ভীমাশঙ্কর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির, মহারাষ্ট্র – Bhimashankar Jyotirlinga Temple

ভীমাশঙ্কর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির (Bhimashankar Jyotirlinga Temple): শিবের ১২ টি জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে ভীমশংকর জ্যোতির্লিঙ্গ হল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। স্কন্ধ পুরাণ, ব্রহ্মা-বৈবর্ত পুরাণ, কালিকাপুরাণ, পদ্মপুরাণ এবং আরো অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে শিব লিঙ্গ অথবা জ্যোতির্লিঙ্গের উৎপত্তি সম্বন্ধে অনেক কাহিনী লেখা আছে।

ভীমাশঙ্কর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির, মহারাষ্ট্র - Bhimashankar Jyotirlinga Temple
ভীমাশঙ্কর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির, মহারাষ্ট্র – Bhimashankar Jyotirlinga Temple

স্বয়ং শিবের অবতার আচার্য শঙ্কর অগণিত লিঙ্গ মূর্তির মধ্যে থেকে মাত্র বারটি শিবলিঙ্গকে জ্যোতির্ময় বলে চিহ্নিত করেছেন। অন্যান্য জ্যোতিরলিঙ্গ মন্দিরের মতো এই জ্যোতিরলিঙ্গ মন্দিরের পেছনে রয়েছে পৌরাণিক কাহিনী:

ভীমাশঙ্কর জ্যোতিরলিঙ্গ মন্দিরের ইতিহাস ও পৌরাণিক কাহিনী: 

পুরাণ কাহিনী অনুসারে শ্রীরাম চন্দ্রের হাতে কুম্ভকর্ণ নিহত হওয়ার পর মায়ের সঙ্গে ভীম গভীর অরণ্যে থাকতেন। একদিন তার মা কর্কটিকে এই নির্জন অরণ্যে থাকার কারণ জিজ্ঞাসা করেন তার পিতা নিহত হওয়ার ঘটনা শুনে ভীম ভীষণ রেগে যান। আর মনস্থির করেন যে, তপস্যা করে শক্তি লাভ করে পুনরায় ত্রিভুবনের রাক্ষস রাজ প্রতিষ্ঠা করবেন। ভীম হাজার বছর ধরে সূর্যের দিকে তাকিয়ে কঠিন তপস্যায় মগ্ন হলেন এবং ব্রহ্মার বরে বলিয়ান হয়ে সর্বোপরি আক্রমণ করে দেবতাদের স্বর্গ চ্যুত করে ছাড়লেন।

এমনকি দেবদেবীদের পূজা মর্ত্যেও বন্ধ হয়ে গেল। অত্যাচারিত মানুষের দীর্ঘশ্বাসের তপ্ত হয়ে ওঠে মর্ত্যের বায়ুমণ্ডল।  সুদিক্ষণ নামে এক রাজা শিব ভক্ত ছিলেন খুবই তিনি ভীমের আদেশ অমান্য করে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে নির্জন বনের মধ্যে একা শিব আরাধনায় মগ্ন হয়ে পড়লেন।

ভীমের নির্দেশে রাজা কে বন্দী করা হলো এবং সেই রাজার উপরে অন্যায় অত্যাচার শুরু হয়ে গেল। তবুও তিনি প্রতিদিন কারাগারের ভিতরে মাটির শিবলিঙ্গ তৈরি করে গভীর ধ্যানের মগ্ন থাকতেন। এই সমস্ত দেখে ভীম তাকে হত্যা করার হুমকি দিয়ে বলেন যে, “চিরকালের মত তোর শিবের আরাধনা বন্ধ করে দেব।”

এই বলে ভীম তরবারি তুলে রাজাকে আঘাত করতে যাবে ঠিক সেই সময় শিবলিঙ্গ থেকে স্বয়ং শিব সম্ভু আবির্ভূত হয়ে সেটা থামিয়ে ছিলেন। এই সব কিছু ভীম সহ্য করতে না পেরে মাটিতে পড়ে মারা গেলেন, সমস্ত দেবতা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেন, দেবাদিদে মহেশ্বর এর পূজা করার জন্য। রাজা সুদিখন হাতজোড় করে দেব-দেবীদের কাছে প্রার্থনা করলেন এই রক্ষা করার জন্য।

নির্জন জায়গায় শিবের আরাধনা করার ফলে নির্জন জায়গায় মন্দির কে ঘিরে রয়েছে ছোট জনপদ। এখান থেকে পূজার উপকরণ কিনে নিয়ে যেতে পারা যাবে। দুপাশে রয়েছে সবুজ জঙ্গল, মাঝখানে ১৬৫ পাথরের সিড়িপথ একেবারে সোজা নিচে নেমে গেছে।

পথের একেবারে শেষে কারুশিল্প সমৃদ্ধ কালো গ্রানাইট পাথরের ছোট্ট মন্দির প্রথমে নাট মন্দির এবং পরে গর্ভ মন্দির। সামান্য ফাটলের মত চিহ্ন রয়েছে সেখানে দিয়ে অতি ক্ষীন ধারায় হালকা হালকা জল পরছে, শিবলিঙ্গের একধারে শিব এবং অন্যধারে পার্বতী। মধ্যিখানে ভীমা নদী।

আর পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মনে করা হয় যে, বিমা নদীর এটাই নাকি উৎপত্তিস্থল। এই নদী খুবই হালকা ক্ষীন ধারায় নালা দিয়ে বনের পথ ধরে চলে গিয়েছে বহুদূরে, আর গিয়ে মিশেছে কৃষ্ণা নদীতে।

