মহাকালেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির, মধ্যপ্রদেশ – Mahakaleshwar Jyotirlinga Temple

মহাকালেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির (Mahakaleshwar Jyotirlinga Temple): ১২টি পবিত্র জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে অন্যতম হলো এই মহাকালেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির। এই মন্দিরটি ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের উজ্জয়িনী শহরে রুদ্রসাগর হ্রদের তীরে অবস্থিত। এই মন্দিরের শিবলিঙ্গটিকে স্বয়ম্ভূ বা শিবের সাক্ষাৎ মূর্তি বলেও মনে করা হয়।

মহাকালেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির, মধ্যপ্রদেশ - Mahakaleshwar Jyotirlinga Temple
মহাকালেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির, মধ্যপ্রদেশ – Mahakaleshwar Jyotirlinga Temple

প্রতিটি উৎসব, প্রতিটি মন্দির প্রতিষ্ঠার পিছনে থাকে কোন না কোন ইতিহাস। তেমনি মহাকালেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরের ক্ষেত্রে তার অন্যান্য এই মন্দিরের পিছনে রয়েছে ইতিহাস। তো চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক এই মন্দির সম্পর্কে:- 

মহাকালেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির এর ইতিহাস:

এই মহাকালেশ্বর মন্দিরের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে গেলে ১২৩৪ থেকে ১২৩৫ সালে সুলতান শাশুদ্দিন ইলতুৎমিস উজ্জয়িনী লুট করার সময় মহাকালেশ্বর মন্দির চত্বর ধ্বংস করেছিলেন।

১৭৩৬ সালে হিন্দু পাদ পাদ শাহীর ছত্রপতি শাহু মহারাজ ও পেশোয়া বাজি রাও এর সেনাপতি রানুজিরা ও সিন্ধে মহারাজ বর্তমান মন্দির কে নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে মহোদয় মহারাজ ও মহারানী বাইজাবাই রাজেশ সিন্ধে এই মন্দিরের সংস্কার ও ব্যবস্থাপনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েছিলেন।

মহাকালেশ্বর মন্দিরের পৌরাণিক কাহিনী: 

পুরান অনুসারে উজ্জয়িনী শহরটির নাম ছিল অবন্তিকা। এই শহরটি ছিল খুবই সুন্দর এবং ধর্মীয় চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু। বহুদূর দুরন্তর থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে আসতেন হিন্দু শাস্ত্র সম্পর্কে শিক্ষা অর্জন করতে। তখন একজন শাসক ছিলেন তিনি ছিলেন অত্যন্ত সিদ্ধ এবং শিব ভক্ত।

সেখানে একটি বালক থাকতো শিখর, যে কিনা প্রাসাদের পাশ থেকে যেতে যেতে শুনতে পায় যে রাজা শিবের নাম জপ করছেন। সেও তখন ছুটে মন্দিরে গিয়ে তার সঙ্গে শিবের প্রার্থনা শুরু করে দেয়, প্রহরীরা তাকে টেনে সেখান থেকে বের করে শহরের বাইরের শিপ্রা নদীর তীরে রেখে দিয়ে আসে।

উজ্জয়িনীর পার্শ্ববর্তী দুই শত্রু রাজ্যের রাজা রিপু দমন এবং সিংহাদিত্য সেই সময় উজ্জয়িনীর সম্পদের লোভে রাজ্য আক্রমণের কথা ভাবছিলেন। এই কথা শুনে শিখর প্রার্থনা শুরু করে। সেই খবর পৌঁছায় বৃধি নামে এক পুরোহিতের কাছে। তিনি এই কথা শুনে ভয়ে ভীত হয়ে পড়েন এবং ছেলেদের একান্ত অনুরোধে শিপ্রা নদীর তীরে গিয়ে শিবের কাছে প্রার্থনা শুরু করেন।

ব্রহ্মার আশীর্বাদে দূষণ নামে এক দৈত্য অদৃশ্য হয়ে যাবার ক্ষমতা পেয়েছিল। শত্রু রাজারা দূষণের সাহায্যে উজ্জয়িনী রাজ্য আক্রমণ করার সহযোগিতা পায়। যুদ্ধে তাদেরই জয় হয় এবং তারা সবাই শিব ভক্ত দের উপরে অত্যাচার শুরু করে দেয়।

এমন পরিস্থিতিতে অসহায় সমস্ত শিব ভক্তদের প্রার্থনা শুনে শিব মহাকালের রূপে উজ্জয়িনীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তারপর চন্দ্র সেন এর শত্রুদের ধ্বংস করেন। শিখর ও বৃধির অনুরোধে শিব উজ্জয়নীতে বাস করতে রাজি হন। তিনি হন রাজ্যের প্রধান দেবতা এবং শিব ভক্তদের রক্ষাকর্তা আর সেই দিন থেকে উজ্জয়িনীতে মহাকাল রূপে শিব তার শক্তি পার্বতীকে নিয়ে বসবাস করছেন আজও।

