বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির, ঝাড়খন্ড – Baidyanath Jyotirlinga Temple

বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির (Baidyanath Jyotirlinga Temple): হিন্দুদের বিভিন্ন ধরনের তীর্থস্থানের মধ্যে বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির হল একটি। বিশেষ তীর্থস্থান যা কিনা বৈদ্যনাথ ধাম নামেও পরিচিত। হিন্দু দেবতার শিবের বারটি পবিত্রতম জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরের অন্যতম জ্যোতিরলিঙ্গ মন্দির হল এই বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির।

এই মন্দিরটি ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের দেওঘর জেলার দেওঘর শহরে অবস্থিত। বৈদ্যনাথ মন্দির চত্বরে মূল বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গের মন্দির ছাড়াও আরো ২১ টি মন্দির সেখানে অবস্থিত রয়েছে।

বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির, ঝাড়খন্ড - Baidyanath Jyotirlinga Temple
বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির, ঝাড়খন্ড – Baidyanath Jyotirlinga Temple

এই মন্দিরের সৃষ্টিকর্তা পুরান অনুসারে বিশ্বকর্মা হিসাবে মনে করা হয়। প্রতিটি তীর্থস্থানের পিছনে রয়েছে অজানা রহস্য, ইতিহাস। তাই এই বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরের পিছনেও রয়েছে ইতিহাস। তো চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক সেই ইতিহাস সম্পর্কে।

বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরের ইতিহাস: 

হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস অনুসারে রাবণ এখানে শিবকে খুশি করার জন্য তপস্যা করেছিলেন। তিনি তার দশটি মাথা একটি একটি করে কেটে যজ্ঞের আগুনে আহুতি দিয়েছিলেন এই স্থানে। এতে শিব সন্তুষ্ট হয়ে আহত রাবনকে সুস্থ করে তুলতে আসেন এই জায়গায়।

বৈদ্য বা চিকিৎসকের ভূমিকা তে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি, সেই কারণে এখানে শিবের মূর্তি অথবা জ্যোতিরলিঙ্গকে বৈদ্যনাথ বলা হয়। তার সাথে সাথে মন্দিরের নাম ও বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির হয়ে গিয়েছে।

বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গের অবস্থান নির্ণয় নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি: 

শিব পুরাণের কটি রুদ্র সংহিতায় বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, বৈদ্যনাথ চিতা ভূমৌ এই শ্লোক এর মধ্য দিয়ে বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গের অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়। অন্যদিকে উক্ত গ্রন্থের একই অংশে বলা হয়েছে যে বৈদ্যনাথ পারুলিতে অবস্থিত, যেটা আধুনিক মহারাষ্ট্র রাজ্যে অবস্থিত।

তিনটি মন্দির প্রকৃত বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির বলে দাবি করে সেগুলি হল:-

১) বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির, দেওঘর, ঝাড়খন্ড।

২) বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির, পারুলি, মহারাষ্ট্র।

৩) বৈদ্যনাথ মন্দির, বৈদ্যনাথ, হিমাচল প্রদেশ।

দেওঘর পূর্ব ভারতে অবস্থিত আবার অন্যদিকে পারুলির অবস্থান পশ্চিম মধ্য ভারতের। এ ছাড়া চিতাভূমি শব্দটির উল্লেখ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রাচীনকালে এই মন্দিরের কাছে একটি শ্মশান ছিল, কাপালিক বা ভৈরব সাধনায় শিবকে শ্মশান ভূমিতে পূজা করা হয় বলে মনে করা হয়।।

হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস অনুসারে সে অরিন্দ্রা নক্ষত্রের রাত্রিতে প্রথম জ্যোতিরলিঙ্গ রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। সেই পুরানের সংহিতায় দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ এর নাম ও অবস্থানে উল্লেখ করতে দেখা গিয়েছে। এছাড়া বৈদ্যনাথ মন্দিরটি ৫১ টি শক্তি পিঠের মধ্যে অন্যতম। এখানে সতীর হৃদয় পড়েছিল। সেই জন্য এটি কে হৃদয় পিঠ ও বলা হয়। পার্বতী এখানে দুর্গা নামেও পুজিত হয়ে আসছে অনেক দিন আগে থেকে এবং বৈদ্যনাথ তার ভৈরব।

