মোদী সরকারের স্মার্ট সিটিজ মিশন (Smart Cities Mission in Bangla): আমাদের দেশের শহরগুলিতে, জমি, অবকাঠামো, পরিবেশের উপর জনসংখ্যার চাপ ব্যাপক এবং শহরের নাগরিকগণ পরিষ্কার বাতাস, গতিশীলতা, স্যানিটেশন, জল, জননিরাপত্তা ইত্যাদির অভাবের মতো সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে সুতরাং এই সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য টেকসই সমাধান কার্যকর করার প্রয়োজন।
আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে স্মার্ট সিটি কি, এর সুবিধা, উদ্দেশ্য ও অর্থায়ন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা। স্মার্ট সিটিজ মিশন সম্পর্কে জেনে নিন বিস্তারিত:
স্মার্ট সিটিজ মিশন কী?
স্মার্ট সিটি বলতে এমন একটি শহরকে বোঝায় যেখানে স্থাপনা, স্থাপত্য, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবকাঠামোতে উল্লেখযোগ্য এবং ব্যাপক উন্নতি ঘটে।
স্মার্ট সিটি মানে এমন শহর যেখানে নাগরিকরা অবকাঠামো, জল, বিদ্যুৎ, কল-কারখানা, শপিংমল, স্কুল, কলেজ, রাস্তাঘাট, রোড-লাইট, পয়-নিস্কাশন,উন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বিনোদনের জন্য পার্ক, হোটেল, ক্যাফে, রেস্তোরা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ক্লিনিক, গার্মেন্টস, কাচাবাজার, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, সেবা প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি, ব্যাংক-বীমা, টেলিভিশন চ্যানেল, ওয়াইফাই, দ্রুতগতির ইন্টারনেট, অপটিক্যাল ফাইবার লাইন, ইত্যাদি সকল কিছু দ্বারা সুবিধাপ্রাপ্ত হতে পারবেন।
হাতের কাছেই সকল ধরনের নাগরিক সুবিধা স্মার্ট সিটিতে পাওয়া যাবে। শুধু সুবিধাই নয় সেতু, ফ্লাইওভার, ব্রিজ, নান্দনিক স্থাপত্য যা শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করবে তাও থাকবে স্মার্ট সিটিগুলোতে।
স্মার্ট সিটির উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা কি?
একটি দেশে প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়ন আনতে স্মার্ট শহরগুলির প্রয়োজন। নগরীর মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য স্মার্ট শহরগুলির প্রয়োজন।
কারণ শহরের অবকাঠামোতে প্রতিটি নাগরিকের সকল ধরনের সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন, যেহেতু এখানে গ্রামের মত সবারই কোন না কোন কৃষিপণ্য উৎপাদন, গবাদিপশু, পুকুর,কুয়া,কুটিরশিল্প ইত্যাদির ব্যবস্থা নেই।
যদি শহরে জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয় তবে স্বাভাবিকভাবেই শহরটি আরও বেশি লোককে আকৃষ্ট করবে এবং এর ফলে আরও বিনিয়োগ হবে। যা শহরটিকে আরও উন্নত এবং বসবাসের জন্য আরামদায়ক করে তুলবে।
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে বিনিয়োগ বাড়লে অনেক লোকের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে, বাইরের দেশের উদ্যোক্তারা এদেশে বিনিয়োগ করবে, দেশীয় কর্মশক্তি উন্নত কাজে প্রশিক্ষিত হতে পারবে। এর ফলে দেশের অর্থনীতি ও মানবসম্পদ দুইই সমৃদ্ধ হবে।
স্মার্ট সিটিস মিশন –
ভারত সরকার ২০১৫ সালে 100 টি স্মার্ট সিটি মিশন চালু করেছিল।
এই মিশনের উদ্দেশ্য ছিল নগর কার্যগুলি সুসংহত করা, দুর্লভ রিসোর্সগুলোকে আরও দক্ষতার সাথে ব্যবহার করা এবং নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা। নাগরিকদের নাগরিক স্যবিধা, কর্মসংস্থানের সাথে সাথে পৌর সেবার মান ও কার্যকারিতা আরও উন্নত করা।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) এর ব্যবহার এই স্মার্ট শহরগুলোর জীবনযাত্রার মান, কর্মক্ষমতা এবং টেকসই উন্নয়ন বৃদ্ধির মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করবে। নগর উন্নয়ন মন্ত্রণালয় স্মার্ট সিটির জন্য যে ২৪ টি মূল ক্ষেত্র বা এরিয়া চিহ্নিত করেছে সেখানেই স্মার্ট শহরগুলি গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে।
