(Gandaki Shakti Peeth in Bengali) গন্ধকী শক্তিপীঠের বর্তমান অবস্থান কোন স্থানে? দেবী সতীর কোন অঙ্গ এখানে পতিত হয়েছে? গন্ধকী শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী কি? কিভাবে আরাধনা করা হয়? এই মন্দিরের তাৎপর্য কি? জানুন সবকিছু বিস্তারিত।
হিন্দু ধর্মাবলম্বী দের কাছে এই ৫১ টি শক্তিপীঠ অনেক খানি তাৎপর্য বহন করে। পুরাণের কাহিনী অনুসারে আমরা সকলেই জানি যে, দেবী সতী দক্ষ রাজার অমতে মহাদেব কে বিবাহ করেছিল বলে মহাদেব কে অনেক অপমান করেছিলেন, আর সেই কারণে সতী দেবী নিজের প্রাণ ত্যাগ দিয়েছিলেন। এমন ঘটনায় মহাদেব সতীর মৃত্যুতে পাগল হয়ে তার দেহ কাঁধে করে তুলে নিয়ে প্রলয় নিত্য শুরু করেন।
এমন প্রলয় নৃত্যের ফলে পৃথিবী ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। তখন বিষ্ণু, সেই প্রলয় থামাতে সুদর্শন চক্র পাঠিয়ে দেন আর সেই সুদর্শন চক্র দেবীর দেহকে ৫১ টি খন্ডে বিভক্ত করে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেন, এই সব কটি জায়গাকে সতীপীঠ বলা হয়।
গন্ধকী শক্তিপীঠ:
শক্তিপীঠের নাম | গন্ধকী শক্তিপীঠ |
স্থান | গন্ধকী, মুক্তিনাথ মন্দির, গন্ধকী নদী তীরে, পোখরা |
দেশ | নেপাল |
দেবীর অংশ | ডান গাল |
শক্তির নাম | গন্ধকী চণ্ডী |
গন্ধকী শক্তিপীঠ এর ভৌগোলিক গুরুত্ব:
এই সতী পীঠ এর সঠিক স্থান নিয়ে বিভিন্ন তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। কেউ বলেন শালগ্রামের কাছে গণ্ডক নদীর উৎপত্তিস্থলে এই সতীপীঠ অবস্থিত, আবার অনেকেই বলেন এটা নেপালের মুক্তিনাথ তীর্থ। নেপাল তিব্বত সীমান্তে কালী গন্ধকের উৎস মাসতং এই এই সতী পীঠস্থান টি অবস্থিত।
এখানে আছে চন্ড নামে অনাদি লিঙ্গ। নদীর উৎস মুখের কুণ্ডে দেবীর অবস্থান রয়েছে। দেবীর কোনরকম মূর্তি এখানে নেই, ভক্তি সহকারে পূজা-অর্চনা করা হয়। এখানে পতিত হয় সতীর ডান গাল অথবা গন্ডদেশ। দেবী হলেন গন্ধকী চন্ডী আর ভৈরব হলেন চক্রপাণি।
এই সতী পীঠ গন্ধকী নেপালের পোখরা থেকে ১২৫ কিলোমিটার দূরে নেপাল তিব্বত সীমান্তে কালি গন্ডকী নদীর উৎপত্তিস্থলে মাসতাং এ অবস্থিত। নদীর উৎস মুখের কুণ্ড তে মূলত দেবীর বিদ্রোহের অবস্থান। এখানে দেবীর কোন রকম মূর্তি নেই তবে এখানে শিলাখণ্ডকে দেবীর রূপে আরাধনা করা হয়।
এছাড়া এই সতীপীঠ অথবা এই মন্দিরটি মুক্তিনাথ মন্দির নামে ও অনেকের কাছে পরিচিত। আর হ্যাঁ এখানে একটা কথা বলে রাখা জরুরী যে, ভারতীয় নাগরিকরা এখানে ভিসা, পাসপোর্ট ছাড়াই যেতে পারবেন।
গন্ধকী শক্তিপীঠ (মুক্তিনাথ মন্দির) এর পৌরাণিক কাহিনী:
