লক্ষ্মী পূজা 2023 (Lakshmi Puja 2023 Date Time and Significance) 2023 লক্ষ্মী পূজা ইতিহাস এবং জানুন লক্ষ্মী পূজা কেন পালন করা হয়? লক্ষ্মী পূজা তাৎপর্য কি? ভারতীয়দের জন্য লক্ষ্মী পূজা গুরুত্ব কতটা? জানুন সবকিছু এখানে।
প্রতিটি হিন্দু বাড়িতে মন্দির অথবা ঠাকুর ঘরে লক্ষ্মী দেবীর প্রতিমা থাকবে না, এমনটা হতেই পারে না। লক্ষ্মী দেবী হলেন একজন হিন্দু দেবী। যিনি কিনা ধনসম্পদ, আধ্যাত্মিক সম্পদ, সৌভাগ্য ও সৌন্দর্যের দেবী হিসেবে পরিচিতা। তিনি বিষ্ণুর পত্নী, অন্য দিকে মা লক্ষ্মীর অপর নাম মহালক্ষী, তার বাহন হলো সাদা পেঁচা।
প্রতিটি ঘরে ঘরে বৃহস্পতিবার আসলেই লক্ষ্মী দেবীর পূজায় মেতে ওঠেন হিন্দু পরিবার। সকাল থেকে এই দিন সপ্তাহের মধ্যে বিশেষ দিন হিসেবে পরিচিত হয়। লক্ষ্মী বার অথবা লক্ষ্মী পূজার দিন হিসাবে। পুরোহিত ডেকে পূজা না করলেও নিজেরাই ঘরেতে এমন লক্ষ্মী পূজা করা যেতেই পারে।
লক্ষ্মী ছয়টি বিশেষ গুণের অধিকারী। তিনি বিষ্ণুর শক্তির ও উৎস, নারায়ণ বিভিন্ন অবতার গ্রহণ করলে লক্ষ্মী ও কিন্তু সীতা, রাধা এবং রুক্মিনী রূপে তাদের সঙ্গিনী হয়েছেন। সাধারণত লক্ষ্মী পূজার পাশাপাশি কোজাগরী পূর্ণিমার দিন তার বিশেষ পূজার আয়োজন করা হয়, আর এই পূজা কোজাগরি লক্ষী পূজা নামে খ্যাত।
কোজাগরী লক্ষ্মী পূজায় এই পদ্ধতি মানলে হবে মা লক্ষ্মীর প্রচুর কৃপা
বাঙালি হিন্দুরা প্রতি বৃহস্পতিবার এই লক্ষ্মী পূজা করে থাকেন সংসারে ধন-সম্পত্তি এবং আধ্যাত্মিক সম্পত্তি ও সৌন্দর্য বৃদ্ধির আশায়।
লক্ষ্মীর ব্রত কথা 2023:
লক্ষ্মী দেবী কে ঘিরে বাংলার জনসমাজের বিভিন্ন জনপ্রিয় গল্প প্রচলিত রয়েছে। এই গল্প গুলি পাঁচালীর আকারে লক্ষ্মী পূজার দিন পাঠ করা হয়ে থাকে। আর এই বিষয়টিকে লক্ষ্মীর পাঁচালী বলা হয়। লক্ষ্মীর ব্রত কথা গুলির মধ্যে বৃহস্পতিবারের ব্রত কথা সব থেকে জনপ্রিয়। এছাড়াও বারো মাসের পাঁচালীতেও লক্ষীকে নিয়ে অনেক লৌকিক গল্পের উল্লেখ পাওয়া যায়।
লক্ষ্মী পূজার বৃহস্পতিবার এর ব্রত কথা:
প্রতিটি বাঙালি হিন্দু বৃহস্পতিবার লক্ষ্মী দেবীর সাপ্তাহিক পূজা করে থাকেন। এই পূজা সাধারণত বাড়ির সদবা মহিলারা করে থাকেন, বৃহস্পতিবারের ব্রতকথায় এই বৃহস্পতি বারের লক্ষ্মী ব্রত ও পূজা প্রচলন সম্পর্কে একটি গল্প রয়েছে।
তো চলুন তাহলে সেই লোক কথা সম্পর্কে জানা যাক:-
একসময় দোল পূর্ণিমার রাতে নারদ লক্ষী ও নারায়ণ এর কাছে গিয়ে মর্ত্যের মানুষদের নানা দুঃখ কষ্টের কথা বলতে লাগলেন। মানুষের নিজেদের কুকর্মের ফলকেই এসব দুঃখের কারণ বলে চিহ্নিত করলেন। কিন্তু নারদের অনুরোধে মানুষের দুঃখ কষ্ট খোঁচানোর জন্য তিনি মর্তলোকে লক্ষ্মী ব্রত প্রচার করতে এলেন।
