ত্রিম্বকেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির (Trimbakeshwar Jyotirlinga Temple): আমরা সকলেই জানি যে, পবিত্র শ্রাবণ মাস ভর মহাদেবের উপাসনা করা হয়। মহাদেবের আশীর্বাদ পেতে শিব ভক্তরা নিয়ম করে ভোলেনাথের পূজা করে থাকেন এই মাসে। তাছাড়া সারা বছর বিভিন্ন রকম অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে শিবের উপাসনা করা হয় বৈকি, কিন্তু এই শ্রাবণ মাসটা শুধুমাত্র শিবের উপাসনার জন্য উপযুক্ত, জয় বাবা ভোলেনাথ।
ত্রিমবাকেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ নাসিক এর কাছে গোদাবরী নদীর তীরে অবস্থিত। এই মন্দিরের কালসর্প দোষ নিবারণের জন্য মানুষ সব সময়ের জন্য পূজা-অর্চনা করে থাকেন। মন্দিরের অভ্যন্তরে তিনটি ছোট্ট ছোট্ট শিবলিঙ্গ রয়েছে যা কিনা ত্রিদেব অর্থাৎ ব্রহ্মা-বিষ্ণু এবং মহেশ্বর এর প্রতিক হিসেবে বিবেচিত করা হয়। এই লিঙ্গের চারপাশে একটি রত্ন খচিত মুকুট স্থাপন করা আছে, শুধুমাত্র সোমবার যে বিশেষ সময়ে ভক্তরাই শুধুমাত্র এই মুকুট দেখার সুযোগ পান।
ত্রিম্বকেশ্বর মন্দিরের কাছে তিনটি ব্রম্ভ গিরি, গঙ্গাধার, নীলগিরি পর্বত রয়েছে। ব্রহ্মগিরিকে শিবের একটি রূপ বলে মনে করা হয়। নীলগিরি পর্বতে লীলাম্ভিকা দেবী ও দত্তাত্রেও গুরুর মন্দির রয়েছে।
ত্রিম্বকেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরের ইতিহাস:
দেবী অহল্যার স্বামী ঋষি গৌতম প্রাচীনকালের ব্রম্ভ গিরি পর্বতে তপস্যা করতে এখানে উপস্থিত হন। আর সব অন্যান্যরা গৌতম ঋষির উপরে হিংসা করতেন। একবার সমস্ত ঋষি রা প্রতারণার মাধ্যমে গৌতম ঋষিকে গো হত্যার জন্য অভিযুক্ত করেছিলেন।
এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে গেলে গঙ্গা দেবীকে এখানে আনতে হবে। পাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য গৌতম ঋষি শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ভক্তি সহকারে প্রতিদিন পূজা করতে থাকেন। দেবী পার্বতী ও ভগবান শংকর অত্যন্ত খুশি হয়ে তাকে প্রত্যক্ষ দর্শন দিয়ে দেন। ভগবান শিব গৌতম ঋষিকে বর চাইতে বললেন।
সেই বর অনুসারে গৌতম ঋষি এখানে গঙ্গা মাতাকে আনার জন্য বললেন। দেবী গঙ্গা বললেন মহাদেব যদি এখানে থাকেন তবেই তিনি এখানে আসবেন। দেবী গঙ্গার ইচ্ছা গ্রহণ করে শিব ত্রিম্বকেশ্বর জ্যোতিরলিঙ্গ রূপে সেখানে উপবিষ্ট হন। দেবী গঙ্গা গৌতমী রূপে সেখানে প্রবাহিত হতে থাকে যা কিনা গোদাবরী নামেও সকলেই চেনেন।
এই মন্দিরের বৈশিষ্ট্য:
এখানে অবস্থিত জ্যোতির্লিঙ্গের অসাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো ভগবান বিষ্ণু, ব্রহ্মা এবং মহেশ্বর এর রূপে তিনটি মুখ আছে। অতিরিক্ত জলের ব্যবহারের কারণে লিঙ্গটি ক্ষয় হতে শুরু করেছে। বলা হয় যে এই ক্ষয় মানব সমাজের ক্ষয় হওয়ার প্রকৃতির প্রতীক।
লিঙ্গ গুলি একটি রত্ন মুকুট দ্বারা কভার করা / ঢাকা থাকে। এই মুকুটটি পান্ডবদের যুগে ছিল এবং এটি হিরা, পান্না এবং অনেক মূল্যবান পাথর দ্বারা গঠিত। তাছাড়া এই মুকুটটি প্রতি সোমবার বিকেল চারটে পঞ্চাশ মিনিটে দর্শনার্থীদের দেখানো হয়।
