ইসলামিক নববর্ষ 2023 (Islamic New Year 2023 Date Time and Significance) 2023 ইসলামিক নববর্ষ ইতিহাস এবং জানুন ইসলামিক নববর্ষ কেন পালন করা হয়? ইসলামিক নববর্ষ তাৎপর্য কি? ভারতীয়দের জন্য ইসলামিক নববর্ষ গুরুত্ব কতটা? জানুন সবকিছু এখানে।
ইসলাম অনুসারে যে সমস্ত বিষয়গুলি জড়িত রয়েছে উৎসবের সাথে, সেগুলি ইসলামের বিভিন্ন বিধি-বিধান, হিজরী সন তথা আরবি তারিখ ও চান্দ্র মাসের সঙ্গে সম্পর্কিত উৎসব। সবকিছুতেই মুসলিম উম্মাহ হিজরি সনের উপর নির্ভরশীল। যা মুসলিম উজ্জীবিত করে এর মধ্যে হিজরী সন খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যতম। মানুষের জীবন সময়ের সমষ্টি, সময়কে মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহার করা এবং উপযোগী করে তোলা।
আল্লাহ তালা প্রাকৃতিক ভাবে, বিভিন্ন ভাবে বিভক্ত করেছেন, যেমন দিন, রাত, মাস, বছর ইত্যাদি। বছর কে আমরা সাল অথবা সন ও বলে থাকি। বছর শব্দটির মূল অর্থ হলো সাল শব্দটি ফারসি এবং সন শব্দটি আরবি। বাংলায় বর্ষ, বছর, বৎসর, অব্দ হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
ইসলামিক নববর্ষের ইতিহাস 2023:
প্রাচীন আরবে সুনির্দিষ্ট কোন প্রথা প্রচলিত ছিল না। বিশেষ ঘটনার নামে বছর গুলোর নামকরণ করা হতো। যেমন ধরুন বিদায়ের বছর, অনুমতির বছর, হস্তির বছর, ইত্যাদি। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.) যখন খেলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তখন অনেক দূর দূরান্ত পর্যন্ত নতুন নতুন রাষ্ট্র এবং ভূখণ্ড ইসলামী খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রের জরুরী কাগজ পত্র ইত্যাদিতে কোন সন তারিখ উল্লেখ না থাকার কারণে অনেক অসুবিধা হতো।
ঐতিহাসিক আলবেরুনী দ্বারা একটি বিবরণী থেকে জানা যায় বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবু মুসা আজহারী একটি চিঠিতে ওমর (রা.) এর কাছে অনুযোগ করেন যে, “আপনি আমাদের কাছে যেসব চিঠি পাঠাচ্ছেন সেগুলোতে কোন সন, তারিখের উল্লেখ নেই। যার কারণে আমাদের অনেক অসুবিধা হয়”। বিষয়টির গুরুত্ব দিয়ে খলিফা হযরত ওমর (রা.) একটি সন চালুর ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালান।
ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় হিজরতের ১৬ বছর পর ১০ জুমাতুল উলা মোতাবেক ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে হিজরতের বছর থেকে সন গণনার পরামর্শ দেন হযরত আলী (সাঃ) তখনকার সময়ে আরবে প্রথা অনুযায়ী পবিত্র মহররম মাস থেকে ইসলামী বর্ষ শুরু করার ও জিলহজ মাস কে সর্বশেষ মাস হিসেবে মেনে নেওয়ার পরামর্শ প্রদান করেন হযরত উসমান (রা.) (বুখারী ও আবু দাউদ)
এরপর নবুওয়াতের ত্রয়োদশ বর্ষে রবিউল আউয়াল মাসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর হিজরতের ঘটনা মুসলিম জাতির জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সেদিকে লক্ষ্য করেই ইসলামী সন প্রবর্তন করা হয় যাকে হিজরী সন বলা হয়।
হিজরত মানে ছেড়ে যাওয়া, পরিত্যাগ করা, দেশান্তরী হওয়া, অথবা দেশান্তর করা। কামনা, বাসনা, বিসর্জন দেওয়া, সংযম অবলম্বন, ও আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মাৎসর্য, পরিত্যাগ করাই হিজরতের অন্তর্নিহিত দর্শন বলে মনে করা হয়।
হিজরী সন এর প্রবর্তন:
ভারত বর্ষে মুসলিম শাসকেরা হিজরী সন ব্যবহার করতেন। হিজরী সন চান্দ্র মাস অনুযায়ী হিসাব করা হতো। যেখানে প্রতিবছর একটি দিন ১০ বা ১১ দিন এগিয়ে যেত। এভাবে প্রতিদিন বছরে একমাস এগিয়ে আসতো বছর। তখন অর্থনীতির প্রধান বিষয় ছিল কৃষি। রাষ্ট্রীয় আয়ের প্রধান উৎস ছিল খাজনা আর খাজনা আদায়ের উপযুক্ত সময় ছিল ফসল তোলার সময়।
কিন্তু হিজরির চান্দ্র বর্ষে শুরু সব সময় ফসল তোলার সময় হয় না। সেই কারণে খাজনা আদায় করাতে খুবই অসুবিধা হতো। এই সমস্যার সমাধান করার জন্য মহামতি আকবর একটি নতুন পঞ্জিকার প্রয়োজন মনে করলেন। আর সেই পঞ্জিকা মাওলানা মোল্লা ফতেহ উল্লাহ সিরাজিকে প্রবর্তন করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
