(Ujaani Shakti Peeth in Bengali) উজ্জনি শক্তিপীঠের বর্তমান অবস্থান কোন স্থানে? দেবী সতীর কোন অঙ্গ এখানে পতিত হয়েছে? উজ্জনি শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী কি? কিভাবে আরাধনা করা হয়? এই মন্দিরের তাৎপর্য কি? জানুন সবকিছু বিস্তারিত।
হিন্দু ধর্মাবলম্বী দের কাছে তীর্থস্থান কতখানি পবিত্র জায়গা তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। জীবনের কিছুটা সময় তীর্থযাত্রা এবং সেখানে কিছু সময় কাটানো অনেকেরই ইচ্ছা থাকে। এমনই সব তীর্থস্থান গুলির মধ্যে অন্যতম হলো মঙ্গলচন্ডী মন্দির অথবা উজ্জনি শক্তিপীঠ।
উজ্জনি শক্তিপীঠ:
শক্তিপীঠের নাম | উজ্জনি শক্তিপীঠ |
স্থান | মঙ্গলচণ্ডী মন্দির, উজ্জনি, গুস্করা স্টেশন হতে ১৬ কি.মি., বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ |
দেশ | ভারত |
দেবীর অংশ | ডান কব্জি |
শক্তির নাম | মঙ্গলচণ্ডীকা |
মঙ্গলচন্ডী মন্দির বা উজ্জনি শক্তিপীঠের ভৌগলিক গুরুত্ব:
এটি দেবীর ডান কব্জি পতিত হয়ে তৈরি হয়েছিল। মঙ্গলচন্ডী মন্দির বা উজ্জনি শক্তিপীঠ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার উজ্জনি গ্রামে অবস্থিত।
গুসকরা রেলওয়ে স্টেশন থেকে এই শক্তিপীঠ ১৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আর এটি এখানকার খুবই বিখ্যাত একটি মন্দির, যেখানে প্রতিনিয়ত দর্শনার্থীদের আনাগোনা লেগেই রয়েছে।
মঙ্গলচন্ডী মন্দির বা উজ্জনি শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী:
পিতা দক্ষ রাজার অমতে গিয়ে সতী দেবাদিদেব মহাদেব কে বিবাহ করেছিলেন, তবে এই বিবাহ দক্ষ রাজা মেনে নিতে পারেন নি। সেই কারণে একদিন দক্ষ যজ্ঞের আয়োজন করলে, সেখানে সতীর সামনে তার স্বামী মহাদেবকে অনেক অপমান করেন পিতা দক্ষ রাজা।
স্বামীর এই অপমান সহ্য করতে না পেরে সতী নিজের বাপের বাড়িতেই প্রাণ ত্যাগ করেন। এই খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছাতেই তিনি উন্মাদে পরিণত হন। তারপর দেবীর কাছে পৌঁছে তার দেহ কাঁধে করে তুলে তাণ্ডব নৃত্য শুরু করলে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার উপক্রম দেখা দেয়।
যার ফলে বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে দেবীর দেহকে খন্ড-বিখন্ড করে দেন, আর সেই খন্ড বিখন্ড দেহ অংশ গুলির মধ্যে দেবী সতীর ডান কব্জি এই জায়গায় পতিত হয়েছিল, তারপর এটি মঙ্গলচন্ডী মন্দির, শক্তি পীঠে পরিণত হয়। এরপর থেকে এই স্থানটি পবিত্র হয়ে ওঠে এবং বাংলার একটি শক্তিপীঠ হিসেবে গণ্য হয়।