মহা শিবরাত্রি, অঘোর চতুর্দশী এবং বৈকন্ঠ চতুর্দশীতে বহু দূর দূরান্ত থেকে ভক্তরা এই মন্দিরে আসেন শিবের উপাসনা করতে। এই উপলক্ষে এখানে মেলাও বসে বিশাল বড়। ভীম শংকর দর্শন করতে এবং তার পূজা করতে পর্যটক এবং ভক্তদের আনাগোনা সারা বছর ধরে চলে। এখানে পূজা করলে সিদ্ধি লাভ হয় বলে মনে করা হয়। আর সেই কারণে অকাল মৃত্যু রোধ করার জন্য কোটি কোটি ভক্ত ভীম শংকরের আরাধনা করে থাকেন।

ভীম সংকর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরের কাঠামো: 

ভীম শঙ্কর মন্দিরটি পুরানো এবং নতুন কাঠামোর সংমিশ্রণে, নাগারা স্থাপত্য শৈলী এটি প্রাচীন বিশ্বকর্মা ভাস্করদের দ্বারা দক্ষতা অর্জনের উৎসাহ দেখায়। এটি একটি বিনয়ী তবুও মনোমুগ্ধকর মন্দির। যদিও দিন বদলের সাথে সাথে এখনকার কাঠামো সম্পূর্ণ রূপে নতুন মন্দির ভিম সংকর খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর সাহিত্যে উল্লেখ করা হয়েছে মন্দিরের সামনে একটি বিশাল বড় অনন্য ঘন্টা দেখা যায়। যেটা রোমান শৈলী দিয়ে তৈরি। এই ঘন্টাটিতে যীশুর সাথে মা মেরির একটি প্রতিমা রয়েছে।

ভীম সংকর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরটি একটি প্রাচীন মন্দির। বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে এটি একটি বিশেষ জ্যোতিরলিঙ্গ, শহরের জনবহুল চাঞ্চল্য জীবনের অশান্তি থেকে অনেক দূরে সাদা মেঘের মধ্যে উঁকি দিয়ে ভীমশংকর সম্পর্কে একটি তীর্থযাত্রা স্বর্গ হিসাবে অভিহিত করা যেতে পারে। কেননা চারিদিকে ঘন অরণ্য, বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ এবং প্রাণীকুলের বসবাস এই জায়গাটির স্থানীয় নদী এবং হিল স্টেশন গুলির চারপাশে বিশ্বের একটি দুর্দান্ত দৃশ্য চোখে পড়ার মতো।।

মনে করা হয় যে, শিব স্বয়ং এখানে বিরাজ করে সবকিছু নিরবে দেখছেন, নির্মলতা, শীতল বাতাসের মধ্যে দিয়ে পাখির চিৎকার সব কিছু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে ভীমশংকর  জ্যোতিরলিঙ্গ মন্দির আপনার মন জয় করে নেবে।

ভীম শঙ্কর জ্যোতিরলিঙ্গ মন্দিরের পূজার নিয়ম ও সময়:

প্রতিদিন তিনটি পূজা দেওয়া হয়। মহা শিবরাত্রি এখানে খুবই বড় ভাবে অনুষ্ঠিত হয়। স্টেপ বাই স্টেপ একটা একটা পূজার অনুষ্ঠান মন্দির খোলা থেকে শুরু করে বন্ধ পর্যন্ত প্রতিদিন চলতে থাকে নিয়ম অনুসারে।

মন্দির খোলার সময়: ভোর ৪ টে ৩০ মিনিট

সকালের আরতি: সকাল ০৪:৪৫ থেকে ৫ টা পর্যন্ত।

নিজেরূপ দর্শন: সকাল পাঁচটা থেকে ৫:৩০ পর্যন্ত

সাধারণ দর্শনা এবং অভিষেকাম: সকাল ৫:৩০ টা থেকে দুপুর ২:৩০ টা পর্যন্ত।

এই সময়ের মধ্যে কোন অভিশেকাম নয়: রাত ১২ টা ১২ থেকে ১২ টা ৩০ পর্যন্ত।

মহা পূজা /নৈবেদ্য পূজা: রাত ১২ টা থেকে রাত ১২ টা ৩০ পর্যন্ত।

দুপুরের আরতি: বিকেল ৩ টা থেকে ৩:৩০ টা পর্যন্ত।

শৃঙ্গার দর্শন: ভোর ৩:৩০ টে থেকে সকাল ৯:৩০ টা পর্যন্ত।

সন্ধ্যা আরতি: সন্ধ্যা ৭:৩০ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত।

প্রতিদিনের পূজা আরতি ছাড়াও মহা শিবরাত্রিতে এই শিব মন্দিরে খুবই জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে মহা শিবরাত্রি পালন করা হয়। তার জন্য অনেক দূর থেকে মানুষ এসে শিবরাত্রির উপবাস ও পূজা করে থাকেন। সেই সময় এখানে ভক্তদের ও পর্যটকদের ভিড় বেশ ভালো মতোই লক্ষ্য করা যায়।

তবে যাই হোক না কেন, চারিদিকে সবুজ বনানির মধ্যে এই ছোট্ট শিব মন্দির মানুষকে আকর্ষণ করে, আর বিশ্বাস করা হয় যে এখানে নিষ্ঠা ভরে পূজা করলে সকল মনের ইচ্ছা পূরণ হয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top