“রজনীগন্ধা” ফুলকে রাতের রানী বলা হয়। কারণ এ ফুল সন্ধ্যা-রাতে ফুটে আর মিষ্টি সুবাস ছড়ায়। এ ফুলের মোহনীয় গন্ধ তনু-মনে প্রশান্তি এনে দেয়। এর সাদা রঙ ও গন্ধে বাগান হয়ে সমৃদ্ধশালী।
এই ফুল সৌন্দর্যের কারনে আমাদের পুঁজো-পার্বনে মানে সামাজিক ও ধর্মীয়, গৃহসজ্জা, বিয়ে-স্বাদী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যাপক হারে ব্যবহার হয়ে থাকে। যার ফলে বানিজ্যিক ভাবে এর চাষ শুরু হয়েছে বহুদিন আগ থেকে।
আজ আমরা আপনাদের সাথে রজনীগন্ধা চাষের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব। এতে করে আপনারা সহজেই রজনীগন্ধা চাষের বিস্তারিত জানতে পারবেন।
আমাদের বাংলাভূমি সাইটে নিয়মিত আমরা আপনাদের সাথে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করে থাকি। যার ফলে আপনার কৃষি জমি, শিক্ষা, অর্থনীতি ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে থাকেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রয়োজনে আপনারা এ সকল তথ্য থেকে উপকৃত হয়ে থাকেন।
রজনীগন্ধার ইংরেজী নাম tuberose এবং বৈজ্ঞানিক নাম polianthes tuberosa
যদিও আমরা ভাবি এটা আমাদের দেশীয় ফুল, কিন্তু না! আসলে এটি ভারতীয় উপমহাদেশে আসে পূর্তগীজদের আসার পর। এর আদি বাসস্থান মেক্সিকোতে হলেও বর্তমানে অনেক দেশেই জন্মে।
ফুলদানিতে এ ফুল ৭/১০ দিন পর্যন্ত সতেজ থাকে। সন্ধারাতে ফোঁটে এবং সারা-রাত গন্ধ ছড়ায় বলেই এর নাম “রজনীগন্ধা”। সুন্দর গন্ধের কারনে এ ফুলের নির্যাস থেকে সুগন্ধি দ্রব্য-সামগ্রী তৈরি করা হয়।
জাত ও শ্রেনীঃ
সাধারনত ৩ ধরনের জাত আমাদের দেশে দেখা যায় সিঙ্গেল, সেমি ডাবল, ডাবল। তার মধ্যে সিঙ্গেল জাতে রয়েছে পার্ল, বম্বে, ক্যালকাটা ও সিঙ্গেল ম্যাক্সিকান। আর ডাবল জাতে রয়েছে ডাবল পার্ল ও প্রজ্জল।
আমাদের দেশের কৃষকরা প্রজ্জল,সেমি ডাবল ও ডাবল জাতের রজনীগন্ধা চাষ করে থাকেন।এর মধ্যে সিঙ্গেল জাতের ফুল গুলোতে পাঁপড়ি এক সারিতে হয় এবং দেখতে সাদা ও খুব সুগন্ধ-যুক্ত হয়।
প্রজ্জল, সেমি-ডাবল, ডাবল জাত গুলোতে দুই বা তার বেশি পাঁপড়ি দেখা যায় এবং দেখতে হালকা লালচে ধরনের হয় এবং কম-সুগন্ধ যুক্ত হয়।
জলবায়ু ও মাটিঃ
রজনিগন্ধা আর্দ্র ও উষ্ণ জলবায়ুতে বেশ ভাল জন্মে। জৈবসার সমৃদ্ধ উর্বর দোআঁশ বা এঁটেল মাটিতে এর ফলন ভাল হয়।
তবে ভালো ফলনের জন্য ২০-৩০০ সেন্টিগ্রেট আর্দ্র আওবহাওয়ার প্রয়োজন হয়। জল সুনিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হয়। জেনে রাখা ভালো এ ফুল চাষে প্রচুর জল এবং সারের প্রয়োজন হয়।
জমি তৈরি ও সার প্রয়োগঃ
সব কমপোষ্ট সার একসাথে মিশিয়ে তারপর এতে ২০০ কেজি সালফেট, ২৫০ কেজি ফসফেট, ২০০ কেজি এমপিও সার ভালোভাবে মিশিয়ে বাল্ব বা কন্দ রোপন করতে হবে।
বাল্ব রোপন করার সময় এক সারি থেকে অন্য সারির দূরত্ব হবে ২০-২৫ সেমি. এবং এক কন্দ থেকে অন্য কন্দের দূরত্ব হবে ১৫-২০ সেমি.। কন্দটি রোপন করতে হবে ৩-৪ ইঞ্চি মাটির গভীরে।
এ গাছে ১ সপ্তাহ অন্তর অন্তর জল সেচ দিতে হয়। যদি প্রয়োজন অনুযায়ী জল সেচ দেয়া যায়, তবে ফলন ভালো হবে। গাছ বেড়ে উঠার সাথে সাথে জমি নিড়ীয়ে পরিষ্কার রাখতে হবে। তা-না হলে ভালো সংখ্যায় স্টীক এবং ফুল পাওয়া যাবে না।
