কালমাধব শক্তিপীঠ: যে স্থানে সতীর বাম নিতম্ব পতিত হয়েছিল

(Kalmadhav Shakti Peeth in Bengali) কালমাধব শক্তিপীঠের বর্তমান অবস্থান কোন স্থানে? দেবী সতীর কোন অঙ্গ এখানে পতিত হয়েছে? কালমাধব শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী কি? কিভাবে আরাধনা করা হয়? এই মন্দিরের তাৎপর্য কি? জানুন সবকিছু বিস্তারিত।

সতী পার্বতীর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন দেহ অংশগুলি ৫১ টি খন্ডে বিভক্ত হয়ে পৃথিবীর বুকে যেখানে যেখানে পতিত হয়েছে সেখানে সেখানে গড়ে উঠেছে এক একটি শক্তিপীঠ ও তার সাথে পবিত্র তীর্থস্থান। যা পৃথিবী বাসীর জীবনকে ধন্য করে তুলেছে।

Kalmadhav Shakti Peeth in Bengali - কালমাধব শক্তিপীঠ
Kalmadhav Shakti Peeth in Bengali – কালমাধব শক্তিপীঠ

এই শক্তি পীঠে দেবী ও ভৈরবের অবস্থান রয়েছে। আর এখানে ভক্তরা মনের ইচ্ছা জানিয়ে পূজা করলে মনের সকল ইচ্ছা পূর্ণ হয়।

কালমাধব শক্তিপীঠ:

শক্তিপীঠের নাম কালমাধব শক্তিপীঠ
স্থান কালমাধব, পাহাড়ের উপরে গুহার ভিতর শোন নদীর তীরে, অমরকণ্টক, মধ্যপ্রদেশ
দেশ ভারত
দেবীর অংশ বাম নিতম্ব
শক্তির নাম কালী

কালমাধব শক্তিপীঠের অবস্থান:

কাল মাধব মন্দিরটি ভারতের মধ্যপ্রদেশের অন্তর্গত অমরকন্টক এ অবস্থিত। কালমাধব ৫১ টি সতী পীঠের মধ্যে একটি অন্যতম সতী পীঠ।

কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, এখানে সতীর বাম নিতম্ব পতিত হয়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী হলেন ভদ্রকালী বা কালী এবং ভৈরব হলেন অসিতানন্দ।

আবার অনেকের মত অনুসারে কালমাধব সতী পীঠের দেবী কালমাধব এবং ভৈরব এখানে অসিতাঙ্গ নামে পূজিত হন। ৫১ টি শক্তি পীঠের মধ্যে কালমাধব শক্তিপীঠ অন্যান্য পীঠস্থানের তুলনায় অনেক কম পরিচিত। অনেকে মনে করেন যে, এই কালমাধব মন্দিরের অবস্থান নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে।

তবে যাই হোক না কেন, নবরাত্রি পূজা উপলক্ষে প্রতি বছর এখানে বহু ভক্তদের সমাগম ঘটে, বিন্ধ্য এবং সাতপুরা পর্বতের মধ্যে অবস্থিত অমরকন্টক সাধারণ ভাবেই একটি দৈব মাহাত্ম্যপূর্ণ তীর্থস্থান এবং এই তীর্থস্থান শক্তিপীঠের সাথে জড়িয়ে রয়েছে অনেক পৌরাণিক কাহিনী আর এই মন্দিরের মাহাত্ম্যও অনেকখানি। এই শক্তিপীঠ পাহাড়ের উপরে গুহার মধ্যে শোন নদীর তীরে অবস্থিত।

কালমাধব শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী:

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, মাতা সতী বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে নিজের বাপের বাড়িতেই দেহ ত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর পেয়ে মহাদেব পাগল হয়ে যান। আর তিনি দেবীর মৃতদেহ দেখে একেবারে ক্রোধে ফেটে পড়েন। সাথে সাথে দক্ষ রাজাকে অর্থাৎ সতীর পিতা কে হত্যা করেন আর দেবীর দেহ কাঁধে করে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য শুরু করেন।

মহাদেবের তাণ্ডব নৃত্য তে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, তখন কোন উপায় না দেখে শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহটি ৫১ টি খন্ডে বিভক্ত করে দেন। সেই দেহ খন্ড গুলোই যে যে জায়গায় পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

তবে এমন এমন জায়গায় দেবীর দেহ অংশগুলি পড়েছিল সেখানে মানুষের চলাচল ছিল না বললেই চলে। ক্রমে ক্রমে দেবী স্বপ্নে আদেশ দিয়ে এবং কোনভাবে কেউ দেবীর সেই দেহ অংশ এর প্রস্তর খন্ড গুলির উদ্ধার করেছিলেন।

তারপর থেকেই সেখানে গড়ে উঠেছে পবিত্র তীর্থস্থান অথবা দেবী সতীর শক্তিপীঠ। সেই রকমই ৫১ টি শক্তি পীঠের মধ্যে একটি হল কালমাধব শক্তিপীঠ, আর কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, এই জায়গায় সতীর বাম নিতম্ব পতিত হয়ে জন্ম হয়েছে এই কালমাধব শক্তিপীঠ অথবা সতী পীঠের।