বিভিন্ন রকম গ্রন্থ যেমন ধরুন দেবী ভাগবত পুরাণ, কালিকা রহস্য, মূল্যমালা তন্ত্র ও রুদ্রযামলে বৈদ্যনাথের শক্তি পিঠের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ সকল গ্রন্থে বৈদ্যনাথকে একটি জনপ্রিয় তন্ত্রসাধনার ক্ষেত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তান্ত্রিক গোপীনাথ কবিরাজ ও বৈদ্যনাথ ধামকে একটি তন্ত্র সাধন হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

বৈদ্যনাথ মন্দিরের পৌরাণিক কাহিনী: 

শিব পুরাণের কাহিনী অনুসারে ত্রেতা যুগের লঙ্কার রাজা রাবণ, তিনি চেয়েছিলেন যে তার রাজধানী হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সকল শত্রু থেকে মুক্ত। তার মনে হয়েছিল যদি শিব সেখানে স্থায়ী হয়ে বসবাস শুরু না করেন তবে তা হওয়া কখনই সম্ভব নয়।

তিনি তপস্যা শুরু করেন সেই আশা নিয়ে, শিব সন্তুষ্ট হয়ে তাকে একটি শিবলিঙ্গ লঙ্কায় প্রতিষ্ঠার জন্য দান করে যান। তখন শিব বলেছিলেন সেই শিবলিঙ্গটি অন্য কোথাও যেন স্থাপন না করা হয় এবং অন্য কারো হাতে না দেওয়া হয়।

এমনকি লঙ্কায় যাত্রা পথে ও কোথাও যেন না থামা হয়। রাবণ যদি অন্য কোথাও পৃথিবীতে এই শিবলিঙ্গটি স্থাপন করে থাকেন তবে সেটি সেখানেই চিরতরে থেকে যাবে। রাবণ খুশি হয়ে শিবলিঙ্গটি নিয়ে লঙ্কার পথে যাত্রা শুরু করে।

অন্যান্য দেবতারা এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিলেন। শিব যদি রাবণের সঙ্গে লঙ্কায় যান, তবে রাবণ অজেয় হয়ে যাবে। তখন তিনি পৃথিবীর উপর অকথ্য অত্যাচার চালাবেন বলে দেবতারা মনে করেছিলেন। তাই তারা রাবণকে ছলনা করার পরিকল্পনার শুরু করলেন।

দেবতারা, জল দেবতা বরুনকে রাবণের পেটে প্রবেশ করার অনুরোধ করলেন। তখন কৈলাস পর্ব থেকে ফেরার পথে রাবণের মূত্র ে পায় খুব জোর। তখন তিনি এমন কাউকে খুঁজতে লাগলেন যাকে খানিকক্ষণের জন্য শিবলিঙ্গটি দিয়ে মূত্র ত্যাগ করতে যাবেন। কিন্তু মূত্র ত্যাগ করতে রাবনের অনেক সময় লেগে গেল।

এদিকে ব্রাহ্মণবেসী বিষ্ণু শিবলিঙ্গ মাটিতে স্থাপন করলেন আর সেই স্থানে এখন বৈদ্যনাথ জ্যোতিরলিঙ্গ মন্দির অবস্থিত। রাবণ শিবলিঙ্গটি মাটি থেকে তোলার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনি একটুও সেই শিব লিঙ্গটি নাড়াতে অসমর্থ্য হয়ে পড়েন।

বারবার প্রচেষ্টা শুরু করতে থাকেন সেই শিবলিঙ্গটি সেই জায়গা থেকে নাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তার বুড়ো আঙ্গুলের আঘাতে লিঙ্গের এক টুকরো অংশ ভেঙে ফেলা ছাড়া আর কিছুই করতে তিনি পারলেন না।

