(Vimala Shakti Peeth in Bengali) বিমলা শক্তিপীঠের বর্তমান অবস্থান কোন স্থানে? দেবী সতীর কোন অঙ্গ এখানে পতিত হয়েছে? বিমলা শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী কি? কিভাবে আরাধনা করা হয়? এই মন্দিরের তাৎপর্য কি? জানুন সবকিছু বিস্তারিত।
সতীর খন্ড বিখন্ড দেহাংশ গুলি পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে সতী পীঠ গড়ে উঠেছে। এমনই একটি শক্তিপীঠ হল সর্বমঙ্গলা মন্দির অথবা বিমলা মন্দির। যেটি বর্ধমান এ অবস্থিত। বর্ধমানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন সর্বমঙ্গলা তিনি বাংলার লৌকিক দেবী ও বটে।
আর কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, এখানে সতী দেবীর নাভি পতিত হয়েছিল। বর্ধমান জেলার সর্বমঙ্গলা মন্দিরে পূজিত হয়ে থাকেন সতী। এই মন্দির টিকে অনেকেই শক্তিপীঠ হিসেবেই চেনেন।
বিমলা শক্তিপীঠ:
শক্তিপীঠের নাম | বিমলা শক্তিপীঠ |
স্থান | বিমলা মন্দির, পুরি, ওড়িশা |
দেশ | ভারত |
দেবীর অংশ | নাভি |
শক্তির নাম | মাতা বিমলা দেবী |
বিমলা শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী:
সতী পার্বতী যখন বাবার অমতে মহাদেব কে বিবাহ করেছিলেন তখন দক্ষ রাজা খুবই রেগে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে একটি যজ্ঞের আয়োজন করে সেখানে পার্বতীর সামনে তার স্বামী মহাদেবকে অপমান করতে শুরু করেন।
স্বামীর এই অপমান সহ্য করতে না পেরে তিনি প্রাণ ত্যাগ করেন, এই খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছাতে না পৌঁছাতে তিনি উন্মাদ পাগলের পরিণত হন। তার সাথে সাথে সতী দেবীর কাছে উপস্থিত হয়ে তার দেহখানি কাঁধে করে তুলে নিয়ে তান্ডব নৃত্য শুরু করেন। সে এমন এক প্রলয় নৃত্য, যার ফলে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হয়।
কোনরকম উপায় না পেয়ে শ্রীবিষ্ণু হাতের সুদর্শন চক্র দিয়ে দেবীর সেই দেহটি খন্ড খন্ড করার জন্য বাধ্য হন। আর সেই সুদর্শন চক্র দ্বারা দেবীর খন্ড খন্ড দেহ অংশ গুলি পৃথিবীর বক্ষে যেখানে যেখানে পতিত হয়েছে, সেখানে সেখানে গড়ে উঠেছে এক একটি সতীপীঠ অথবা শক্তিপীঠ।
বলতে গেলে ৫১ টি দেহ খন্ডের অংশ থেকে তৈরি হয়েছে ৫১ টি সতী পীঠ অথবা শক্তিপীঠ যার মধ্যে একটি অন্যতম সতী পীঠ হলো সর্বমঙ্গলা মন্দির। এখানে শক্তি হলো মাতা বিমলা এবং ভৈরব হল ভগবান জগন্নাথ।
সর্বমঙ্গলা মন্দিরের পূজা:
সর্বমঙ্গলা মন্দিরে প্রতিদিন পূজা অর্চনা ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে রাজ বংশের শেষ যুবরাজ উদয় চাঁদ মহতাব ট্রাস্ট কমিটি গঠন করেন। তার পূজো প্রায় ৩৫০ বছরের বেশি পুরানো।
সর্বমঙ্গলার ঘট প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শারদ উৎসবের আনুষ্ঠানিক সূচনা করা হয়ে থাকে। পূর্ব বর্ধমানের এখানে আবার কুমারী পূজাও করা হয় খুবই ধুমধাম ভাবে।
বাদ্যযন্ত্র সহকারে বিশাল শোভাযাত্রার ঢল নামে পূর্ণর্থীদের। দেবী সর্বমঙ্গলার ঘটপূর্ণ জল নিয়ে ঘোড়ার গাড়ি নানা পথ অতিক্রম করে থাকে, শোভাযাত্রা সর্বমঙ্গলা মন্দিরে এসে পৌঁছাতেই বাদ্যযন্ত্র, ঘণ্টা, শাঁখ, কাঁসর ও উলুধ্বনির মধ্যে দিয়ে দুর্গাপূজার ঘট প্রতিষ্ঠা করা হয়।
দেবী সর্বমঙ্গলা মন্দির:
