রামগিরি শক্তিপীঠ: যে স্থানে সতীর ডান বক্ষ (স্তন) পতিত হয়েছিল

(Ramgiri Shakti Peeth in Bengali) রামগিরি শক্তিপীঠের বর্তমান অবস্থান কোন স্থানে? দেবী সতীর কোন অঙ্গ এখানে পতিত হয়েছে? রামগিরি শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী কি? কিভাবে আরাধনা করা হয়? এই মন্দিরের তাৎপর্য কি? জানুন সবকিছু বিস্তারিত।

প্রতিটি তীর্থস্থান মানুষের মনে প্রশান্তি সৃষ্টি করে। তাইতো দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েও ভক্তগণেরা তীর্থস্থান যাত্রা করতে ভোলেন না। সেখানে গিয়ে মনের ইচ্ছা জানিয়ে পূজা দেওয়া আর এই সমস্ত তীর্থস্থান ঘুরে দেখার পর মনে যে শান্তি পাওয়া যায়, তা হয়তো আর কোথাও পাওয়া যায় না।

Ramgiri Shakti Peeth in Bengali - রামগিরি শক্তিপীঠ
Ramgiri Shakti Peeth in Bengali – রামগিরি শক্তিপীঠ

তাই এমনই সব তীর্থস্থান এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান হল সতী দেবীর ৫১ টি শক্তিপীঠ তার মধ্যে একটি অন্যতম শক্তিপীঠ হল রামগিরি শক্তিপীঠ অথবা রামগিরি মন্দির

রামগিরি শক্তিপীঠ:

শক্তিপীঠের নাম কন্যাকুমারী শক্তিপীঠ
স্থান রামগিরি, চিত্রকূট, ঝাঁসী-মাণিকপুর রেলওয়ে লাইনে, উত্তরপ্রদেশ
দেশ ভারত
দেবীর অংশ বাম স্তন
শক্তির নাম শিবানী

রামগিরি শক্তি পীঠের ভৌগোলিক গুরুত্ব:

রামগিরি মন্দিরটি উত্তরপ্রদেশের চিত্রকূট অঞ্চলের চিত্রকুট পর্বতের উপর এই সতী পীঠ অবস্থিত। এই শক্তিপীঠ ৫১ টি শক্তি পীঠের মধ্যে একটি অন্যতম শক্তি পীঠ অথবা সতীপীঠ।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এই স্থানে সতীর ডান বক্ষ (স্তন) পড়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী শিবানী এবং ভৈরব হলেন চাঁদ অথবা চান্দা। এই সতীপীঠ চিত্রকূট শক্তিপীঠ হিসেবে ও অনেকের কাছে পরিচিত।

রামগিরি শক্তি পীঠের পৌরাণিক কাহিনী:

প্রতিটি শক্তি পীঠের পিছনে রয়েছে ইতিহাস ও পৌরাণিক কাহিনী। তবে আমরা একটাই পৌরাণিক কাহিনী সম্পর্কে জানি যে, সতী বাবার কাছে তার স্বামীর মহাদেবের অপমান সহ্য করতে না পেরে নিজের বাপের বাড়িতে দেহ ত্যাগ করেছিলেন।

মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর পেয়ে মহাদেব পাগল হয়ে গিয়ে দেবীর সেই দেহ কাঁধে করে নিয়ে তান্ডব নৃত্য শুরু করেছিলেন। তবে শুধু এখানেই থেমে থাকেনি, এই তান্ডব নৃত্য তে পৃথিবীতে সৃষ্টি হয় মহা প্রলয়ের। সেই মহাপ্রলয়ে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে মাতা সতীর দেহকে ৫১ টি খন্ডে খন্ডিত করেছিলেন।

আর সতীর সেই দেহ খণ্ড গুলি পৃথিবীর বুকে যে যে জায়গায় পতিত হয়েছিল, সেখানে সেখানে একটি করে সতীপীঠ অথবা শক্তিপীঠ গড়ে উঠেছে। আর যে জায়গাতে সতীর ডান স্তন পতিত হয়েছিল সেখানে এই রামগিরি শক্তিপীঠ এর জন্ম হয়েছে।

রামগিরি শক্তি পীঠের আরো পৌরাণিক কাহিনী:

রামগিরি শক্তিপীঠকে অত্যন্ত পবিত্র তীর্থস্থান হিসেবে মনে করা হয়।  রামায়ণের কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, রাম, সীতা এবং লক্ষণ যখন তাদের ১৪ বছরের বনবাস কাটাচ্ছিলেন, তার মধ্যে সাড়ে এগারো বছর সময় অতিবাহিত করে ফেলেছিলেন এই চিত্রকূট পাহাড়ে।

