পঞ্চসাগর শক্তিপীঠ: যে স্থানে সতীর নিচের দাঁত সমূহ পতিত হয়েছিল

(Panchsagar Shakti Peeth in Bengali) পঞ্চসাগর শক্তিপীঠের বর্তমান অবস্থান কোন স্থানে? দেবী সতীর কোন অঙ্গ এখানে পতিত হয়েছে? পঞ্চসাগর শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী কি? কিভাবে আরাধনা করা হয়? এই মন্দিরের তাৎপর্য কি? জানুন সবকিছু বিস্তারিত।

সতীর দেহ অংশ গুলি যখন খন্ড বিখন্ড হয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, তখন ভারতের মধ্যে বেশিরভাগ দেহ অংশ গুলি পড়েছিল। তবে ভারতের বাইরে ও প্রতিবেশী দেশ গুলোতেও সতীর দেহ অংশ গুলি পড়ে সেখানেও গড়ে উঠেছে এক একটি শক্তি পীঠ।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, যখন সতী বাবার অমতে গিয়ে মহাদেব কে বিবাহ করেছিলেন তখন রাগে অপমানে দক্ষ রাজা অর্থাৎ সতীর বাবা খুবই রেগে গিয়ে মহাদেবকে অপমান করার জন্য সুযোগ খুঁজছিলেন। এমন ক্ষেত্রে দক্ষ যজ্ঞের আয়োজন করে সেখানে তাদেরকে আমন্ত্রিত না করে এমনিতেই অপমান করেছেন।

Panchsagar Shakti Peeth in Bengali - পঞ্চসাগর শক্তিপীঠ
Panchsagar Shakti Peeth in Bengali – পঞ্চসাগর শক্তিপীঠ

তা সত্বেও সতী যখন বাপের বাড়িতে এসে জানতে চান কেন তাদেরকে নিমন্ত্রন করা হয়নি, তখন দক্ষ রাজা সতীকে অনেক কটু কথা বলতে থাকেন, এমনকি মহাদেব কে অনেক অপমান করতে থাকেন। স্বামীর এই অপমান সহ্য করতে না পেরে দেবী বাপের বাড়িতেই দেহ ত্যাগ করেন।

সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে ফেটে পড়েন মহাদেব সেই দেহ কাঁধে নিয়ে তান্ডব নিত্য শুরু  করে দেন তিনি। এমন ক্ষেত্রে মহাপ্রলয় সৃষ্টি হয় পৃথিবীতে, পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হলে শ্রী বিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দিয়ে মাতা সতীর দেহটি ৫১ টি খন্ডে বিভক্ত করে দেন।

সেই দেহ খন্ড গুলোই পৃথিবীর বুকে যে যে স্থানে পড়েছিল, সেখানে সেখানে একটি করে সতীপীঠ অথবা শক্তিপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়। সেই রকম একটি শক্তিপীঠ হল পঞ্চ সাগর সতী পীঠ। কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, সতীর নিচের পাটির দাঁত সমুহ এই স্থানে মাটিতে পড়েই জন্ম হয়েছে এই পঞ্চসগর সতী পীঠের।

পঞ্চসাগর মন্দিরটি উত্তরপ্রদেশের বারানসীর কাছে অবস্থিত। অনেকের মত অনুসারে এটি উত্তরাখণ্ডে অবস্থিত। এটি ৫১ টি সতী পীঠের মধ্যে একটি অন্যতম সতী পীঠ। পুরাণের কাহিনী অনুসারে এখানে অধিষ্ঠিত দেবী বরাহী ও ভৈরব হলেন মহারুদ্র। সতীপীঠ পঞ্চসাগর অনেকের কাছে বরাহী দেবীর মন্দির নামেও পরিচিত।

পঞ্চসগর শক্তিপীঠ:

শক্তিপীঠের নাম পঞ্চসগর শক্তিপীঠ
স্থান মনমন্দির ঘাট, বারাণসী, উত্তরপ্রদেশ
দেশ ভারত
দেবীর অংশ নিচের দাঁত সমূহ
শক্তির নাম বরাহী

পঞ্চসগর শক্তিপীঠ:

এই শক্তি পীঠের মন্দিরটি অর্থাৎ পঞ্চসাগর মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী খুবই অসাধারণ যা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। যে পাথর দিয়ে এই সতীপীঠ নির্মাণ করা হয়েছে,  সূর্যের আলো পড়লে তা খুবই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, খুবই আশ্চর্যজনক, তাই না ? মন্দিরের পাশেই জলাশয়ে মন্দিরের ছায়া পড়লে এক স্বর্গীয় দৃশ্য আপনি দেখতে পাবেন।

বৈষ্ণব, শৈব এবং শাক্ত ধর্মের মানুষও এই মন্দিরে উপাসনা করতে আসেন। অর্থাৎ বলা যেতেই পারে যে, সকল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই মন্দিরটি একটি উপাসনার কেন্দ্রস্থল। ভোর ৫:৩০ থেকে সকাল ৭:৩০ টা পর্যন্ত মাত্র দু ঘন্টার জন্য এই মন্দিরটি খোলা থাকে জনসাধারণের জন্য। বাকি সারাদিন মন্দির বন্ধ থাকে। মনে করা হয়, দেবী বরাহী রাত্রে সমগ্র বারাণসীকে রক্ষা করেন। 

পঞ্চসাগর শক্তি পীঠের পৌরাণিক কাহিনী:

প্রতিটি শক্তি পীঠের পেছনে রয়েছে এক অজানা ইতিহাস, অজানা রহস্য। সেই সব শুনতে সত্যিই খুবই ভালো লাগে। তেমনি এই শক্তি পীঠের পিছনে রয়েছে অনেক ইতিহাস ও পৌরাণিক কাহিনী। তেমনি এই পঞ্চসাগর শক্তি পীঠের পেছনে রয়েছে এক পৌরাণিক কাহিনী।