অবন্তি নগরে ধনেশ্বর নামে এক ধনী বণিক বসবাস করতেন, তার মৃত্যুর পর তার ছেলেদের মধ্যে বিষয় সম্পত্তি, আরো অন্যান্য ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া চলছিল। ধনেশ্বর এর বিধবা স্ত্রী সেই ঝগড়াই অতিষ্ঠ হয়ে বনে আত্মহত্যা করতে এসেছিলেন, তখনই লক্ষ্মী তাকে লক্ষ্মী ব্রত করার উপদেশ দিয়ে বাড়িতে ফেরত পাঠিয়েছিলেন।
ধনেশ্বরের স্ত্রী তার পুত্রবধূদের দিয়ে লক্ষ্মী ব্রত করাতেই তাদের সংসারে সমস্ত দুঃখ-কষ্ট সরে গেল। ফলে লক্ষ্মী ব্রতের কথা অবন্তি নগরে চারিদিকে প্রচারিত হয়ে গেল এবং দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল।
তারপর একদিন অবন্তীর নগরের সধবার স্ত্রীরা লক্ষ্মী পূজা করছেন এমন সময় শ্রীনগরের এক যুবক বণিক এসে তাদের ব্রতকে ব্যঙ্গ করল। ফলে লক্ষ্মী তার উপরে ভীষণভাবে রেগে গেলেন, সেও সমস্ত ধন-সম্পত্তি হারিয়ে অবন্তি নগরী তে ভিক্ষা করতে লাগলো। এরপর লক্ষ্মী তাকে ক্ষমা করে তার সব ধন সম্পত্তি ফিরিয়ে দিলেন। আর আবার এইভাবে সমাজের লক্ষী ব্রত প্রচলিত হয়ে গেল ভীষণভাবে।
লক্ষী পূজার ক্ষেত্রে লক্ষ্মী দেবী নিজের ভক্তদের ধন সম্পদ ও সমস্ত মনের ইচ্ছা পূরণের আশীর্বাদ দেন এবং অলক্ষ্মী বিনাশ করে দেন। অন্যদিকে শত পথ ব্রাহ্মণে ব্রহ্মা থেকে লক্ষ্মীর উৎপত্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। মাটির মূর্তি, সরা ইত্যাদি নানা রূপে লক্ষ্মী পূজিত হন বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে।
বাড়িতে, পুরোহিত ছাড়াই কিভাবে লক্ষ্মী পূজা পালন করবেন?
যেহেতু কোজাগরীয় লক্ষ্মীপূজা ছাড়া বছরে যে কোন লক্ষী পূজা আপনি ঘরেতে নিজে থেকেই করতে পারবেন পুরোহিত ছাড়াই, তো সে ক্ষেত্রে আপনাকে যে সমস্ত বিষয়গুলি খেয়াল রাখতে হবে সেগুলি নিচে দেওয়া হল।
- প্রথমে চারিদিকে এবং যে বা যারা এই লক্ষী পূজা করবেন তাদের মাথায় গঙ্গা জল ছিটিয়ে নিতে হবে।
- তারপর নারায়ণ কে স্মরণ করে পূজা শুরু করতে হবে।
- পুজোর জায়গায় একটি তামার পাত্রে জল রাখুন, সূর্যকে এই জল অর্পণ করতে হবে, সূর্যকে স্মরণ করে তামার পাত্রে জল ঢালতে ঢালতেই সূর্যকে স্মরণ করুন।
- মাটির একটি গোল আকার দিয়ে তার উপরে ঘর বসান। ঘটের সামনে ধান ছড়িয়ে দিতে হবে। ঘটে সিঁদুর দিয়ে স্বস্তিক চিহ্ন আঁকুন।
- এরপর ঘটে জল ভরে তার উপরে আমের পল্লব রাখুন এবং আম পাতার উপরে তেল ও সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে দিতে হবে।
- পাতার উপরে হরিতকি, ফুল, দুর্বা ইত্যাদি রাখুন। এরপর ঘট স্থাপনের পর লক্ষ্মীকে প্রণাম করতে হবে ধ্যান মন্ত্র দিয়ে।