এছাড়াও এখানে অনেক প্রাচীনকালের বহু মুনি-ঋষি এই অঞ্চলে তপস্যা করে সিদ্ধি লাভ করেছিলেন বলে জানা যায়। এখানেই ভগবান ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর তাদের নিজ নিজ অবতার রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে জানা যায়, রামচন্দ্র যখন তার বাবার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের কাজ করছিলেন, তখন এই চিত্রকুট পর্বতেই সকল দেব-দেবী শুদ্ধি গ্রহণের জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন। কোন পরিবারে কারো মৃত্যু হলে তার ১৩ দিন পরে আত্মীয় পরিজনদের উদ্দেশ্যে যে ভোজ দেওয়া হয় তাকে শুদ্ধি বলা হয়।

বাল্মিকী রামায়ণেই প্রথম এই চিত্রকুট পর্বতের উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু মহাকবি কালিদাস একে প্রথম রামগিরি নামে বর্ণনা করেন। কেননা শ্রী রামের প্রতি ভক্তি থেকে এই নামকরণ করেছিলেন তিনি, এমনটাই মনে করা হয়। এর পাশাপাশি লোকোমুখে শোনা যায় যে, হিন্দি সাহিত্যের অন্যতম বিখ্যাত কবি তুলসীদাস নাকি এই চিত্রকুট পর্বতেই স্বয়ং শ্রীরাম এর দেখা পেয়েছিলেন।

রামগিরি শক্তিপীঠ, চিত্রকূট, মন্দির:

এই মন্দিরটি মন্দাকিনী নদীর পাশেই অবস্থিত অর্থাৎ এই চিত্রকূট মন্দির তথা রামগিরি শক্তিপীঠ অথবা সতীপিঠ। প্রয়াগ রাজের মন্দিরের মতোই রামগিরির সতী পীঠের মাহাত্ম্য অনেকখানি বিস্তৃত। সাদা শুভ্র পাথরের তৈরি এই মন্দিরে বহু দেবদেবীর মূর্তি খোদাই করা আছে।

এরপর এই মন্দিরে অনেকগুলি সিঁড়ি পেরিয়ে তারপরে একেবারে মন্দিরের প্রধান ফটকে উঠে আসতে হয়। তারপর এই মন্দিরের মূল অংশ শুরু হয়। তাই বলা যেতেই পারে যে, এই মন্দিরে যেতে গেলে আপনাকে অনেকটাই দুর্গম রাস্তা পেরোতে হবে ও অনেকটাই কষ্ট করতে হবে।

দেবী ও ভৈরব:

প্রত্যেকটি পীঠ অথবা শক্তি পীঠে দেবী এবং ভৈরব অধিষ্ঠিত থাকেন তা তো আমরা আগেই জেনেছি এবং ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী, দেবী এখানে পূজিতা হন শিবানী রূপে এবং ভৈরব এখানে পরিচিত চান্দা অথবা চাঁদ নামে। সারা বছর ধরে এখানে ভক্তদের সমাগম চোখে পড়ার মতো।

তা ছাড়াও আরো অন্যান্য বিশেষ পূজা পার্বণে এখানে ভক্তদের সমাগম দেখা যায়, তার সাথে সাথে থাকে পর্যটকদের ভিড়ও। মকর সংক্রান্তি, নবরাত্রি, অমাবস্যা, সোমবতী অমাবস্যা, দীপাবলি, রামনবমী ইত্যাদি এই সমস্ত উৎসব অনুযায়ী এখানে মহা ধুমধাম ভাবে পূজা অর্চনা করা হয়।

আর এই সময় রামগিরির মন্দিরে বহু ভক্তের সমাগম লক্ষ্য করা যায় শুধুমাত্র মন্দিরের দর্শন করার জন্য আর এই উৎসব গুলি পালন করার জন্য। এই উপলক্ষে স্থানীয় মানুষজনরা মেলা উৎসব পার্বণের মধ্যে দিয়ে তাদের আনন্দ ও খুশি খুঁজে পান।

যেহেতু এই চিত্রকুট পর্বতে রামচন্দ্র, সীতা ও লক্ষণ তাদের চোদ্দ বছরের বনবাস কালের বেশিরভাগ সময়টাই এখানে কাটিয়েছিলেন, তার পাশাপাশি সতীর ডান স্তন এখানে পতিত হয়ে রামগিরি শক্তি পীঠের জন্ম হয়েছে।

তাই এই তীর্থ স্থানের গুরুত্ব হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে অনেকখানি গুরুত্বপূর্ণ এবং পবিত্র একটি তীর্থস্থান। পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত এই মন্দির দৃষ্টিনন্দন তো বটেই আর এখানে যেতে গেলে আপনাকে অনেক রোমাঞ্চকর।

আর উৎসাহের সাথে সিঁড়ি পেরিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করতে হবে। যারা এমন তীর্থযাত্রা পছন্দ করেন তাদের জন্য এই তীর্থস্থানটি অনেকখানি উপভোগের বিষয় হবে। এর পাশাপাশি আশেপাশে স্থানীয় মানুষজনরা এই মন্দিরে প্রতিনিয়ত পূজা দেওয়ার জন্য এতটা দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েও আসতে ভোলেন না।

Leave a Comment