যেহেতু এখানে সতীর নাভি পড়ে এই সতী পীঠ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তো বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা মন্দির অবিভক্ত বাংলার প্রথম নবরত্ন মন্দিরও বলা যায়। প্রাচীন এই মন্দির বর্ধমানের মানুষের কাছে খুবই পবিত্র একটি তীর্থস্থান।
দেশ-বিদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ পূন্যার্থী ও পর্যটক দের সমাগম ঘটে এই মন্দির প্রাঙ্গণে। মন্দিরের ঐতিহাসিক গুরুত্বর কথা বিবেচনা করে প্রাচীন এই মন্দিরকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে বর্তমানে।
মূর্তি: এখানেই সর্বমঙ্গলা দেবীর মূর্তি হিসেবে কষ্টি পাথরের অষ্টাদশভূজা, সিংহবাহিনী, মহিষমর্দিনী, মহালক্ষ্মীরূপিণী হিসাবে সতী দেবীর পূজা করা হয়। যা স্থানীয় মানুষজন দের কথা অনুসারে এই রূপে তিনি অনেক কাল আগে থেকে পূজিতা হয়ে আসছেন।
সর্বমঙ্গলা মন্দির (শক্তি পীঠ) এর ইতিহাস:
কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, প্রায় ৩৫০ বছর আগে শহর বর্ধমানের উত্তর অংশে বাহির সর্বমঙ্গলা পাড়ায় বাগদিরা যখন পুকুরে মাছ ধরতে গিয়েছিল, তখন একটি শিলা মুর্তি পেয়েছিল। সেই শিলা মুর্তিটি একটি পাথরের খন্ড ভেবে তার ওপরে শামুক, গুগলি এগুলো ভেঙে থাকত তারা।
সেই সময় দামোদর নদ লাগোয়া চুন তৈরির কারখানায় শামুকের খোলার প্রয়োজন পড়লে সেই সময় শামুকের খোলার সাথে শিলা মুর্তিটিও চলে যায় চুন ভাটায়। তখন শামুকের খোলার সঙ্গে সঙ্গে শিলা মুর্তিটি পোড়ানো হলেও মূর্তির কোনরকম ক্ষতি হয়নি।
তবে সেই রাতে স্বপ্নে আদেশ পাওয়া মাত্রই বর্ধমান মহারাজা সঙ্গম রায় শিলা মুর্তিটিকে নিয়ে এসে সর্বমঙ্গলা নামে পূজা করতে শুরু করেন। এরপরে পরবর্তীকালে ১৭০২ সালে টেরাকোটার নিপুন কারুকার্য খচিত সর্বমঙ্গলা মন্দির নির্মাণ করেন মহারাজাধিরাজ কীর্তিচাঁদ মহতাব।
সর্বমঙ্গলা মন্দিরের মাহাত্ম্য:
ক্রমশই মূল মন্দিরের আশেপাশে গড়ে ওঠে নাটমন্দির, শ্বেত পাথরের তৈরি রামেশ্বর ও বানেশ্বর নামে দুটি শিব মন্দিরও রয়েছে। কালো পাথরের তৈরি হয় মিত্রেশ্বর, চন্দ্রেশ্বর ও ইন্দ্রেশ্বর নামে আরও তিনটি শিব মন্দির।
এখানে সর্বমঙ্গলা দেবীর মূর্তি কষ্টি পাথরের, অষ্টাদশ ভূজা, সিংহবাহিনী, মহিষমর্দিনী, মহালক্ষীরুপিনী। স্বয়ং রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এই মন্দিরে এসেছিলেন বলেও জানা যায় কাহিনী অনুসারে।
এছাড়া এই মন্দিরে প্রতিনিয়ত পুণ্যার্থী ও ভক্তদের ঢল চোখে পড়ার মত। এখানে দেবীর প্রসাদ বিতরণের পাশাপাশি অনেক গরিব দুঃখী মানুষের খাওয়ার জোগাড় করা হয়। আর সকলেই পুণ্য অর্জনের পাশাপাশি দেবীর দর্শন করে নিজের জীবনকে সার্থক করে তোলেন। এছাড়াও এখানকার স্থানীয় মানুষজন সকলে প্রতিনিয়ত দেবীর পূজা অর্চনা আয়োজন করে থাকেন।
আর বিশেষ করে দুর্গাপুজোর সময় এবং নবরাত্রির সময় এখানে খুবই ধুমধাম ভাবে পূজা-অর্চনা করা হয়, তার সাথে সাথে মেলা, উৎসব, অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। যার ফলে স্থানীয় মানুষজন, ছোট থেকে বড় সকলেই উৎসবে মেতে ওঠেন নতুন আনন্দে।
দেশ বিদেশ থেকে অনেকেই এখানে আসেন দেবীর দর্শন করতে। তার পাশাপাশি ৫১ টি শক্তি পীঠের মধ্যে একটি শক্তি পীঠ ঘুরে যাওয়ার মনোবাসনা পূর্ণ করার জন্য। আপনিও চাইলে খুবই সহজেই এখান থেকে ঘুরে আসতে পারেন।