(Shondesh Shakti Peeth in Bengali) শোন্দেশ শক্তিপীঠের বর্তমান অবস্থান কোন স্থানে? দেবী সতীর কোন অঙ্গ এখানে পতিত হয়েছে? শোন্দেশ শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী কি? কিভাবে আরাধনা করা হয়? এই মন্দিরের তাৎপর্য কি? জানুন সবকিছু বিস্তারিত।
হিন্দু ধর্মাবলম্বী দের কাছে প্রতিটি শক্তি পীঠ অনেক খানি গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র তীর্থস্থান। এখানে একটিবার ঘুরে আসার জন্য অনেকেই অপেক্ষা করে থাকেন বহু বছর ধরে। কাহিনী অনুসারে সতীর দেহ অংশ গুলি যে যে জায়গায় পতিত হয়েছিল সেখানে সেখানে গড়ে উঠেছে এক একটি সতী পীঠ।
তেমনি একটি স্থান হল শোন্দেশ সতীপীঠ, শোন্দেশ মন্দিরটি মধ্যপ্রদেশের অমরকন্টক এ অবস্থিত। এটি ৫১ টি সতী পীঠের মধ্যে একটি অন্যতম সতীপিঠ অনুসারে এখানে সতীর ডান নিতম্ব পড়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী নর্মদা এবং ভৈরব হলেন ভদ্রসেন। আবার নর্মদা দেবীর মন্দির নামে ও পরিচিত অনেকের কাছে।
শোন্দেশ শক্তিপীঠ:
শক্তিপীঠের নাম | শোন্দেশ শক্তিপীঠ |
স্থান | শোন্দেশ, অমরকণ্টক, নর্মদা নদীর উৎস এর নিকট, মধ্যপ্রদেশ |
দেশ | ভারত |
দেবীর অংশ | ডান নিতম্ব |
শক্তির নাম | নর্মদা |
শোন্দেশ শক্তি পীঠের পৌরাণিক কাহিনী:
পূরানের কাহিনী অনুসারে আমরা জানি যে, যখন দেবী পার্বতী বাবার অমতে মহাদেবকে বিবাহ করেছিলেন, তখন এই বিবাহ মেনে নিতে পারেন নি দেবীর বাবা। সেই কারণে সতী দেবীর সামনে মহাদেব কে অনেক অপমান করতে শুরু করেন। স্বামীর সেই অপমান সহ্য করতে না পেরে নিজের বাপের বাড়িতেই দেহ ত্যাগ করেছিলেন দেবী।
মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছাতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন। দেবীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মাদ হয়ে যান মহাদেব। সেই রাগে সতীর বাবা দক্ষ রাজাকে হত্যা করে সতীর মৃতদেহ কাঁধে করে নিয়ে তান্ডব নৃত্য শুরু করেন। মহাদেবের এই তাণ্ডব নৃত্য তে পৃথিবীর বুকে সৃষ্টি হয় মহাপ্রলয়, সেই প্রলয় এ পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।
এমন পরিস্থিতিতে শ্রীবিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে মাতা সতীর দেহটি ৫১ টি খন্ডে খন্ডিত করেন। আর সেই দেহ খন্ড গুলি, পৃথিবীর বুকে যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়। আর কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, এই শোন্দেশ শক্তিপীঠে সতীর ডান নিতম্ব মাটিতে পড়েই জন্ম হয়েছে এই সতী পীঠের।
অমরকন্টক এর অর্থ:
সতীর এই সতী পীঠ অমরকন্টকে অবস্থিত। সংস্কৃতে অমরকন্টক শব্দের অর্থ হলো অমরত্বের পথে বাধা, অনেকেই আবার মনে করেন যে, এই অমরকন্টকে ঈশ্বরের অধিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু তাতে রুদ্রগনেরা বাধা দেওয়ার কারণে ঈশ্বর সন্তুষ্ট নন।
পুরানে বলা হয়েছে যে, মহাদেব যখন ত্রিপুরকে অর্থাৎ তিনটি শহরকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ভষ্মিভূত করেছিলেন সেই সময় কিছু ভস্ম অথবা ছাই পড়েছিল কৈলাসে। কিছুটা পড়েছিল অমর কণ্ঠকে আর কিছুটা ছাই মহাদেব নিজে স্বর্গে সঞ্চিত রেখেছিলেন। এছাড়াও মনে করা হয় যে, যে ভস্ম অর্থাৎ ছাই অমর কন্ঠকে পড়েছিল তা থেকে পরে কোটি কোটি শিবলিঙ্গ সৃষ্টি হয়েছে।
যদিও বর্তমানে তাদের মধ্যে কেবলমাত্র জলেশ্বরেই একটি শিবলিঙ্গ দেখতে পাওয়া যায়, এই পবিত্র ভস্ম এর কারণে মানুষ বিশ্বাস করেন যে, যারাই এই নর্মদা মন্দিরে প্রবেশ করবেন, তাদের স্বর্গ লাভ হবে, এ ছাড়াও মানুষ এটাও বিশ্বাস করেন যে, অমরকন্টক এই জায়গাটি যেহেতু দেবতাদের বাসস্থান তাই এখানে যার মৃত্যু হবে সে সরাসরি স্বর্গলোক লাভ করবে।