এই মন্দির অথবা শক্তি পীঠের পৌরাণিক কাহিনী হিসেবে জানা যায় ভগবান শিব যখন বিষ পান করেছিলেন তখন তিনি শুধুমাত্র বিষ পানই করেন নি, তিনি সংসার ত্রিতাপ জ্বালা সেই বিষ নিজেই একা হরণ করেছিলেন। একসময় দেবী পার্বতী এখানে জয়া বিজয়াকে নিয়ে স্নান করতে এসেছিলেন, স্নান করার পর তিনি জয়া বিজয়াকে এই হ্রদের কাহিনী বলতে লাগলেন।
কাহিনী এমন ছিল যে, দেবতা ও অসুররা মিলে ক্ষীরসাগর মন্থন করেছিলেন। তবে সাগর থেকে ভয়ানক বিষের পাত্র বেরিয়ে আসে। সেই বিশেষ তীব্রতা এমন ছিল যে, যা চারিপাশের পরিবেশ, আবহাওয়াকে বিষাক্ত করে তুলেছিল।
অগ্নি শিখায় জ্বলতে লাগলো সবকিছু কিন্তু এখন উপায় কি ? এদিকে প্রজাপতি ব্রহ্মার পক্ষে এই বিষ দূর করার কোনরকম সম্ভব ছিল না। তাই বিপদ থেকে বাঁচতে শিবের শরণাপন্ন হলেন সকলেই, আর তিনি সকলকে অভয় দিয়ে সেই বিষ পান করার পর ভগবান শিবের অসহ্য জ্বালা শুরু হলে তিনি এই হ্রদে স্নান করে সেই জ্বালা দূর করেন।
সেই থেকে এই হ্রদের নাম নীলকন্ঠ হ্রদ। তাছাড়া অনেকেই একে গোসাইকুণ্ড নামেও ডেকে থাকেন। শিব ভক্তদের অন্তরের সকল বিষ হরণ করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন নীলকন্ঠ। গন্ডকী চন্ডীর মন্দির পাহাড়ের উপরে অবস্থিত।
মন্দিরের পাঁচিলে ১০৮ টি পিতলের নানান জন্তুর মুখ বসানো আছে প্রতিটির মুখ থেকে অজস্র ধারায় অনবরত জল পড়ছে। সেখানে ভক্তরা স্নান সেরে মন্দিরে প্রবেশ করেন, মন্দিরে লামা পুজারীরা পূজা করেন। আর এখানেই দেবী চণ্ডীকার পূজা হয়। এই হল গণ্ডকী চণ্ডীপীঠ।
গন্ধকী শক্তিপীঠের ইতিহাস:
প্রতিটি সতী পীঠ এক একটি ইতিহাস বহন করে। তেমনি এই গন্ধকী শক্তি পীঠের মন্দির অর্থাৎ মুক্তিনাথ মন্দিরের উল্লেখ বিষ্ণু পুরানেও পাওয়া যায়। এটি হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থানের অন্যতম পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এছাড়াও তিব্বতের বৌদ্ধ ঐতিহ্য মতে তিব্বতীয় বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু রিনপোচে যিনি পদ্মসম্ভব নামেও পরিচিত, তিব্বত এ যাওয়ার পথে মুক্তিনাথে তিনি ধ্যান করেছিলেন। এই মন্দিরটি হিন্দু ঐতিহ্যের অনেক সাধুদের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে, কাহিনী অনুসারে জানা যায়।
গন্ধকী শক্তিপীঠের মাহাত্ম্য:
প্রতিটি তীর্থস্থানে যাত্রা করার একটাই উদ্দেশ্য থাকে যে, সেখানে গেলে জীবন ধন্য হবে এবং মনের অনেক আশা পূর্ণ হবে। তেমনি দর্শনার্থীদের বিশ্বাস অনুসারে এই মুক্তিনাথ মন্দির সংলগ্ন গন্ডকি নদীতে স্নান করলে সমস্ত পাপ ধুয়ে মোক্ষ লাভ সম্ভব হয়।
এর পাশাপাশি আবার এই নদীতেই ভগবান বিষ্ণুর প্রতীক শালগ্রাম শিলা পাওয়া যায় বলে কথিত আছে। এটাও বলা হয় যে, কোন ব্যক্তির অপূর্ণ কোনো ইচ্ছা থাকলে, যদি সেই ব্যাক্তি ভক্তি সহকারে দেবী গন্ধকীর পূজা করেন তাহলে সেই ইচ্ছা খুবই সহজে এবং খুবই কম সময়ের মধ্যে পূর্ণ হয়ে যায়।