আরেকটি পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, ভগবান শিব মহেকালেশ্বরকেও ডাকতেন। মহাকালেশ্বর মানে সময়ের প্রভু। সতী অথবা পার্বতী তার বাবা দক্ষিণ শিবের সাথে তার বিবাহের বিরোধিতা করার পরে পার্বতী আগুনে পদার্পণ করেছিলেন। তিনি তখন তাণ্ডব বা মৃত্যুর নৃত্য পরিবেশন করেছিলেন।

যা কিনা তার মহাকাল বা মহাকালেশ্বর হিসাবে মানুষের কাছে পরিচিত করেছিল। অন্যদিকে রাক্ষস দূষণ শিব উপাসকদের প্রতি এতটাই অন্যায় অবিচার করছিল যে যা শিবকে ক্রুদ্ধ করেছিল, এবং তার ক্রোধে তিনি বিশ্বকে অর্ধেক ভাগ করে দেন যা দেখে মহাকালেশ্বর নাম দেয়।

আরো একটি কাহিনী অনুযায়ী জানা যায় যে, রাজা গন্ধর্ব সেনের শ্রেষ্ঠ পুত্র ভর্থরী কে ঈশ্বর ইন্দ্র এবং ধারার রাজা উজ্জয়িনী রাজ্য দিয়েছিলেন। সেখানে এক ব্রাহ্মণ বাস করতেন তিনি বছরের পর বছর তপস্যা করার পর কল্প বৃক্ষের স্বর্গীয় বৃক্ষ থেকে অমরত্বের ফল পেয়েছিলেন। যিনি এটি রাজাকে দিয়েছিলেন, যিনি এটি তার প্রিয় রানীকে দিয়েছিলেন, রানী মহাকালের প্রেমে পড়েছিলেন।

সেই স্বর্গীয় অমরত্বের ফল চক্রাকারে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার এই চক্রটি রানীর অবিশ্বাস প্রকাশ করেছিল। তাই রাজা রানীর শিরচ্ছেদ করার নির্দেশ দেন। এরপরে তিনি সিংহাসন ত্যাগ করেন এবং একজন ধর্মীয় পুরুষ হয়ে ওঠেন।

এই মন্দিরে শিবলিঙ্গ দক্ষিণমুখী। ১৮ টি শক্তিপীঠের অন্যতম তীর্থের ইতিহাস জানলে সত্যি অবাক হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। এছাড়া মহাকালেশ্বর মন্দিরের প্রধান আকর্ষণ গুলির মধ্যে একটি হলো এই মন্দিরে ভস্ম আরতি যা সকাল চারটের সময় অনুষ্ঠিত হয়।

ঘাট থেকে প্রাপ্ত পবিত্র ছাই দিয়ে মূর্তিগুলিকে পূজা করা হয় এবং পবিত্র মন্ত্র দিয়ে পূজা সম্পন্ন করা হয়। আরতিতে ভস্ম অথবা ছাই না নিয়ে মহাকালেশ্বর মন্দিরে যাওয়া আদর্শ নয়।

মহাকালেশ্বর এর মূর্তি আবার দক্ষিণমুখী নামে পরিচিত। মন্দিরটিকে ১৮ টি শক্তি পিঠের একটি হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। কালিদাস তার রচনা “মেঘদূত” তে মন্দির এবং এর আচার অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ করেছেন।

মহাদেব, যাকে আমরা আরও অনেক নামে চিনি, যেমন ধরুন নীলকন্ঠ, মহাকাল, ভৈরব, দেবাদীদেব, শিব, শম্ভু প্রভৃতি। রাগান্বিত অবস্থায় যে রূপ তিনি ধারণ করেছিলেন সেই রূপকেই মহাকাল হিসেবে মনে করা হয়। তবে অনেক জায়গায় শান্ত শিব এর উপাসনাও হয়ে থাকে।

তবে এটা বিশ্বাস করা হয় যে, একবার যখন শিব রেগে যাবেন তখন কিন্তু এই ধরণী তছনছ হয়ে যেতে বেশিক্ষণ সময় নেবে না। তাইতো তাকে শান্ত করে রাখার জন্য শিবলিঙ্গে অথবা শিবের মাথায় জল, ডাবের জল, দুধ ঢেলে মাথা ঠান্ডা করে রাখতে হয়, তাই নয় কি !

এই মন্দিরের পিছনের ইতিহাস সম্পর্কে সকলেই না জানলেও এই মন্দিরে ভক্তদের ভিড় একেবারে উপচে পড়ে। নিজের মনের ইচ্ছা, স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা সবকিছু ঈশ্বরের কাছে নিবেদন করে ভক্তিভরে পূজা, ব্রত, উপবাস করা হয়। যা মানুষকে মনের শান্তি, ভক্তি, শ্রদ্ধা বাড়িয়ে তোলে অনেকগুণ, কি বলেন আপনারা !

Leave a Comment