মন্দিরের গর্ভগৃহে দেবী মঙ্গলচন্ডীকা অথবা মঙ্গলচন্ডী রূপে বিরাজমান রয়েছেন শক্তি এবং এখানে ভৈরবের রূপ হলো কপিলাম্বর। প্রতিটি তীর্থস্থানে কিছু না কিছু নিয়ম থাকে, সেই অনুসারে এই মন্দিরের প্রবেশ করা এবং পরিদর্শন করার নিয়ম অনুসারে সকাল ৬ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত সময় সীমা দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার ও শনিবার কোন শক্তিপীঠ পরিদর্শন করার জন্য খুবই ভালো বলে মনে করা হয়।
আর এখানেও ঠিক একই নিয়ম রয়েছে। এই মন্দিরে অথবা এই শক্তি পীঠে শিবরাত্রি, নবরাত্রি, দুর্গা পূজা, কালী পূজা, দীপাবলি এগুলি খুবই ধুমধাম ভাবে খুবই বড় আকারে পালন করা হয়। যার ফলে এই পূজা গুলি উপলক্ষে দর্শনার্থীদের ভিড় উপচে পড়ে।
মঙ্গলচন্ডী মন্দির বা উজ্জনি শক্তি পীঠের ইতিহাস:
ইতিহাস অনুসারে জানা যায় যে, সতীর ডান হাতের কব্জি পড়েছিল এখানে। অন্নদামঙ্গল কাব্য অনুযায়ী এই জায়গা টির নাম উজ্জনি। অনেক গবেষকদের মত অনুসারে “উড্ডিয়ান মঙ্গলকোট” অনুযায়ী এখানে উজ্জনি সতীপীঠ অবস্থিত।
প্রচলিত কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, মা মঙ্গলচন্ডীর পূজা প্রচারের জন্য অভিশাপগ্রস্থ স্বর্গের অপ্সরা খুল্লনা রূপে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন। ধনপতি সওদাগর খুল্লনা কে বিয়ে করেন, কিন্তু শিব ভক্ত সওদাগর মঙ্গলচন্ডীর পূজা করতে কিছুতেই চাইতেন না।
দিন যায় কিন্তু কখনই মঙ্গলচন্ডীর পূজা করতে ধনপতি সওদাগর রাজি হন না। একবার বাণিজ্যে বের হওয়ার সময় তিনি মায়ের ঘটে লাথি মেরে বাণিজ্যে বের হয়ে যান। দেবীর রাগ এতটাই বেড়ে যায় যে, তিনি আর উজ্জনি নগরে ফিরেই আসেন নি।
খুল্লনা মঙ্গল চন্ডী কে পুজোয় সন্তুষ্ট করে তার স্বামীর ফিরে আসার জন্য প্রার্থনা করতে লাগলেন। অনেক বছর পর সওদাগর ফিরে আসেন, আর দেবীর মহিমা ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে, তার সাথে সেই থেকে মঙ্গলচন্ডীর পূজা হয়ে আসছে অজয় নদীর পাড়ে এই মন্দিরে।
মঙ্গলচন্ডী মন্দির:
এই মন্দিরের মূল মন্দিরটি তে প্রথমে একটি বারান্দা রয়েছে এবং তার ভিতরে আয়তক্ষেত্র মত গর্ভগৃহ রয়েছে। এই গর্ভগৃহের মধ্যেই মা মঙ্গলচন্ডীর ছোট কালো পাথরের দশভূজা মূর্তি রয়েছে, প্রাচীন মূর্তিটি ৯০ এর দশকে চুরি হয়ে গিয়েছে বলে জানা যায়।
১৯৯৪ সালে মল্লিক উপাধিধারী গ্রামের একজন ধনী পরিবার বর্তমানের কষ্টিপাথরের দশভূজা মূর্তিটি নির্মাণ করে দেন। আর সেই থেকেই এই কষ্টি পাথরের মূর্তিটির পূজা হয়ে আসছে ভক্তদের দ্বারা।
এরপর ২০০৬ সালে এই মন্দিরটি সরানো হয়েছে এবং বাড়ানো হয়েছে। মূল মন্দিরের সামনে একটি ছোট নাট মন্দির যুক্ত করা হয়েছে। প্রত্যেকটি সতীপীঠ অথবা শক্তি পীঠে দেবী এবং ভৈরব অধিষ্ঠিত থাকেন। দেবী হলেন সতীর রূপ, ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী।