- তারপর লক্ষীটি আহ্বান করুন হাত জোড় করে, লক্ষ্মীকে স্মরণ করে বলুন “এসো মা লক্ষ্মী, আমার গৃহে প্রবেশ কর। সামর্থ্য অনুযায়ী এই সামান্য আয়োজন এবং নৈবেদ্য গ্রহণ করো”।
- এরপর লক্ষীর পা ধুয়ে দিতে হবে, লক্ষ্মী পায়ের আলপনা দিয়ে আঁকা পায়ে জলের ছিটে দিন, এবারে ঘটে আতপ চাল, ফুল ও চন্দন, দুর্বাঘাস দিয়ে দিন।
- তারপর এক এক করে লক্ষ্মীকে সব কিছু অর্পণ করুন।
- এছাড়া ফল, মিষ্টি, ইত্যাদি নৈবেদ্য দিতে হবে। তাছাড়া তার সাথে রয়েছে ধুপ ধুনো, সব অর্পণ করার পর এবার পুষ্পাঞ্জলি দিতে হবে।
- হাতে ফুল নিয়ে পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র বলে তিনবার অঞ্জলি দিতে হবে।
- এরপর লক্ষ্মীর বাহন সাদা প্যাঁচা কে ফুল দিন এবং নারায়ণকে স্মরণ করে ঘটে ফুল দিয়ে দিন।
- এবার ইন্দ্র ও কুবের কে স্মরণ করে ঘটে ফুল দিন, তারপর লক্ষ্মী কে প্রণাম করুন। অবশেষে লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়ে পূজা সম্পন্ন করুন।
লক্ষ্মী পূজাতে যে সমস্ত বিষয় গুলি আপনাকে এড়িয়ে চলতে হবে:
- লক্ষী পূজায় কাসর ঘন্টা বাজাবেন না, এতে লক্ষ্মী খুবই অসন্তুষ্ট হন। শুধুমাত্র শাঁখ বাজাবেন।
- লক্ষীর ঘটে তুলসী পাতা দেবেন না।
- লোহার বাসন ব্যবহার করা যাবে না।
দেবীর লক্ষ্মীর কিছু বিষয় আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে:
- মা লক্ষ্মী হলেন ধন-সম্পদ ও আধ্যাত্মিক সম্পদ বৃদ্ধির দেবী। তার আরাধনায় সংসার ভরে ওঠে ঐশ্বর্য এবং প্রাচুর্যে। তাই ঘরে ঘরে মা লক্ষ্মীর আরাধনায় ব্রতী হয়ে থাকেন সবাই।
- মা লক্ষ্মী কিন্তু অল্পতেই সন্তুষ্ট হন, কিন্তু মা লক্ষ্মী কখনোই উচ্চস্বরে শব্দ পছন্দ করেন না। তাই এই পূজায় কাসর, ঘন্টা, বাজানো থেকে অবশ্যই বিরত থাকুন।
- লক্ষ্মী পূজায় চেষ্টা করবেন শুভ্র বর্ণ ছাড়া লাল, গোলাপি ও অন্য রঙের ফুলের আয়োজন করতে। মা লক্ষ্মীর বসার আসন ও রঙিন হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।
- যদি মা লক্ষ্মীর কৃপা পেতে চান তাহলে এই পূজায় তুলসী পাতা কখনোই ভুলেও অর্পণ করবেন না। তবে লক্ষ্মী পূজার পর একটি ফুল ও দুটি তুলসী পাতা দিয়ে নারায়ণ কে পূজা করতে পারেন।
- লক্ষ্মী পূজার সময় লোহার এবং স্টিলের বাসন ব্যবহার করা যাবে না কোন মতেই।
- পূজার পর ব্রতকথা পাঠ করা অবশ্যই অবশ্যই দরকার।
- পূজার আগে পূজার জায়গা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে ধূপ এবং প্রদীপ জ্বালাতে হবে।
- লক্ষী পূজার জায়গায় মা লক্ষ্মীর পায়ের আলপনা আঁকতে হবে, ঘটের পাশেও একটি লক্ষ্মীর পা অবশ্যই আঁকতে হবে।
মা লক্ষ্মীর বাহন সাদা পেঁচা কেন?
