজন অনুযায়ী প্রয়োগ করতে হবে। জৈব সার প্রয়োগ করলে মাটির গুনাগুন ভালো থাকবে।
এক মিটার প্রশস্ত বেড তৈরি করে তাতে দুই সারিতে চারা রোপন করতে হবে। ৫০ সেমি দূরে দূরে লাইনে ৩০-৪০ সেমি দূরে চারা লাগাতে হবে। চারা যদি বেশি লম্বা হয়ে যায় তাহলে ৩০ সেমি রেখে বাকি টা কেটে দিতে হবে। চারা রোপন করার পর গোড়ার মাটি ভালোভাবে চেপে দিতে হবে।
সার ব্যবস্থাপনাঃ
প্রতি গাছে গোবর সার ৩০০ গ্রাম, ইউরিয়া ৩৫ গ্রাম, টিএসপি ১৫ গ্রাম, এমওপি ৩৫ গ্রাম ও জিপসাম ১৫ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে।
গোবর , জিপসাম ও টিএসপি বেড তৈরি করার সময় মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। তারপর ইউরিয়া ও এমওপি সার চারা রোপন করার ৪-৫ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে।
সবগুলো সার ৫-৬ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স ৭-৮ মাস হলে একই ভাবে আবার এই সার প্রয়োগ করে দিতে হবে।
সেচ ও নিকাশঃ
আনারস চাষে জমিতে নিয়মিত সেচ দিতে হবে। বিশেষ করে শুকনা মৌসুমে জমিতে সেচ দেওয়া খুবই দরকার।
গাছের গোড়ায় যেন অতিরিক্ত জল জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে নালা তৈরি করে দিতে হবে যেন অতিরিক্ত জল বের হয়ে যায়।
আগাছা দমনঃ
চারা বেশি লম্বা হয়ে গেলে তা ছাটাই করে দিতে হবে। আর জমি সব সময় আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। প্রতি বছরে দুই বার আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে।
জমিতে সেচ দেওয়ার পর ও সার প্রয়োগ করার পর মালচ দিয়ে দিলে জমি আগাছা মুক্ত থাকে ভালো। এতে জমির উর্বরতা ও বৃদ্ধি পায়।
রোগ দমন ব্যবস্থাপনাঃ
গাছে রোগ আক্রমন করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। আনারসের সাধারনত ফল পচা ও কান্ড পচা রোগ হয়ে থাকে। রোগ আক্রমণ করলে উপযুক্ত ছত্রাকনাশক স্প্রে করে রোগ দমন করতে হবে।
সাথী ফসলঃ
আনারসের সাথে বিভিন্ন সাথী ফসল চাষ করা যায়। আদা , সয়াবিন, কলাই, কচু , সরিষা ইত্যাদি ফসল চাষ করা যায়। পাহাড়ি এলাকায় আনারস চাষ করলে বিভিন্ন ফল গাছের বাগানের ভেতর এটি চাষ করা যায়।
কিন্তু এক্ষেত্রে আগাছা পরিষ্কার করা, চারার শূণ্যস্থান পূরণ করা ,সার প্রয়োগ ও বালাই ব্যবস্থাপনার দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।
ফল সংগ্রহঃ
চারা রোপন করার ১৫-১৬ মাস পর থেকেই আনারস গাছে ফুল আসে। অর্থাৎ মাঘ মাসের মধ্য থেকে চৈত্র মাসের মধ্য পর্যন্ত সময়ে গাছে ফুল আসে।
আর বৈশাখ মাস থেকে জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে ভাদ্র মাসের মাঝ থেকে আশ্বিন মাসের মাঝ পর্যন্ত সময়ে ফল পাকে। ফল পরিপক্ক হলে তা সংগ্রহ করতে হবে। তবে কিছু কিছু জাত আছে যা সারা বছর ফল দেয়।
সঠিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করতে পারলে ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব।
ফলনঃ
জাত অনুযায়ী আনারসের ফলনে ভিন্নতা দেখা দেয়। সাধারনত জাত ভেদে আনারস প্রতি হেক্টরে ১৫ থেকে ৪০ টন পর্যন্ত উৎপাদিত হয়ে থাকে।