রজনীগন্ধার কন্দ সাধারনত জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারিতে রোপন করা হয়। রোপনের ৩ মাস পর থেকে গাছে ফুল আসা শুরু করবে , তখন গাছের জল সেচ ব্যবস্থা এবং সার প্রয়োগ যথাযথ ভাবে না হলে ফলন ভালো হবে না।
অর্ন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা
এখানে কৃষককে খেয়াল রাখতে হবে রজনীগন্ধার ভালো ফুল পেতে হলে অবশ্যই ১ মাস অন্তর অন্তর ক্ষেতে ১০:২৬:২৬ সার ১০ কেজি ও সর্শের খোল ১০ কেজি প্রয়োগ করতে হবে।
এছাড়া পলি মালচিং পদ্ধতির মাধ্যমেও আজকাল এই ফুল চাষ হয়।পলি মালচিং পদ্ধতিতে জমির অতিরিক্ত ঘাস নিধন করা যায়।আর সারও তুলনামূলক ভাবে কম লাগে।
এ পদ্ধতিতে খরচ ১০ হাজার টাকা বেড়ে গেলেও আয় বেড়ে যাবে ৩০-৫০ হাজার টাকা বিঘা-প্রতি। রজনীগন্ধা চাষে আরেকটি দিক খেয়াল রাখতে হবে, সেটা হল যখন কন্দ রোপন করা হয় তখন ৩ ভাগে ১৫ দিন অন্তর অন্তর কন্দ বপন করলে সারা বছর ফুল পাওয়া যায়।
রোগবালাই ও দমন
রজনীগন্ধায় ব্রোটাইটিস নামক রোগ যা বর্ষা কালে দেখা যায়, এতে পাতায় ও ফুলে দাগ্ পড়ে, পাতা গাঢ় বাদামী বর্নের হয়ে যায় এবং পরে পুষ্পমঞ্জুরী শুকিয়ে যায়।
এই রোগ দমনে রোভারল (ম্যানকোজেব) .২% হারে ৭/১০ দিন অন্তর অন্তর স্প্রে করতে হবে। আরেকটি রোগ হচ্ছে গাছের গোড়ায় পানি জমে গাছে পচন ধরা। এক্ষেত্রে পচে যাওয়া গাছটি উঠিয়ে ফেলে দিতে হবে।
ফুল কাটা ও প্রক্রিয়াজাত-করণঃ
রজনীগন্ধার ক্ষেতে পর পর ৩ বার একই ফসল করা যায়, এর বেশি নয়। অনেক কৃষক ভালো ফুল আসার জন্য ২ বারের বেশি চাষ করেন না।
ফুল কাটার সময় খেয়াল রাখতে হবে ভোরের আলোয় অথবা পড়ন্ত বিকেলের আলোয় ফুল কাটতে হবে এবং গাছ থেকে ৩-৪ ইঞ্চি উপরে ডাঁটা কাটতে হবে যেন গাছের নতুন কুঁড়ির যেন কন ক্ষতি না হয়।
তারপর স্পাইক গুলোকে চিনিযুক্ত পানিতে ২ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে ,ছিদ্রযুক্ত পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে বাজারযাত করতে হবে। এতে করে স্টীক গুলো অনেক্ষন সতেজ থাকবে এবং দূরবর্তী স্থানে নেয়া যাবে।
এ গাছ থেকে যেমন স্টীক পাওয়া যায় আবার ঝুরো ফুলও সারা বছর বিক্রি করে প্রচুর আয় করা সম্ভব। লাভজনক ফলন হিসেবে রজনীগন্ধা একটি প্রথম সারির বানিজ্যিক ফসল, বৈদেশিক বানিজ্যেও এর অপার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাল্ব বা কন্দ সংরক্ষনঃ
ডিসেম্বর জানুয়ারী মাসে যখন গাছে ফুল শেষ হয়ে আসে ,তখন কন্দ তুলে, মাটি ঝেড়ে ফেলে তারপর ছায়া-যুক্ত স্থানে শুকিয়ে বীজের উপযোগী কন্দ বাছাই করে পরবর্তী বছরে লাগানোর জন্য সংরক্ষন করা যেতে পারে।
আজ আমরা রজনীগন্ধা চাষ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলাম। আগামীতে আপনাদের সাথে রজনীগন্ধা চাষ নিয়ে আরো কিছু আলোচনা করবো, তাই আমাদের পেজে নিয়মিত চোখ রাখুন। এই লেখাটি অনেকের কাজে লাগতে পারে তাই লেখাটি যতটুকু সম্ভব শেয়ার করুন, যাতে করে অনেকে এই লেখা থেকে শিক্ষা নিয়ে রজনীগন্ধা চাষ করে আয় করার ব্যবস্থা করতে পারে।