মৎস্যপুরাণ অনুসারে জানা যায় যে, মহাদেব নিশাচর এক দৈত্যকে হত্যার জন্য বিষ্ণুর বরাহ অবতারকে পরিবর্তিত করে দেবী বরাহী কে সৃষ্টি করেছিলেন।

হিন্দু ধর্ম অনুসারে যে সাত আট জন মাতৃ দেবীর কল্পনা করা হয়, তার মধ্যে দেবী বরাহী হল অন্যতম। আসলে জানা যায় যে, বরাহি আসলে বরাহ অবতারের নারিশক্তি। সেই শূকরের মত তার চেহারা, তার এক হাতে রয়েছে চক্র এবং অন্য আরেক হাতে রয়েছে তলোয়ার।

এছাড়া দেবী বরাহীকে অনেক জায়গায় মহিষবাহনা হিসেবেও দেখানো হয়েছে। রক্ত বীজের কাহিনীতে দেখা যায় যে, একটি মৃতদেহের উপর বসে শূকরের বেশ ধরে দাঁত দিয়ে বরাহী দেবী শত্রু নিধানের চেষ্টা করছেন। অনেকে আবার মনে করেন বৌদ্ধ দেবতা বজ্র বারাহি ও মরিচির মিশ্রণ এই নাকি হিন্দুদের এই বরাহী দেবীর সৃষ্টি হয়েছে।

পঞ্চসাগর শক্তি পীঠের আরো অন্যান্য পৌরাণিক কাহিনী:

এই দেবীর পীঠ স্থান সন্ধান করেছিলেন কুন্তী পুত্র ভীম। প্রথমে এখানে পীঠ দেবী বা মা বরাহী অজ্ঞাত ছিলেন। অর্থাৎ কেউ জানতেন না যে এখানে একটি শক্তিপীঠ রয়েছে। অজ্ঞাত বাস এর সময় পান্ডব গন এখানে এসে হাজির হন।

সেই সময় দূর্যোধন প্রচুর গুপ্তচর চারিদিকে পাঠিয়েছিলেন পান্ডবদের খুঁজে বের করার জন্য। পান্ডবেরা কিছুদিন এই উড্ডিয়ান প্রদেশে আসেন। এখানে দেবীর দর্শন তারা পেয়েছিলেন।

ভীম তখন দেবীর শরণাপন্ন হলেন, গভীর জঙ্গলে মা-বরাহীর তপস্যা করলেন, মা বরাহী ভীমকে দর্শন দিলেন। পান্ডবদের প্রাকৃতিকভাবে লুকিয়ে রাখার জন্য চতুর্দিকে প্রাচীর সমান পর্বতের সৃষ্টি করলেন। দেবীর সৃষ্টি করা এই প্রাকৃতিক প্রাচীরের মধ্যে এসে সন্ধান করা দুর্যোধনের চরদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।

পঞ্চ সাগর শক্তি পীঠের আবিষ্কার ও পুনরনির্মাণ:

এছাড়া পাহাড়ের মাথায় বর্গক্ষেত্র আকারের একটি আসন এখনো পর্যন্ত আছে। বলা হয় ওই আসনে বসে ভীম বরাহী মায়ের তপস্যা করেছিলেন। ভীম এই পঞ্চকুণ্ড অথবা পঞ্চ সাগর ও মায়ের পীঠ স্থান খুঁজে পেয়েছিলেন। তার দ্বারা মায়ের পূজা হয়।

এরপর এই পীঠ স্থান আবার হারিয়ে যায়। এরপর ১৯৫৪ সালে ২১ শে জুন প্রভুচন্দ্র নামের একজন ভক্ত মায়ের এই পীঠ স্থান আবিষ্কার ও সংস্কার করেন। আবার অন্যান্য মত অনুসারে ১৯৪০ সালে ময়ুরভঞ্জের রাজা এই শক্তিপীঠ উদ্ধার করেন এবং মন্দির স্থাপনা করেন।

পঞ্চ সাগর শক্তিপীঠে উৎসব:

প্রতিটি শক্তি পীঠে পূজা অর্চনা, উৎসব খুবই জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে করা হয়। পঞ্চসাগর সতী পীঠে মহাসমারোহে রথযাত্রা পালন করা হয়। এছাড়াও দুর্গাপূজা, নবরাত্রি, বিজয়া দশমী এবং কালাভাম নামের এক বিশেষ উৎসব পালন করা হয় এই শক্তি পীঠে।

প্রায় প্রতিদিনই স্থানীয় মানুষজন এবং দূর দুরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীরা ফল, দুধ, ঘরে তৈরি মিষ্টি, এবং আরো অন্যান্য নৈবেদ্য দেবীকে উৎসর্গ করেন এবং সকাল সন্ধ্যা তে পুরোহিত মন্ত্র পাঠ ও অন্যান্য আচার অনুষ্ঠান দিয়ে দেবী বরাহীর পূজা করে থাকেন।

এই শক্তি পীঠের চারিদিকের পরিবেশ এতটাই সুন্দর যে, আপনাকে এখানে বারবার টেনে নিয়ে যাবে। মন্দিরের প্রতিচ্ছবি জলে পড়লে যে দৃশ্য আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে তা আপনি কখনোই ভুলতে পারবেন না।

এখানে এক স্বর্গীয় পরিবেশ বিরাজ করছে, আশেপাশের স্থানীয় মানুষজন এখানে প্রতিনিয়ত পূজা দিতে আসেন। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এমন কি দেশের বাইরে থেকেও পর্যটকদের আনাগোনা এই জায়গায় প্রায় সবসময়ই থাকে বললেই চলে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top