শিশুর কাস্টডি বা অভিভাবকত্ব প্রদানের আইনটি খুবই সংবেদনশীল একটি আইন। সন্তানের অভিভাবকত্ব কার কাছে থাকবে তা নির্ধারণের জন্য আদালত এমন একটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে যা সন্তানের সর্বোত্তম স্বার্থ নিশ্চিত করে। একটি পরিবারে যখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায়, তখন এটা তাদের জন্য যেমন বেদনাদায়ক, তারচেয়ে বেশী বেদনাদায়ক হচ্ছে একজন শিশুর জন্য।
কারণ তার মা-বাবা আবার নতুনভাবে জীবন শুরু করতে পারলেও শিশুটি মা-বাবা দুজনের সমান আদর-ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হয়। তার বাইরের পরিবেশ এবং জীবন-যাপনও এলোমেলো হয়ে যায়। এক্ষেত্রে শিশুর স্বার্থ নিশ্চিত করতে তাই ভারতের আইন কার্যকর উপায় অনুসরণ করে থাকে।
বেশ কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করে শিশুর জন্য সর্বোত্তম কাস্টডি বা অভিভাবক নির্ধারণ করে যা শিশুকে সুন্দর একটি জীবন নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।
সুপ্রিয় পাঠক আমাদের আজকের আলোচনায় থাকছে ভারতে শিশুর কাস্টডি বা অভিভাবকত্ব প্রদান আইন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা। চলুন দেরী না করে মূল আলোচনায় যাওয়া যাক।
বৈবাহিক সমস্যার সমাধান করুন বিবাহ পরামর্শ দিয়ে – জানুন কিভাবে?
ভারতে শিশুদের কাস্টোডি প্রদান আইন:-
কাস্টডি প্রদানের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়
বিবাহিত দম্পতিদের মধ্যে যখন বিবাহবিচ্ছেদ হয়, তখন সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে গুরুতর সমস্যা দেখা দেয়। শিশুর অভিভাবকত্ব একটি সূক্ষ্ম এবং সংবেদনশীল বিষয় । আদালত যখন সন্তানের দায়িত্ব বাবা-মায়ের মধ্যে যেকোনো একজনকে দেওয়ার আগে বিভিন্ন বিষয় খতিয়ে দেখে।
পিতা-মাতার আর্থিক অবস্থা, জীবনযাত্রা, সন্তানের সাথে বোঝাপড়া এবং শিশুর শিক্ষাগত, সামাজিক এবং অন্যান্য প্রয়োজনগুলি পূরণ করার ক্ষমতা এগুলো সন্তানের কাস্টডি নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে সন্তানের কল্যাণে তার প্রাথমিক নিরাপত্তা এবং অন্যান্য সকল বিষয়ই বিবেচনায় আনা হয়।
যেমন পিতা-মাতার হয়ত অর্থ, সামাজিক মর্যাদা রয়েছে, কিন্তু সন্তানকে তারা সময় দিতে পারেন না, সন্তান তাদের কাছে নিরাপদও নয়। সেক্ষেত্রে আদালত কাস্টডির ব্যাপারে নিরাপত্তাকে আগে প্রাধান্য দেবে।
ভারতে কাস্টডির বিভিন্ন ধরন-
ফিজিক্যাল কাস্টোডি– এই কাস্টডির ক্ষেত্রে, সন্তানের অভিভাবকত্ব পিতা-মাতা যেকোন একজনকে দেওয়া হয়। পিতা-মাতা যেকোন একজনের কাছে শিশু সবসময় থাকবে, বড় হবে।
মাতা-পিতার মধ্যে যে সন্তানের দায়িত্ব পালন করবে সে সবসময় শিশুর দায়িত্বে থাকলেও অন্যজন শিশুর সাথে মাঝেমাঝে দেখা করার অনুমতি পাবেন।
যৌথ কাস্টডি: এই জাতীয় কাস্টডির ক্ষেত্রে, বাবা-মা উভয়কেই শিশুর অভিভাবকত্ব অধিকার দেওয়া হয়। শিশু সমান বা নির্ধারিত সময়ের জন্য বাবা-মা উভয়ের সাথেই থাকে।
এক্ষেত্রে কতদিন পিতার কাছে, কতদিন মাতার কাছে থাকবে সেটা পিতা-মাতা দুজন আলোচনা সাপেক্ষে নির্ধারণ করবেন। যেসব মা-বাবার মধ্যে সম্পর্ক আলোচনা করার মত বন্ধুত্বপূর্ণ তাদের শিশুদের এ ধরনের কাস্টডি প্রদান করা হয়।
ডিভোর্স হলে সন্তানের আইনি অধিকার কে পাবে? মা না বাবা? জেনে নিন
একক কাস্টডি– এই জাতীয় কাস্টডির ক্ষেত্রে পিতা-মাতার মধ্যে যেকোন একজনকে সন্তানের অভিভাবকত্ব প্রদান করা হয়। অন্য অভিভাবক সন্তানের অভিভাবকত্বের জন্য অযোগ্য ঘোষিত হয় এবং তাই তার সাথে সন্তানের যোগাযোগ নিষিদ্ধ করা হয়।
যেসব মা-বাবার যেকোন একজনের দ্বারা শিশুর ক্ষতির আশঙ্কা থাকে তাদের ক্ষেত্রে মূলত এ ধরনের কাস্টডি প্রদান করা হয়।
তৃতীয় পক্ষের কাস্টডি: এই জাতীয় কাস্টডির ক্ষেত্রে সন্তানের বাবা-মা কারও কাছে সন্তানের অভিভাবকত্বের অধিকার দেওয়া হয় না। বরং তৃতীয় পক্ষকে বা বাবা-মায়ের পক্ষের আত্মীয়দের কাছে সন্তানের কাস্টডি প্রদান করা হয়।
