শুচিন্দ্রাম শক্তিপীঠ: যে স্থানে সতীর উপরের দাঁত সমূহ পতিত হয়েছিল

(Suchindram Shakti Peeth in Bengali) শুচিন্দ্রাম শক্তিপীঠের বর্তমান অবস্থান কোন স্থানে? দেবী সতীর কোন অঙ্গ এখানে পতিত হয়েছে? শুচিন্দ্রাম শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী কি? কিভাবে আরাধনা করা হয়? এই মন্দিরের তাৎপর্য কি? জানুন সবকিছু বিস্তারিত।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে জানা যায় মাতা সতী নিজের বাপের বাড়িতে বাবার কাছে স্বামী মহাদেবের অপমান সহ্য করতে না পেরে সেখানেই দেহ ত্যাগ করেছিলেন।

মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর পেয়ে মহাদেব উন্মাদ পাগল হয়ে যান, আর সাথে সাথেই সেই স্থানে পৌঁছে সতীর বাবা দক্ষ রাজা কে হত্যা করে দেবীর মৃতদেহ কাঁধে করে তুলে নিয়ে তান্ডব নৃত্য শুরু করে দেন। মহাদেবের সেই তান্ডব নৃত্য তে পৃথিবীর ধ্বংসের আশঙ্কা দেখা দেয়।

Suchindram Shakti Peeth in Bengali - শুচিন্দ্রাম শক্তিপীঠ
Suchindram Shakti Peeth in Bengali – শুচিন্দ্রাম শক্তিপীঠ

তখন শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দিয়ে মাতা সতীর দেহটি ৫১ টি খন্ডে খণ্ডিত করেছিলেন। সেই দেহ খন্ড গুলোই পৃথিবীর বুকে যে যে জায়গায় পড়েছিল সেই সেই জায়গাতে সতী পীঠ অথবা শক্তিপীঠ প্রতিষ্ঠা হয় পরবর্তীতে।

বলা হয় সতীর উপরের দাঁতসমূহ এখানে পড়েছিল। আর তারপর জন্ম হয়েছে শুচিন্দ্রাম শক্তিপীঠ অথবা শুচিতীর্থম শক্তিপীঠের

শুচিন্দ্রাম শক্তিপীঠ:

শক্তিপীঠের নাম শুচিন্দ্রাম শক্তিপীঠ
স্থান শুচি, শুচিতীর্থম শিব মন্দির, কন্যাকুমারী-ত্রিবান্দ্রম রোড, তামিলনাড়ু
দেশ ভারত
দেবীর অংশ উপরের দাঁত সমূহ
শক্তির নাম নারায়ণী

শুচীন্দ্রম / শুচিতীর্থম শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী:

জানা যায় পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, অনেকদিন আগে ভস্মাসুর নামে এক অসুর ছিলেন, তিনি বহু কষ্ট করে মহাদেবের তপস্যা করেন আর সেই তপস্যায় মহাদেব  সন্তুষ্ট হয়ে সেই অসুরকে বর দিতে চাইলে তিনি অজেও হওয়ার বর চাইলেন। মহাদেব তাকে সেই বর দিয়েছিলেন যে, একমাত্র কন্যাকুমারী ছাড়া বাকি যে কোন জায়গাতেই তাকে হারানো যাবে না।

এই বর পেয়ে ভস্মাসুর নিজেকে অজেও ভাবতে শুরু করেন এবং সেই দম্ভে, অহংকারে ধীরে ধীরে ভীষণ অত্যাচারী হয়ে ওঠেন। তার সেই অত্যাচারে সকল মানুষ অতিষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেন। পৃথিবীর মুনি, ঋষি ও স্বর্গের দেবতাদের উপরেও তিনি অত্যাচার চালাতে থাকেন।

তার অত্যাচারে অসহ্য হয়ে দেবতারা সবাই মিলে ভগবান বিষ্ণুর কাছে গিয়ে ভস্মাসুর কে বধ করার উপায় জিজ্ঞাসা করলেন। তখন বিষ্ণু দেবতা দের একটি মহাযজ্ঞ করার পরামর্শ দেন। দেবতারা সেই যজ্ঞ করলে ভগবতী মহামায়া প্রসন্ন হবেন এবং তিনি আবির্ভূত হয়ে কন্যাকুমারী তে ভস্মাসুর কে বধ করবেন আর সেই ভাবেই সবকিছু হলো।

অন্যদিকে আরও একটি কাহিনী অনুসারে জানা যায়, পত্নী অহল্যার সঙ্গে তার অজান্তে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করায় মহর্ষি গৌতম দেবরাজ ইন্দ্র কে ভয়ানক অভিশাপ দিয়েছিলেন। আরো জানা যায় যে, এই জায়গাতেই অর্থাৎ যে জায়গাতে এখন শুচিন্দ্রম শক্তিপীঠ অবস্থিত সেখানে দেবরাজ ইন্দ্র সেই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন।

দেবী ও ভৈরব:

প্রতিটি শক্তি পীঠে দেবী ও ভৈরব বিরাজমান, তেমনি এই শুচিতীর্থম শক্তিপীঠ তে শক্তি অথবা দেবীর নাম নারায়ণী আর ভৈরব হলেন সংহার অর্থাৎ দেবী এখানে নারায়নী রূপে পূজিতা হয়ে থাকেন আর মহাদেব অথবা ভৈরব সংহার নামে পুজিত হয়ে থাকেন।