অন্যান্য সমস্ত জ্যোতিরলিঙ্গ গুলিতে শিবের প্রধান দেবতা হিসেবে রয়েছে। সম্পূর্ণ কালো পাথর মন্দিরটিকে আরো বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে। কাহিনী অনুসারে মহাদেব তার মাথায় জটার মধ্যে গঙ্গাকে ধরে রেখেছিলেন প্রবাহিত করার জন্য। চব্বিশ বছরের দুর্ভিক্ষ হয়েছিল এবং লোকেরা ক্ষুধার্ত অবস্থায় যন্ত্রণায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। তবে বৃষ্টির ঈশ্বর বরুণ এর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে প্রতিদিন গৌতমের আশ্রমে বৃষ্টিপাতের ব্যবস্থা করেছিলেন যা ছিল ত্রিম্বকেশ্বর।
আরেকটি কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, পরবর্তীতে গঙ্গা ত্রিম্বকেশ্বরে হাজির হয়েছিলেন। গৌতম তার প্রশংসা করেছিলেন কিন্তু তিনি বাইরে গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় পাহাড়ে হাজির হয়েছিলেন এবং অদৃশ্য হয়ে গেলেন। গৌতম তার জলে স্নান করতে পারেননি। গঙ্গাটি তখন গঙ্গাধারে বরাহ তীর্থ, রাম লক্ষণ তীর্থ, গঙ্গাসাগর তীর্থে হাজির হয়েছে। তবুও গৌতম তার জলে স্নান করতে পারেনি।
গৌতম মন্ত্রমুগ্ধ ঘাসের সাহায্যে নদীটিকে ঘিরে ফেলেছিলেন। প্রবাহ সেখানেই থেমে যায়, এবং তীর্থকে এভাবে বলা শুরু হয়। এই কোষ বর্ষ থেকে গোদাবরী নদীর সমুদ্র পর্যন্ত প্রবাহিত হয়। গৌতম দ্বারা একটি গরু হত্যার পাপ এখানে মুছে ফেলা হয়েছিল।
তাছাড়া এই জায়গাটি বহু ধর্মাবলম্বীদের জন্য বিখ্যাত নারায়ণ নাগ বলি, কলসর্প শান্তি, ত্রিপিণ্ডে বিধি এখানে করা হয়, যা কিনা শুধুমাত্র ত্রিম্বকেশ্বরেই হয়ে থাকে। এই পূজা তিন দিনের মধ্যে করা হয়। এই পূজা বিশেষ তারিখে করা হয়। কিছুদিন এই পূজা করার জন্য উপযুক্ত নয়।
কোন অসুস্থতা নিরাময়ের মত, খারাপ সময় কাটানো, কোন কোবরা নাগ হত্যা, নিঃসন্তান দম্পতি, আর্থিক সংকট বা আপনি কিছু পাওয়ার জন্য কিছু ধর্মীয় পূজা করতে চান, যেমন অনেক কারণে এই পূজা করা হয়। সেটা আপনি আপনার মনের ইচ্ছা পূরণ করার জন্য এখানে নিষ্ঠা ভরে পূজা করতে পারেন।
ত্রিম্বকেশ্বর শহরে অনেক ব্রাহ্মণ পরিবার রয়েছে, এবং বৈদিক গুরুকুলদের কেন্দ্রও এটি। এখানে আশ্রম ও মঠ রয়েছে। হিন্দু জীবন যাপন সুন্দর ভাবে করার জন্য এই জায়গাটি উপযুক্ত।
মন্দিরে চারিপাশে জায়গাটি বর্ষার মৌসুমে মনোরম সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত এবং দূষণের কারণে নিবিড় সবুজ পাহাড় দ্বারা ঘিরে রয়েছে। যেখানে দূষণের ছিটে ফোটাও নেই। হনুমানের জন্মস্থান অঞ্জনি পর্বত এখন থেকে কিছু দূরে অবস্থিত।
এছাড়াও মন্দিরটি নীল পর্বতের চূড়ায় অবস্থিত। সমস্ত দেবদেবী পরশুরামকে দেখতে এসেছিলেন যখন তিনি তপস্যায় মগ্ন ছিলেন। তার তপস্যা হওয়ার পর তিনি সমস্ত দেব-দেবীদের সেখানে থাকার অনুরোধ করেছিলেন এবং এই দেবদেবীদের জন্য মন্দিরটি তৈরি করা হয়েছিল বলে মনে করা হয়।
অন্যান্য জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরের মতো এই জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরে ও মহা শিবরাত্রি উপলক্ষে খুবই জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে পূজার আয়োজন করা হয়। এখানকার স্থানীয় মানুষজন সবসময় তাদের মঙ্গল কামনার জন্য এখানে পূজা দিয়ে থাকেন। এছাড়াও বহু দূর দূরান্তর থেকে অনেক ভক্তরা, শিবের উপাসকরা এবং পর্যটকরা এখানে আসেন এই জায়গাটি ভালো করে ঘুরে দেখার জন্য।
যেহেতু শ্রাবণ মাস শিবের উপাসনার মাস, সেহেতু এই শ্রাবণ মাসে মুষলধারায় বৃষ্টিও ঝরে। আর আগেই বলা হয়েছে যে এই মন্দিরের পরিবেশ বৃষ্টির মৌসুমে আরও বেশি সুন্দর হয়ে ওঠে। তাই এই সময়ে ভক্তদের ভিড় লেগেই থাকে মন্দিরে।