যেসব পরিবারে মা-বাবা কেউই সন্তানের জন্য নিরাপদ বা মঙ্গলজনক নয় অথবা অন্য কোন অসুবিধা থাকে সেসব ক্ষেত্রে এ ধরনের কাস্টডি প্রদান করে থাকে ভারতীয় আদালত।
ভারতে শিশুর কাস্টডির গভর্নিং আইন
ভারতে বিভিন্ন আইন রয়েছে যা শিশুদের সঠিক কাস্টডি প্রদানের বিষয়ে কাজ করে। ধর্ম-বর্ণ অনুযায়ী কাস্টডি প্রদানের ক্ষেত্রে কিছু বিবেচ্য বিষয় থাকে। ধর্ম নিরপেক্ষভাবেও আদালত শিশুর কাস্টডির বিষয়ে সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে থাকে।
অভিভাবক ও ওয়ার্ড আইন, ১৮৯০ (১) অনুযায়ী শিশুদের অভিভাবকত্ব প্রদান করা হয়, যা ধর্মনিরপেক্ষ আইন। সন্তানের বা সন্তানের বাবা-মা উভয়ের ক্ষেত্রে এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আইনটি প্রযোজ্য। এই আইনে অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের নিজের দেখাশোনা ও সম্পত্তির তত্ত্বাবধানের জন্য অভিভাবক নিয়োগের বিধান রয়েছে।
যৌথ অভিভাবকদের জন্য রয়েছে আলাদা বিধান। আইনের ১ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আদালতকে নাবালকের কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রেখে সমস্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ধর্মভেদে কাস্টডির নিয়ম
হিন্দু সংখ্যালঘু ও অভিভাবক আইন, ১৯৫৬ (২) এই আইনটি কেবল হিন্দুধর্মাবলম্বীদের জন্যই প্রযোজ্য। এই আইনের আওতায় হিন্দু নাবালকের প্রকৃত অভিভাবকের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সন্তানের বয়স এবং সময় গণনা করা হয়।
মা তার সন্তানের বয়স ৫ বছর হওয়া পর্যন্ত প্রকৃত অভিভাবক। তার পরে, পুত্র এবং অবিবাহিত কন্যার অভিভাবক হবেন বাবা এবং মা উভয়েই। অভিভাবক নাবালক সন্তানের ভাল-মন্দ নাবালকের সম্পত্তি তত্ত্বাবধান করবেন।
তবে অভিভাবকগণ যদি নাবালক সন্তানের নামের সম্পত্তি বিক্রয়, উপহার, বন্ধক ইত্যাদি কোন কাজ করতে চান, তার জন্য আদালতের অনুমতি প্রয়োজন হবে।
মুসলিম আইন -মুসলিম আইন কেবল মাকে সন্তানের অভিভাবকত্ব দেওয়া হয়। কোন ক্ষেত্রে যদি দুর্ব্যবহার বা অন্য কোন বিশেষ অপরাধের জন্য মা দোষী সাব্যস্ত হন, সেক্ষেত্রে সন্তানের কাস্টডি সন্তানের পিতাকে প্রদান করা হয়।
খ্রিস্টান আইন- খ্রিস্টধর্মে সন্তানের কাস্টডি সম্পর্কিত বিধানগুলি ভারতীয় তালাক আইন, ১৮৬৯ অনুসারে পরিচালিত হয়।
ধারা ৪১, ৪২ এবং ৪৩ অনুযায়ী তারা বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আবেদন করতে পারেন এবং সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণ, হেফাজত সম্পর্কিত কোনও আদেশ পাস করার জন্য তারা আদালতের ক্ষমতার উপর নির্ভর করেন এবং সন্তানের জন্য সর্বোত্তম হবে এমন সিদ্ধান্ত মেনে নেন।
ভারতে বিবাহের যৌতুক আইন কানুন ও শাস্তি কি? যৌতুক অধিনিয়ম জানুন
শেষ কথা
স্বামী-স্ত্রী বিচ্ছেদের পর তাদের নাবালক সন্তানের অভিভাবকত্বের জন্য আদালতে দাবি জানায়। আদালত সেক্ষেত্রে সন্তান কার কাছে ভাল থাকবে, সন্তানের প্রয়োজন, ধর্মীয় আইন, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, মা-বাবার চারিত্রিক বিষয়, তাদের কাছে সন্তান কতটা ভাল থাকবে এইসব সার্বিক দিক বিবেচনায় সন্তানের অভিভাবকত্ব বা কাস্টডি নির্ধারণ করে থাকে। মা-বাবা উভয়েই, বাবা-মা যেকোন একজন অথবা তৃতীয় কোন বিশ্বস্ত পক্ষ সন্তানের কাস্টডি পেতে থাকে।
তাদের পরিচালনা এবং নাবালক সন্তানের সম্পত্তির পরিচালনাও সন্তান সাবালক না হওয়া পর্যন্ত কাস্টডি পাওয়া অভিভাবক দেখাশোনা করে থাকেন। আশা করি ভারতে শিশুর কাস্টডি আইন সম্পর্কে বিস্তারিত জানানোর ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। সুপ্রিয় পাঠক পোস্টটি পড়ে আপনাদের মতামত জানাতে ভুলবেন না।
এরপর কোন বিষয় নিয়ে জানতে চান তা আমাদের কমেন্ট করে জানান। আমরা পরবর্তীতে সে বিষয়ে তথ্য নিয়ে হাজির হব। আজকের মত এখানেই শেষ করছি।
ধন্যবাদ সবাইকে।