গন্ধকী শক্তিপীঠ / মুক্তিনাথ মন্দিরের সৌন্দর্য্য:
এই সতী পীঠ অথবা মুক্তিনাথ মন্দিরটি বৌদ্ধ প্যাগোডা ধরনের নির্মিত, এই মন্দিরটি মূলত ভগবান বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়েছে, প্রায় ৩৮০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই মন্দির অর্থাৎ গন্ধকী শক্তিপীঠ অথবা মুক্তিনাথ মন্দির।
বিষ্ণু কে উৎসর্গ করা আটটি প্রধান মন্দিরের মধ্যে এর মধ্যে এটি হলো একটি। অন্য সাতটি মন্দির হলো-
১) শ্রীমুষ্ণম, ২) শ্রীরঙ্গম, ৩) নৈমিষঅরণ্য, ৪) তিরুপতি, ৫) থোতাদ্রি, ৬) পুষ্কর এবং ৭) বদ্রিনাথ।
এছাড়াও এখানে ভগবান বিষ্ণুর একটি লম্বা সোনার তৈরি মূর্তিও দেখা যায়। মন্দির প্রাঙ্গনে অবস্থিত ১০৮ টি ষাঁড় এর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুখ দিয়ে সর্বক্ষণ জল পড়ে। এর পাশাপাশি মন্দিরের কাছেও প্রাকৃতিক ভাবে ১০৮ টি জলের ঝর্ণা রয়েছে। এই মন্দিরের খুব কাছে রয়েছে বাল্মিকির আশ্রম যেখানে বসে বিখ্যাত মহাকাব্য রামায়ণ রচনা করেছিলেন তিনি।
যদিও আমরা আগে জানলাম যে, দেবী মূর্তি হিসেবে ওখানে কোনরকম মূর্তি নেই, তবে সেখানে শিলাখণ্ড হিসেবে দেবীকে পূজা করা হয়। তবে সেটিকেও খুবই সুন্দর করে লাল কাপড় দিয়ে সাজিয়ে, সোনালী রঙের বড় বড় চোখ এঁকে তাতে স্থাপন করা হয়েছে, বিদ্রোহের মাথায় স্বর্ণ উজ্জ্বল একটি মুকুট ও দেখা যায়, যেটি দেবীর রূপকে আরো বেশি শোভা দিয়েছে।
গন্ধকী শক্তি পীঠে উৎসব:
প্রতিটি সতী পীঠে সারা বছর ধরে পর্যটক এবং পুণ্যার্থী দের আনাগোনা দেখার মতো। তবে সাধারনত বছরের দুবার মার্চ অথবা এপ্রিল মাসে এবং সেপ্টেম্বর অথবা অক্টোবর মাসে খুবই ধুমধাম করে এই মন্দিরে নবরাত্রি উৎসব পালন করা হয়। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এবং দেশের বাইরে থেকেও ভক্তদের দল এসে ভিড় জমান এখানে।
আনন্দ উৎসব উদযাপন করা হয়ে থাকে, যেখানে স্থানীয় মানুষজন ও আনন্দ উৎসব উপভোগ করে থাকেন। দেবীকে বিশেষ যজ্ঞ ও পূজা দিয়ে সন্তুষ্ট করা হয়। এই সময় অনেকেই মাটি থেকে উৎপাদন হওয়া শস্য গ্রহণ করেন না। নবরাত্রি ছাড়াও এখানে শিবরাত্রি উপলক্ষে খুবই জাকজমকপূর্ণ ভাবে উৎসব ও পূজা অর্চনার আয়োজন করা হয়।
যেহেতু ভারতীয়দের জন্য এখানে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোন রকম পাসপোর্ট ভিসার প্রয়োজন পড়বে না, তাহলে আপনি অনায়াসেই এই শক্তিপীঠ থেকে ঘুরে আসতে পারেন। কেননা এখানে আপনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার পাশাপাশি, দেবীর ৫১ টি শক্তিপীঠের মধ্যে একটি শক্তি পীঠে গিয়ে আপনার মনের ইচ্ছা জানিয়ে আসতে পারেন।