কোন দেবদেবীর বাহন এর ক্ষেত্রেও কিছু ঘটনা থাকে। মা লক্ষ্মীর বাহন হল পেঁচা, সেটা কেন চলুন জেনে নেওয়া যাক:- কেউ কেউ বলেন এটি বিষ্ণুর বাহন গরুড় এর পরিবর্তিত রূপ।
মা লক্ষী আসলে তার স্বামীর বাহনটি ব্যবহার করেন, কিন্তু এই রূপ প্যাঁচার কেন ? লক্ষ্মীর দেওয়া ধন-সম্পত্তির যারা অপব্যবহার করে, তাদের কপালে লেখা আছে যমের দন্ড। এই কথা ঘোষণা করে লক্ষ্মীর বাহন।
তাই কথাই বলে “লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু” তা ছাড়া ধনসম্পত্তি এবং যে সমস্ত টাকা কড়িই হোক বা আধ্যাত্মিক সম্পত্তিই হোক, সদা জাগ্রত অবস্থায় রক্ষা করতে হয় সেগুলো।
রাতে সবাই যখন ঘুমায় তখন পেঁচা সারারাত জেগে সেই ধন সম্পদ পাহারা দেয়, আর সেই কারণেই মা লক্ষ্মীর বাহন হলো পেঁচা।
মা লক্ষ্মীর গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য সম্পর্কে জানা যাক :
বিশেষ করে মা লক্ষ্মীর চারটে হাত, সেই চারটে হাতের ক্ষেত্রে ধর্ম, কর্ম, অর্থ ও মোক্ষ, হিন্দু শাস্ত্রে এই চার হাতের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবে। যারা মনে করেন মা লক্ষ্মী শুধুমাত্র ধন-সম্পত্তির দেবী তারা সম্ভবত দেবীর এই ব্যাখা সম্পর্কে অতটা জানেন না।
সমুদ্র মন্থন থেকে মা লক্ষ্মীর উদ্ভব হয়েছিল, কিন্তু সবার আগে জানা প্রয়োজন তিনি আসলে কে ? কিভাবে আবির্ভূত হলেন তিনি ? এই নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছেই, কখনো বলা হয় তিনি হলেন ঋষি ভ্রিগুর সন্তান এবং সমুদ্র মন্থনে তার পুনরজন্ম হয়।
আবার অন্যদিকে জানা যায় যে, তিনি সমুদ্র দেব বরুনের কন্যা। মা লক্ষ্মীর আগে আবির্ভূত হয়েছিলেন দেবী সরস্বতী। একটি পৌরাণিক গল্প বলা হয়েছে ব্রহ্মার সাত সন্তান, সপ্ত ঋষির মধ্যে ছয় জনই দেবী সরস্বতীর আরাধনা করে দৈব জ্ঞান লাভ করেছিলেন।
তবে যাই হোক না কেন, প্রতিটি ঘরে ঘরে নিয়ম মেনে যদি লক্ষী দেবীর আরাধনা করা যায়, তাহলে সংসারে সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি, ধন-সম্পদ বৃদ্ধি ও আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধি বিপুল পরিমাণে হতে থাকবে। মা লক্ষ্মী একবার যার উপর সন্তুষ্ট হবেন সেই ব্যক্তি ধন সম্পদ এবং আরো অন্যান্য ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ হতে থাকবেন। সংসারে থাকবে না কোন অভাব, সদা সর্বদাই শান্তি বজায় থাকবে ঘরে ঘরে।
দেবী লক্ষ্মী খুবই অল্পতেই সন্তুষ্ট হন, কিন্তু তিনি বড়ই চঞ্চলা, তাকে ধরে রাখতে গেলে নম্রতার সাথে ধরে রাখতে হবে। কোনরকম চেঁচামেচি, ঝগড়া, ঝামেলা, মা লক্ষ্মী পছন্দ করেন না। তাই সেই কারণে সংসারে সুখ, শান্তি বজায় রাখতে এবং ঘরেতেই লক্ষ্মীকে বেঁধে রাখার জন্য আপনাকে খুবই নমনীয় হতে হবে, আর সমস্ত নিয়ম মেনে মা লক্ষ্মী ব্রত পালন করতে হবে।