নিজের এই কৃতকর্মের জন্য শিবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। এদিকে রাবণ যে শিবলিঙ্গটি লঙ্কায় নিয়ে যেতে পারলেন না, তা দেখে কিন্তু দেবতা দের আনন্দের সীমা থাকল না। রাবণ প্রতিনিয়ত সেই স্থানে এসে শিব লিঙ্গটি পূজা করে যেতেন। এমন ভাবে তিনি সারা জীবন বৈদ্যনাথ শিবলিঙ্গের পূজা করেছিলেন।

যেখানে রাবণ পৃথিবীতে নেমে এসেছিলেন সেটি বৈদ্যনাথ থেকে চার মাইল দূরে গরিলাজরি নামে একটি জায়গা হিসেবে অনেকেই বিশ্বাস করেন। যে জায়গায় শিবলিঙ্গটি মাটিতে রাখা হয়েছিল সেটি অধুনা দেওঘর শহরে অবস্থিত।

আবার অন্যদিকে কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, রাবণের মৃত্যুর পর বৈদ্যনাথের লিঙ্গটি একেবারে অযত্নে পড়েছিল। বৈজু নামে এক ব্যাধ সেই শিবলিটি দেখতে পান এবং তার দেবতা বলে গ্রহণ করে প্রতিনিয়ত পূজা শুরু করে দেন। তিনিই এটিকে বৈদ্যনাথ নাম দেন।

এছাড়া সারা বছর ধরে পর্যটকদের ভিড় এখানে চোখে পড়ার মতো। তবে তার মধ্যে শিবের পুজোর দিনগুলিতে, আরো বিশেষ করে শ্রাবণ মাসে এই তীর্থস্থানে অর্থাৎ এই বৈদ্যনাথ মন্দিরে পর্যটক আর ভক্তদের ভিড় উপচে পড়ে।

বিশেষ করে মহা শিবরাত্রির দিন এখানে পূজা পার্বণের জাকজমক চোখে পড়ার মতো। এদিন ভক্তি মনে পূজা করলে বাবা ভোলেনাথের ভক্তদের মনোকামনা পূরণ হয় বলে বিশ্বাস করেন অনেকেই। মাঘ মাসে কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে শিবরাত্রি পালন করা হয় এখানে খুবই ধুমধাম ভাবে।

আমরা সবাই জানি যে, মহিলারা স্বামীর মঙ্গল কামনায় এবং অবিবাহিত মেয়েরা শিবের মতো স্বামী পাওয়ার মনোবাসনা নিয়ে এই দিন উপবাস রাখেন। তবে শুধু বিবাহিত মহিলা নন, অবিবাহিত মহিলা এবং অনেক পুরুষও এই ব্রত পালন করেন নিষ্ঠা ভরে।

প্রচলিত কথা এবং বিশ্বাস অনুযায়ী বলা যায় যে, অবিবাহিত মেয়েরা এই ব্রত পালন করেন যাতে তাদের শিবের মত বর প্রাপ্ত হয়। যাকে তারা আদর্শ পুরুষ হিসেবে মনে করবেন। তবে সবটাই মনের উপর নির্ভর করে। ভক্তি ও নিষ্ঠার সঙ্গে শিবরাত্রি ব্রত পালন করলে পূন্য হয় বলে হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস আর সেই বিশ্বাস প্রাচীনকাল থেকে এখনো পর্যন্ত চলে আসছে যা ভবিষ্যতেও চলবে। তাছাড়া এই বিশ্বাসের পিছনে রয়েছে অনেক পৌরাণিক ইতিহাস ও কাহিনী।

তীর্থযাত্রীদের জন্য এই বৈদ্যনাথ ধাম একটি বিশেষ জায়গা হতে পারে। যদি কেউ তীর্থ করতে যান এবং এমনই একটি পবিত্র স্থানে ভক্তি ও নিষ্ঠা ভরে পূজা করতে চান, তাহলে বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির অর্থাৎ বৈদ্যনাথ ধাম সবচেয়ে ভালো জায়গা হতে পারে আপনার জন্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top