শক্তি পীঠে দেবীর নাম মঙ্গলচন্ডী আর দেবীর ভৈরব উঁচু কালো রঙের পাথরের একটি শিবলিঙ্গ, যার নাম কপিলাম্বর। অনেকে আবার কপিলেশ্বর বলেও ডেকে থাকেন। শিবলিঙ্গের সামনে নন্দীর কালো পাথরের একটি ছোট্ট মূর্তি আছে। তবে শুধুমাত্র তাই নয়, ভৈরবের বাঁদিকে রয়েছে একটি বজ্র আসন, বুদ্ধমূর্তিও রয়েছে তার সাথে।
অনেক বিশেষজ্ঞদের মত অনুসারে এই মূর্তিটি পাল যুগের। কোগ্রামের অন্যতম বিখ্যাত উৎসব হচ্ছে উজ্জনির মেলা। মনসামঙ্গল কাব্য থেকে জানা যায় যে, উজ্জনি নগরের রাজা এবং তার প্রজাদের মকর সংক্রান্তির স্নানের জন্য কোনগ্রামে অজয় নদীর চর কে বেছে নেওয়া হয়েছিল।
আর এখানে দেবীর মঙ্গলচন্ডী, সর্বমঙ্গলা ও ভৈরব কপিলাম্বর বিরাজমান। দেবীর মন্দিরে জৈষ্ঠ মাসের প্রতি জয় মঙ্গলবার পুজো করা হয়। এছাড়াও সারা বছর ধরে এখানে দুর্গাপূজা, কালীপূজা, সবই চলতে থাকে, তবে কোনো রকম আলাদা মূর্তি হয় না। দেবীর এই মূর্তিতেই সবরকম পূজা করা হয়।
মঙ্গলচন্ডী মন্দিরের মাহাত্ম্য:
এই মন্দিরের মাহাত্ম্য অনেকখানি, বিশেষ করে স্থানীয় মানুষদের কাছে এই মন্দির অনেক খানি পবিত্র ও জাগ্রত। সারা বছর দেবীর অন্ন ভোগ, ডাল, পায়েস, ভাজা, মাছ, ইত্যাদি সহকারে ভোগ নিবেদন করা হয়। তবে আগে দেবীর বিগ্রহ ছিল অষ্টধাতু দিয়ে নির্মিত। তবে সেটা চুরি হয়ে যায় বলে জানা যায়। তারপরে কিছুদিনের জন্য দেবীর ছবিতে মায়ের পূজা পাট চলত।
এখানে দুর্গা পূজার সময় দেবীকে নিরামিষ ভোগ নিবেদন করা হয়। বর্তমানে রায় পদবীর ব্রাহ্মণরা এই মন্দিরের সেবায় নিযুক্ত রয়েছেন। মন্দিরেই রয়েছে মায়ের ব্রহ্ম শিলা, দেবীর ভৈরব কপিলাম্বর দেবীর পাশেই বিরাজমান রয়েছেন। দেবী এখানে সিংহবাহিনী, কথিত আছে যে, এখানে দেবীর কাছে ভক্তি ভরে প্রার্থনা করলে তা কখনোই বৃথা যায় না।
মন্দিরের সৌন্দর্য:
মন্দিরের পাশেই রয়েছে নাটমন্দির, বাগান, ইত্যাদি যা কিনা সুন্দর করে নতুন করে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। যা মন্দিরকে অনেকখানি সুন্দর দেখাতে সাহায্য করে, গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে নদীর ধারে মন্দির হওয়ার জন্য পরিবেশ এখানে খুবই শান্ত, নিরিবিলি এবং আধ্যাত্বিক মন্ডিত।
গ্রামের জনবসতি খুব একটা বেশি নয়, দিনের শেষে যখন সন্ধ্যা হয়ে আসে তখন অজয় নদীর বাঁকে অন্ধকার নামে। দেবীর এই রাত্রিকালীন ভোগ, আরতি আর বেজে ওঠে অসংখ্যক কাঁসর, শাঁখ, ঘন্টা যার আওয়াজে মুখরিত হয়ে যায় চারিদিক আর অজয় নদীর দুই তীর। এখানে মা মঙ্গল চন্ডী সর্বমঙ্গলা রূপে প্রতিনিয়ত তার সন্তান ভক্তদের রক্ষা করে চলেছেন।
আপনিও চাইলে কিন্তু আসতে পারেন মায়ের এই পিঠস্থানে, যেখানে চারিদিকে নিস্তব্ধতা ও পূজার গন্ধ আর শাঁখ, ঘন্টার আওয়াজ এ আপনার মন ও শরীর অনেকখানি বিকশিত হবে সেটা বলাই যায়। জীবনের অনেক দুঃখ কষ্ট আপনি ভুলে যেতে পারবেন, দেবীর এই পীঠ স্থান দর্শন করার মধ্যে দিয়ে।