এই ২৪ টি মূল ক্ষেত্রের বা এরিয়ার মধ্যে তিনটি সরাসরি জলের সাথে সম্পর্কিত এবং সাতটি পরোক্ষভাবে জলের সাথে সম্পর্কিত – স্মার্ট মিটার পরিচালনা, পানির লিকেজ সনাক্তকরণ, প্রতিরোধমূলক রক্ষণাবেক্ষণ ও কার্যকর ব্যবস্থাগ্রহণ, এবং জলের মানের মডেলিং বা জলের মান উন্নত করাই হবে এই এরিয়াগুলি নির্বাচনের মূল উদ্দেশ্য।
স্মার্ট সিটিগুলোতে নাগরিকরা যেন বিশুদ্ধ জল পান সেটা নিশ্চিত করাই এই পদক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য। স্মার্ট সিটিস মিশন এমন একটি প্রক্রিয়া যা দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান এবং অন্যান্য প্রাথমিক পরিষেবাদির মতো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ দেশব্যাপী (এসডিজি) অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নে সহায়তা করবে।
পৌরসভাগুলি তাদের সমন্বিত কমান্ড এবং নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রগুলি (আইসিসিসি) স্মার্ট সিটিস মিশনের অধীনে কোভিড -১৯ প্রতিক্রিয়ার যুদ্ধ কক্ষ হিসাবে ব্যবহার করেছিল। মিশনের অধীনে গঠিত আইসিসিসিগুলি ট্র্যাফিক পরিচালনা, নজরদারি, উপযোগিতা এবং অভিযোগ নিরসনের সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে।
স্মার্ট সিটিস মিশনের 100 টি পৌরসভার মধ্যে 45 টি শহরের আইসিসিসি অনলাইনে কর্মকান্ড পরিচালনায় সক্ষম। কোভিড -১৯ যুদ্ধ কক্ষ হিসাবে, আইসিসিসিগুলি কোভিড-১৯ মোকাবেলায় উদ্যোগসমূহ বাস্তবায়ন করে যেমন:
১. পাবলিক প্লেসের সিসিটিভি নজরদারি।
কোভিড-পজিটিভ ক্ষেত্রে জিআইএস ম্যাপিং।
২. স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের জিপিএস ট্র্যাকিং
(শহরের বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে ভাইরাস সংক্রমণের জন্য ভবিষ্যদ্বাণীমূলক বিশ্লেষণ)
৩. চিকিৎসক এবং পেশাদার স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের ভার্চুয়াল প্রশিক্ষণ।
৪. অ্যাম্বুলেন্স এবং পরিবহন পরিষেবাগুলির রিয়েল-টাইম ট্র্যাকিং ও চেকিং
৫. ভিডিও কনফারেন্সিং, টেলিকাউনসিলিং এবং টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসা পরিষেবা সরবরাহ।
স্মার্ট সিটিস মিশন – পরিকল্পনা
স্মার্ট সিটির কোনও সার্বজনীন সংজ্ঞা না থাকায় প্রাথমিকভাবে স্পষ্টতার অভাব ছিল।
পূর্ববর্তী নগর উন্নয়ন মিশনের অভিজ্ঞতা থেকে ভারত সরকার কোনও নির্দিষ্ট মডেল সংজ্ঞা প্রদানে বিরত ছিল, কারণ পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা থেকে তারা বুঝেছিলেন যে সব শহরের ডিজাইন এক রকম হবে না, এর সুবিধা ও অবকাঠামোও একরকম হবেনা, শহরগুলোর মধ্যে মডেলের পার্থক্য থাকবে।
এর আগে প্রতিটি শহরকে তার অবকাঠামোগত সুবিধা,ঐতিহ্যগত দৃষ্টিকোণ, মিশনের সাথে সঙ্গতি রেখে পরিকল্পনা তৈরি করতে হয়েছিল যা এর স্থানীয় প্রেক্ষাপট, সংস্থানসমূহ, সম্পদ, সুবিধা, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং অন্যান্য উচ্চমাত্রার সুবিধা বাস্তবায়নের জন্য কতটা সুবিধাজনক তার সাথে সম্পর্কিত ছিল।
কারণ দেশের সব স্থানের ভোগৌলিক অবস্থা, যাতায়াত ব্যবস্থা, বিভিন্ন শক্তি সম্পদের প্রাচুর্য এবং অন্যান্য অবস্থা সমান নয়, তাই সব স্মার্ট সিটিতেই সব সুবিধা রাখা সম্ভবপর নাও হতে পারে।
স্মার্ট সিটি মিশন – অর্থ / অর্থায়ন
মোট মিশন তহবিল ২.০৫ লক্ষ কোটি টাকা। মিশনের মোট তহবিলের 45% আসে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার থেকে।
21% তহবিল কনভার্ভেশন এবং পিপিপি থেকে আসবে (প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপ থেকে)।
ডিবেট এবং লোন থেকে তহবিলের 5% সংগহ করা হবে, সরকারের নিজস্ব তহবিলের মাধ্যমে 1% এবং অন্যদের কাছ থেকে 7% সংগ্রহ করে স্মার্ট সিটিস বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে।
স্মার্ট সিটি মিশন – তহবিল বিতরণ
স্মার্ট সিটিজ মিশনে বিভিন্ন ক্ষেত্রের উন্নয়নে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে – ