সীতা নবমী 2024 (Sita Navami 2024 Date Time and Significance) 2024 সীতা নবমীর ইতিহাস এবং জানুন সীতা নবমী কেন পালন করা হয়? সীতা নবমীর তাৎপর্য কি? ভারতীয়দের জন্য সীতা নবমীর গুরুত্ব কতটা? জানুন সবকিছু এখানে।
রামায়ণের রামচন্দ্রের সীতা কে চেনেন না, এমন হিন্দু মানুষ নেই বললেই চলে। হিন্দু ধর্মের সীতা নবমীর অনেক গুরুত্ব রয়েছে। বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আর সীতা নবমী হল সীতার জন্মদিন পালনের উৎসব। তাছাড়া সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই দিনটি অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়।
আর এটি একটি এমন বিরল কাকতালীয় ঘটনা এবং দেবী সিতার সাথে ভগবান রামের উপাসনা করা পরিবারের সমৃদ্ধি এবং সুখ নিয়ে আসে বলে মনে করা হয়। রাম নবমী যেমন একটি অত্যন্ত শুভ উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে অনেকদিন আগে থেকে, তেমনি সীতা নবমী কেও অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়।
সীতা নবমীর তাৎপর্য 2024:
এছাড়া বলা যায় যে, শ্রীরামচন্দ্রকে বিষ্ণু এবং সীতাকে মা লক্ষ্মীর রূপ বলা যায়। এই সৌভাগ্যের দিনে যদি ভগবান শ্রী রামের সঙ্গে মা সীতার পূজা করা হয়, তাহলে ভগবান শ্রী বিষ্ণু ও মা লক্ষ্মীর আশীর্বাদ সংসারে বজায় থাকে আজীবন।
সমগ্র ভারতবর্ষের তথা উত্তর ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলে সীতা নবমী উৎসব পালন করা হয়। এছাড়া সীতাকে জানকি নামেও অনেকেই চেনেন। এই দিনে বিবাহিত মহিলারা ও তাদের স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনা করে উপবাস রাখেন আর সীতা নবমীর উৎসব পালন করেন এবং পূজা-অর্চনাও করে থাকেন ঘরে।
সীতাকে লক্ষ্মীর অবতার অর্থাৎ বিষ্ণুর সপ্তম অবতার রামচন্দ্রের স্ত্রী হিসেবে সীতাকে জানা যায়। তাছাড়া সীতা নবমীর ব্রত বিশেষত বিবাহিত মহিলাদের কাছে খুবই পুণ্যব্রত, এই ব্রত পালন করলে স্বামীর দীর্ঘায়ু, স্বামীর কল্যাণ এবং সংসারের মঙ্গল হয় বলে বিশ্বাস।
প্রতিটি গৃহস্থ বাড়িতে সীতা নবমী তিথিতে লক্ষ্মী দেবী সীতা রুপে পূজিত হয়ে আসছেন এবং এই সীতা নবমীর দিন সীতার সঙ্গে বিষ্ণুর অবতার শ্রীরামচন্দ্র এবং শ্রীরামচন্দ্রের ভাই লক্ষণ আর হনুমান জীরও পূজা করা হয়।
সীতা নবমী পূজার পদ্ধতি 2024:
তো চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক, সীতা নবমী পূজার পদ্ধতি সম্পর্কে:
যদিও এই দিনটি সীতা নবমী যেটা সীতার জন্মদিন উপলক্ষে পালন করা হয়, সেটা কিন্তু সকল গৃহস্থ বাড়ির জন্য খুবই মঙ্গলদায়ক।
১) এই দিনে খুব ভরে ওঠে স্নান সেরে, সুন্দর এবং পরিষ্কার কাপড় পরিধান করতে হবে।