শোন্দেশ শক্তিপীঠ এর ইতিহাস:
ধারণা করা হয় যে, এই শোন্দেশ শক্তি পীঠ তথা নর্মদা মন্দিরটি আজ থেকে প্রায় ছয় হাজার (৬,০০০) বছর আগে নির্মাণ করা হয়েছিল। এর প্রাচীন অর্থ আজও সকলের মনে বিস্ময় জাগায়। এই শক্তিপীঠ অর্থাৎ নর্মদা মন্দিরের ভিতরের বেদীটি খুবই সুন্দর আর বেদীটি রূপা দিয়ে তৈরি।
এই মন্দিরের কারুকার্য এবং ভাস্কর্য স্থাপত্য অত্যন্ত সু -নিপুনভাবে করা হয়েছে, সাদা শুভ্র পাথর দিয়ে নির্মিত এই নর্মদা মন্দিরের চারপাশে ছোট ছোট আরও অনেকগুলি পুষ্করিণী অথবা পুকুর আছে।
যার ফলে এই মন্দিরকে একেবারে ছবির মত সুন্দর দেখায়। এর পাশাপাশি মন্দিরের পাশে শোন নদী ও কুণ্ডের উপস্থিতি এর সৌন্দর্যকে আরো বেশি ফুটিয়ে তুলেছে। তাছাড়াও মধ্যপ্রদেশের এই অংশ তে বিন্ধ্য পর্বত আর সাতপুরা পর্বত একসাথে মিশেছে। যা কিনা পর্যটক ও তীর্থযাত্রীদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় একটি বিষয়।
এই মন্দিরের পাশ দিয়ে বলে চলেছে নর্মদা নদী, যার কারণে সতী পীঠ শোন্দেশ আরো মাহাত্ম্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে সকলের কাছে। মন্দিরের পাশাপাশি এই অঞ্চলে রয়েছে শোনমুরা নদী, কাহিনী অনুসারে জানা যায়, এই নদীর জলে আগে নাকি সোনার দানা পাওয়া যেত।
তারপর আছে নর্মদা উদগোম যা আসলে নর্মদা নদীর উৎপত্তিস্থল। মন্দিরের পাশেই রয়েছে মাঈ কি বাগিয়া অর্থাৎ দেবী মায়ের বাগান, স্থানীয় মানুষজন বিশ্বাস করেন যে, এই বাগানে নাকি দেবী নর্মদা ফুল তুলতে আসেন নিয়মিত।
এই শক্তি পীঠে দেবীর নর্মদা মূর্তিটি সোনার মুকুট দিয়ে ঢাকা থাকে। মন্দিরের একেবারে মাঝখানে থাকা বেদীটির একেবারে মাঝে রয়েছে দেবী নর্মদার একটি মূর্তি। তার চারপাশে দুই মিটারের ব্যবধানে আরো অন্যান্য সকল দেবদেবীর মূর্তিও সুসজ্জিত আছে। প্রত্যেকটি সতী পীঠে অথবা শক্তিপীঠ এ দেবী এবং ভৈরব প্রতিষ্ঠিত থাকেন। দেবী হলেন সতীর রূপ ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী। শোন্দেশ শক্তি পীঠে দেবী হলেন নর্মদা এবং ভৈরব হলেন ভদ্রসেন।
শোন্দেশ শক্তি পীঠে পূজা-পার্বণ ও উৎসব:
প্রতিটি শক্তি পীঠে সারা বছর পূজা-অর্চনার পাশাপাশি বিশেষ পূজা অর্চনার দিনে খুবই ধুমধাম ভাবে পালন করা হয় উৎসব অনুষ্ঠান। এই শক্তিপীঠ মহাশিবরাত্রি পালনের জন্য খুবই বিখ্যাত। এখানে মকর সংক্রান্তি, নবরাত্রি, শারদপূর্ণিমা, দীপাবলি অথবা সোমবতি অমাবস্যা, রামনবমী ইত্যাদি উৎসব জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে পালন করা হয়ে থাকে।
এছাড়া বলা যায় মহা শিবরাত্রিতে এখানে খুব বড় করে শিবরাত্রির আয়োজন করা হয়। আর এই মহা শিবরাত্রি কে কেন্দ্র করে এই শক্তি পীঠে বহু পুণ্যার্থী দের সমাগম ঘটে। ভক্তরা এই দিন রাত্রি কালে উপবাস করেন। গভীর মনোযোগের সঙ্গে শিবের উপাসনা করতে ব্যস্ত থাকেন তারা।
মন্দিরের চারিদিকের পরিবেশ, সুন্দর দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর মন্দিরের রূপ এবং দেবীর মূর্তি সবকিছু মিলিয়ে শোন্দেশ শক্তি পীঠ আপনার মনকে ভরিয়ে তুলবে ভক্তি ও শ্রদ্ধায়। তার সাথে আপনি অনুভব করতে পারবেন যে, এক নতুন জগতে প্রবেশ করেছেন।
এইসব শক্তিপীঠ এ সারা বছর ধরে পূন্যার্থী, পর্যটকদের ভিড় তো লেগে থাকেই, তার পাশাপাশি বিশেষ বিশেষ উৎসবে এখানে ভক্ত ও পর্যটকদের ঢল নামে। যা কিনা এই মন্দিরের চত্বর কে একেবারে ভরিয়ে তোলে।
স্থানীয় মানুষজনরা এই শক্তি পীঠ এ পূজা অর্চনার মধ্যে দিয়ে নিজেদের মনের ইচ্ছা জানিয়ে থাকেন দেবী নর্মদা কে। এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার আর কোন তীর্থস্থান ঘোরার যদি একসাথে ইচ্ছা থাকে, তাহলে এই তীর্থস্থান অথবা সতীর শোন্দেশ শক্তিপীঠ আপনার জন্য সেরা হতে পারে।