তিনি তখনকার প্রচলিত সৌর বর্ষের বাংলা মাস গুলোকে ব্যবহার করে এবং সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের বছরকে প্রথম বছর ধরে একটি পঞ্জিকা প্রবর্তন করেন যার নাম দেওয়া হয় হিজরী বাংলা সন বা ফসলি সন। তবে কালের পরিবর্তনের ফলে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে যায়। সেই কারণে কালের বিবর্তনে সেটি আজ বাংলা সন অথবা বঙ্গাব্দ হিসেবে পরিচিত।
হিজরী সন মূলত চান্দ্র বর্ষ নির্ভর। চান্দ্র মাস ২৯ অথবা ৩০ দিনে হয় সেই অনুযায়ী ৩৫৪ অথবা ৩৫৫ দিনে একটি বছর পূর্ণ হয়। আবার সৌর মাস হয় ৩০ অথবা ৩১ দিনে, সেক্ষেত্রে একটি বছর পূর্ণ হয় ৩৬৫ দিন অথবা ৩৬৬ দিনে। তাই চান্দ্র বর্ষ ও সৌরবর্ষ থেকে উদ্ভূত হলেও এতে সময় বিজ্ঞানের সূত্র রক্ষা করা হয়নি।
এক্ষেত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সৌদি আরব, ইরান সহ মধ্যপ্রাচ্য, দূরপ্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মুসলিম দেশ গুলোতে হিজরী চান্দ্র বর্ষের পাশাপাশি হিজরী সৌর বর্ষ ব্যবহৃত হয়। এই দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র অনুসারে, এতে অসুবিধা হয় না, এর পরিবর্তে সুবিধাই হয়।
হিজরী নববর্ষের ইতিহাস এর মধ্যে দিয়ে শিক্ষা গ্রহণ:
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার পরবর্তীতে হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব এর সামনে অতীতের বিভিন্ন জাতির বর্ষপঞ্জি থাকা সত্ত্বেও হিজরতের তারিখ থেকে মুসলমানদের বর্ষপঞ্জি সূচনা করার মধ্যে মুসলমানদের জন্য রয়েছে অনেক বড় শিক্ষনীয় বিষয়। কারণ হিজরত ইসলামী ইতিহাস একটি যুগান্তকারী ঘটনা। বিশ্ব ইতিহাসেও এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এটি ছিল হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্য নির্ণয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এর দিন।
মক্কার কাফের মুশরিক দ্বারা পাশবিক নির্যাতন অব্যাহত, অমানবিক আচরণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বয়কট, ইত্যাদি সত্ত্বেও মুসলমান আপন দ্বীনের উপরে অটল অবিচল থাকেন। মুখ বুজে নিরবে সহ্য করে যান এইসব অকথ্য অত্যাচার, নির্যাতন। অবশেষে তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। এই ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার হুকুমে মুসলমানগণ মদিনায় হিজরত করেন।
এই ধৈর্য, ত্যাগ ও বিসর্জন এর ফলেই মুসলমানগণ মদিনার মত বহুজাতিক রাষ্ট্রে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা ও তৎপরবর্তী সময়ে ইসলামের ব্যাপক প্রচার প্রসারের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ এর জন্য অনুপ্রেরণা দিতে পেরেছিলেন। যা ইসলামী ইতিহাসের সোনালী অধ্যায়ের সূচনা করেছিল।
হিজরী নববর্ষ প্রতিটি বছরের সূচনা কালে মুসলমান দেরকে এই কথার জানান দেয় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম যে ধৈর্য, ত্যাগ, ও বিসর্জনের ফলে ইসলামের পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ রূপ দেখতে পেয়েছিলেন। সমস্ত মুসলিম যদি পৃথিবীর বুকে সেভাবে ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে চান, তাহলে তারা তাদের অনুসরণে মুসলমান দের ধৈর্য, ত্যাগ, বিসর্জন দিতে হবে।
আরবি নববর্ষ মুসলিম হিসেবে গর্ব ও অহংকার এর প্রতীক। আরবি নববর্ষের সাথে জড়িয়ে রয়েছে ইসলামের অনেক অনেক ইতিহাস। ইসলামের বিভিন্ন ঘটনা ও ইতিহাস থেকেই আরবি নতুন বছর বা দিনক্ষণ অথবা মাস গণনা শুরু করা হয়েছে। তাই একজন সচেতন মুসলমান হিসেবে বাংলা এবং ইংরেজি নববর্ষ বাদ দিয়ে, আরবি নববর্ষকে অত্যাধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।