মধ্যপ্রদেশের অমরকন্টক হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান। এখানে অবস্থিত দুটি সতী পীঠের মধ্যে কালমাধব সতী পীঠটি তুলনামূলক ভাবে কম পরিচিত। নর্মদা নদীর তীরে এই সতী পীঠ তন্ত্রসাধনার জন্য প্রসিদ্ধ। অমরকন্টক থেকেই উৎপত্তি হয়েছে নর্মদা মহানদী ও শোন নদীর।

এই নর্মদা তীরে তপস্যা করলে পুণ্য ফল লাভ করা যায় আর সেই জন্য পুণ্যভূমি নর্মদা তীরে যুগ যুগ ধরে বহু সাধু সন্ন্যাসীরা এখানে তপস্যা করেছেন, তার সাথে তাদের আগমনও ঘটেছে। আমরকন্টকে সেই জন্য একদিকে শৈবপীঠ, তন্ত্র পীঠ, এবং অঘোরপীঠ গড়ে উঠেছে। তারই মধ্যে অন্যতম হলো এই শক্তিপীঠ কালমাধব

আবার অনেকেই মনে করেন যে শোন নদীর তীরে পাহাড়ের গুহায় এই মন্দির অবস্থিত। আবার অনেকে মনে করেন যে, পুরীর মন্দির থেকে একটু কাছে কালমাধব শক্তিপীঠের অবস্থান। কিন্তু অমরকন্টকে এই যে এই সতীপীঠ এর অবস্থান তা নিশ্চিত করে বলাই যায়।

কালমাধব মন্দির (শক্তি পীঠ):

বর্তমানে প্রচলিত নর্মদা মায়ের বিগ্রহই প্রাচীনকালে পীঠ দেবী কালি রূপেই পূজিতা হতেন। কেননা আজও মন্দিরে পাথরের তৈরি ভৈরবী যন্ত্র বিদ্যমান। এছাড়াও দেবীর বিগ্রহের দুই পাশে জয়াবিজয়ার মূর্তি আজও প্রতিষ্ঠিতা। তবে মায়ের পূজারী দের কথা শুনে জানা যায় যে, আজও নর্মদা মায়ের পূজা ও ধ্যান মন্ত্র চামুণ্ডার বিধি মতে হয়ে থাকে।

মায়ের বাম নিতম্ব এখানে পতিত হওয়ার জন্য কালমাধব শক্তিপীঠ গড়ে উঠেছে। যা কিনা অমরকন্টক এর বর্তমান বিখ্যাত নর্মদা মন্দির। এছাড়া এখানে স্বয়ম্ভু শিব হিসাবে অমরকন্টেশ্বর, পাতালেশ্বর, জলেশ্বর, প্রভৃতি শিবলিঙ্গ গুলি খুবই প্রাচীন এবং জাগ্রতও বটে।

কালমাধব মন্দির (শক্তিপীঠ) এর ইতিহাস:

প্রতিটি শক্তিপীঠ এক একটি ইতিহাস বহন করে। তেমনি কাল মাধব শক্তি পীঠ অথবা কালমাধব মন্দিরটির নির্মাণ নিয়েও রয়েছে ইতিহাস। মনে করা হয় আনুমানিক ৬০০০ বছর আগে সূর্যবংশীয় সম্রাট মান্ধাতা শোন নদীর তীরে অমরকন্টকে এই কালমাধব মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। একেবারে পাহাড়ের উপরে শ্বেত- শুভ্র পাথরের তৈরি এই মন্দিরটি, যা দেখতে সত্যিই অসাধারণ।

মন্দিরের চারপাশে রয়েছে শ্বেত পাথর দিয়ে বাধানো পুকুর। এছাড়াও মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে শোন নদী, যা এখানকার একটি অন্যতম আকর্ষণও বটে, যার ফলে এখানে পর্যটকদের সমাগম চোখে পড়ার মতো।

সমতল ভূমির পাদদেশ থেকে মূল মন্দিরে যাওয়ার জন্য ১০০ টি সিঁড়ি রয়েছে। মন্দির ছাড়াও এখানে সাতপুরা আর বিন্ধ্য পর্বতের সন্ধিস্থল রয়েছে, যার সৌন্দর্য সত্যিই অতুলনীয়। প্রকৃতির আসল সৌন্দর্য আর রূপ আপনি নিজে চোখেই উপভোগ করতে পারবেন। যা কিনা একেবারে স্বর্গ এর ন্যায় সুন্দর বলে মনে হবে।

কালমাধব মন্দিরে দেবী পার্বতী কালি রূপে পূজিতা হন। প্রত্যেকটি পীঠ অথবা শক্তিপীঠ এ দেবী এবং ভৈরব উপস্থিত থাকেন। দেবী হলেন সতীর রূপ, ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী। কালমাধব সতী পীঠে দেবী হলেন কালি তথা কালমাধব এবং ভৈরব হলেন অসিতাঙ্গ। এই মন্দিরের নবরাত্রির দিন পূজা অর্চনা উপলক্ষে মন্দিরকে ঘিরে অনেক ভক্তের সমাগম ঘটে।

এর পাশাপাশি সারা বছর ধরে দূর দূরান্ত থেকে অনেক পর্যটকদের আনাগোনা থাকে এখানে। আর ভক্তদের আর কন্যার্থীদের সমাগমের কথা না হয় নাই বা বললাম, কেননা এখানে সারা বছর জুড়ে ভক্তদের ঢল নামে। বিশেষ করে দুর্গাপূজার সময়, নবরাত্রীর সময় এই মন্দিরের রূপ আরো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top