২) যদি ঘরে মন্দির থাকে সেই মন্দির ভালো ভাবে পরিষ্কার করুন এবং সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজান। মন্দির পরিষ্কার করার পর প্রদীপ জ্বালান এবং আরো অন্যান্য সাজ সজ্জা করতে পারেন আপনার পছন্দমত।
৩) এরপর গঙ্গা জল দিয়ে দেবতাদের অভিষেক করুন। তার সাথে সাথে সীতার কৃপা পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করুন তার সাথে ভগবান রামচন্দ্রের কাছে প্রার্থনা করুন সমস্ত রকম অশুভ শক্তি কাটিয়ে শুভ শক্তির স্বাগত জানানোর জন্য।
৪) তাছাড়া মা সীতা ও ভগবান রামচন্দ্রের আরতি করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
৫) ভগবান রাম ও মা সীতাকে নৈবেদ্য দিন, মনে রাখবেন যে শুধুমাত্র বিশুদ্ধ জিনিস ঈশ্বরের কাছে নিবেদন করা হয়, সেই হিসেবে কিন্তু আপনি নৈবেদ্য দেবেন।
৬) এই বিশেষ দিনে, আর এই পবিত্র দিনে হনুমানের পূজা করাও খুব শুভ বলে মনে করা হয়, কেননা রামচন্দ্র ও সীতার সঙ্গে হনুমানের সম্পর্ক খুবই মধুর আর হনুমান ছাড়া রামচন্দ্র ও সীতার কথা ভাবাই যায় না।
সীতা নবমীর ইতিহাস ও পৌরাণিক কাহিনী:
সীতা, যিনি হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণের কেন্দ্রীয় প্রধান নারী চরিত্র। যিনি জনকপুরে অর্থাৎ বর্তমানে যেটা মিথিলা, নেপালে অবস্থিত সেখানে জন্মগ্রহণ করেন। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী তিনি ছিলেন হিন্দু অবতার শ্রী রামচন্দ্রের সঙ্গী এবং শক্তিরুপা লক্ষীর অবতার। যিনি কিনা ধনসম্পদের দেবী এবং বিষ্ণুর স্ত্রী।
এছাড়া সীতার অগ্নিপরীক্ষা আর শান্ত স্বভাব হিন্দু সমাজে তাকে আদর্শ স্ত্রী তথা আদর্শ নারীর উদাহরণ হিসেবে মনে করা হয়। তাছাড়া সে তার অগ্নিপরীক্ষার সময় স্বয়ং অগ্নিদেব সীতাকে রক্ষা করেছিলেন, কেননা তিনি ছিলেন পবিত্র নারী। তার উৎসর্গীকরণ, আত্মবিসর্জন, সাহসিকতা এবং বিশুদ্ধতার জন্য তিনি পরিচিতা সবার কাছে।
সীতার সাথে জড়িত পৌরাণিক কাহিনী:
“অদ্ভুত রামায়ণ” থেকে জানা যায় যে, সীতা নাকি রাবণ ও মন্দোদরীর কন্যা, আবার অন্য একটি জায়গায় বলা হয়েছে রাবণ তার ভাত্রিপুত্র নল কুবেরের স্ত্রী রম্ভা কে ধর্ষণ করেছিলেন আর এই ধর্ষণের ফলে রাবনের ঔরসে রম্ভার গর্ভে সীতার জন্ম হয়। এবং সীতার জন্মের আগে গণকরা জানিয়েছিলেন যে, এই সীতাই নাকি রাবণের ধ্বংসের কারণ হবেন আর সেই কারণে রাবণ তাকে পরিত্যাগ করেছিলেন। আবার “আনন্দ রামায়ণ” নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে রাজা পদ্মাক্ষ এর কন্যা পদ্মাই নাকি পরবর্তী জন্মে সীতা হয়েছেন।
রাবণ পদ্মার শ্লীলতাহানি করতে চাইলে তিনি আগুনে নিজের আত্মত্যাগ দেন, পরবর্তী জন্মে তিনি সীতা হিসেবে অবতীর্ণ হন এবং রাবণের ধ্বংসের কারণ হয়ে যে দাঁড়িয়েছিলেন, সেটা আমাদের সকলের অজানা নয়, তাই না ! আর একটি প্রচলিত ধারণা অনুসারে এই সীতা পূর্ব জন্মে ছিলেন বেদবতি নামে একজন পুণ্যবতী নারী। তখনো কিন্তু রাবণ তার শ্লীলতাহানি করতে চাইলে তিনি রাবণকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে, সীতা পরবর্তী জন্মে রাবন কে হত্যা করবেন।