পীঠ নির্ণয় তন্ত্রের মত অনুসারে “অনল” নামক স্থানে দেবীর উপরের দাঁত পড়েছিল অর্থাৎ উপরের দাঁত সমূহ পড়েছিল। কারো কারো মতে দান্তেওয়াড়ায় এই শক্তিপীঠ অবস্থিত আবার কেউ মনে করেন কন্যাকুমারীর কাছাকাছি শুচিন্দ্রাম তীর্থে এই পীঠ অবস্থিত।

শুচিতির্থম শিব মন্দির / শুচিন্দ্রাম শক্তিপীঠ:

শুচীন্দ্রাম মন্দিরটি তৈরি করা হয়েছিল সপ্তদশ শতকের দিকে। ভারতের তামিলনাড়ুর সঙ্গে কন্যাকুমারী সংযুক্ত হওয়ার আগে শুচীন্দ্রাম মন্দির ত্রীবাঙ্কুর রাজ্যের অধীনে ছিল। এছাড়া এই মন্দিরে দেবী পূজিত হন নারায়নি রূপে।

মন্দিরের ভিতরে দেবীর একটি বিশাল মূর্তি আছে। মূর্তির হাতে একটি ফুলের মালা ও দেখা যায়। “শুচিন্দ্রাম” এর শুচি শব্দটি সংস্কৃত থেকে নেওয়া হয়েছে বলে মনে করা হয়।

এই শব্দটির অর্থ হলো শুদ্ধ অথবা পবিত্র। এই মন্দিরটির আকার অনেকটাই বড় এক কথায় বিশাল মন্দির বলা যায়। মন্দিরের সাদা রংয়ের তোরণ অথবা গোপুরম টি অনেক দূর থেকে লক্ষ্য করা যায়।

আর এটির উচ্চতা প্রায় ২৪ ফুট। মন্দিরের দরজার উপরে রয়েছে সুন্দর সুন্দর কারুকার্য করা নকশা।

শুচিন্দ্রাম  শক্তি পীঠের পূজা অর্চনা:

প্রতিটি মন্দিরে নিত্য পূজার আয়োজন থাকে। তেমনি এই শক্তিপীঠ অথবা এই মন্দিরে নিত্য পূজার ব্যবস্থা রয়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে অনেক ভক্তগণ প্রতিদিনই এখানে আসেন এবং দেবীকে দর্শন করেন। তার সাথে পূজা অর্চনাও করেন।

এখানে প্রায় প্রতিটি উৎসবই খুবই ধুমধাম ভাবে এবং খুবই আড়ম্বর এর সাথে পালন করা হয়।

তবে এই মন্দিরের মূল উৎসব হলো দুটি সেগুলি হল এই মন্দিরের প্রধান আকর্ষণের কেন্দ্র বিন্দু। এই উৎসব দুটি হলো “শুচিন্দ্রাম মারগাজী উৎসব” এবং রথযাত্রা”। এই সময় এখানে প্রচুর ভক্তগণ ও পুণ্যার্থী, দর্শনার্থীরা এসে ভিড় জমান।

অনেক ভক্ত পুজো দেওয়ার আগে উপবাস পালন করেন। সেই সময় মন্দির আলো ও ফুলের মালায় সেজে ওঠে, যা কিনা দেখতে সত্যিই দৃষ্টিনন্দন। এছাড়াও আশ্বিন মাস এবং চৈত্র মাসের নবরাত্রি উৎসব এবং ফাল্গুন মাসের মহা শিবরাত্রি উৎসব খুবই বড় আকারে পালন করা হয়।

এছাড়াও চৈত্র মাসে নবরাত্রির অষ্টম দিনে এখানে পালিত হয় অশোকাষ্টমী। এই সমস্ত উৎসব ছাড়াও তন্ত্র-স্বাস্থ্য অনুযায়ী মেষ সংক্রান্তি এবং রাজা সংক্রান্তি অথবা মিথুন সংক্রান্তীয় এখানকার অন্যতম প্রধান উৎসব বলা যায়।

ভারতের তামিলনাড়ুতে অবস্থিত এই শক্তিপীঠ সাধারণ মানুষ জনের জন্য দেবীর আশীর্বাদ বলা যায়। প্রধান উৎসব গুলি ছাড়াও এখানে সারা বছর ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এবং দেশের বাইরে থেকেও পর্যটক, পুণ্যার্থী, ভক্তদের সমাগম লেগেই থাকে। এখানকার চারিদিকের পরিবেশের সৌন্দর্য উপভোগ করার মত।

এর পাশাপাশি মন্দির চত্বর প্রতিটি উৎসবে সেজে ওঠে নতুন ভাবে। উৎসব গুলি উপলক্ষে এখানে মেলা এবং জনসমাগম ঘটে। যার ফলে স্থানীয় মানুষজন খুবই আনন্দ উপভোগ করে থাকেন। আবার অনেকেই এখানে গিয়ে এই উৎসব গুলি উপভোগ করার জন্য উৎসবের আগে থেকেই এই তীর্থস্থানে যাওয়ার জন্য যাত্রা শুরু করে দেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top