সীতার বিভিন্ন নাম:
রামায়ণের সীতা বহু নামে উল্লিখিত হয়েছেন। তবে তিনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সীতা নামেই পরিচিতা। এছাড়া তিনি জনকের কন্যা বলে তাকে জানকী ও বলা হয়, আবার মিথিলা রাজ্যের কন্যা হওয়ার জন্য তাকে মৈথিলী নামেও অনেকে চেনেন। এছাড়া রামচন্দ্রের স্ত্রী হওয়ার জন্য তাকে রমা ও বলা হয়, আর মাতা সীতা দ্বাপর যুগের রুক্মিণী রূপে অবতীর্ণ হয়েছেন। তাছাড়া রাজা জনক জমি চাষ করার সময় মাটি থেকে সীতাকে পেয়েছিলেন বলে জানা যায়।
রামায়ণের কাহিনী অনুসারে রামচন্দ্র ১৪ বছরের জন্য বনবাসে গেলে সীতা অর্থাৎ তার স্ত্রীও তার সঙ্গী হন, তার সাথে সাথে লক্ষণ ও তাদের সাথে বনবাসে গিয়েছিলেন। বনবাসে গমন করলে চিত্রকুট পর্বতে তারা অবস্থান করেন সেখানে স্বর্ণমৃগ রূপে মারীচ ছলনা করে রাম এবং লক্ষণকে দূরে নিয়ে চলে যান, আর সেই ফাঁকে রাবণ সীতাকে হরণ করেন।
তারপর রাবন সীতাকে হরণ করে লঙ্কায় নিয়ে গেলে রাম ও রাবণের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, এরপরে কিস্কিন্দার বানরদের সহযোগিতায় রাম রাবণকে পরাজিত ও নিহত করে সীতাকে উদ্ধার করেন। শ্রীরামচন্দ্র রাবনের ভাই বিভীষণ কে লঙ্কার রাজা করে দেন, এবং নিজের রাজ্যে সীতা ও লক্ষণের সাথে ফিরে আসেন।
শ্রী রামচন্দ্র রাজা হওয়ার পর সীতার নামে অযোধ্যায় লোকনিন্দা শুরু হয়ে যায়। কেননা রাবন সীতাকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল তার রাজ্যে। সেই লোকনিন্দা থেকে সীতাকে রক্ষা করতে রাজগুরুর আদেশে শ্রীরামচন্দ্র লক্ষণকে মাতা সীতাকে তপোবনে রেখে আসার আদেশ দেন। কারণ সীতা তখন গর্ভবতী ছিলেন, মহর্ষি বাল্মিকীর তপবনে সীতা লব ও কুশ নামে দুটি জমজ পুত্র সন্তানের জন্ম দেন।
তবুও এত কিছুর পরেও লোক নিন্দা কোনমতেই কমেই না, সেই কারণে রামচন্দ্র একজন রাজার দায়িত্ব পালন করার মধ্যে দিয়ে পরবর্তীতে সীতাকে দ্বিতীয়বার অগ্নিপরীক্ষা দিতে বলেন। মর্মাহত হয়ে সীতা পৃথিবীর কোলে আশ্রয় নেওয়ার জন্য প্রার্থনা করলেন, তখন ভূগর্ভ থেকে উঠে ভূদেবী পৃথিবীতে এসে পৃথিবী থেকে সীতাকে নিয়ে পাতালে প্রবেশ করেন।
সীতার জন্ম তিথি উপলক্ষে প্রায় প্রতিটি হিন্দু ঘরে সীতা নবমী উৎসব পালন করা হয়। বিভিন্ন নৈবেদ্য সাজিয়ে, ফুল, ফল, মিষ্টান্ন তে সাজিয়ে তোলা হয় পূজার জায়গা। সীতার সাথে সাথে রামচন্দ্র, লক্ষণ এবং হনুমানেরও পূজা করা হয়। সংসারের উন্নতি, ধন-সম্পদ বৃদ্ধি এবং স্বামীর মঙ্গল কামনায় বিবাহিত মহিলারা সিতা নবমী উৎসব প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত উপবাসের সাথে পালন করে আসছেন।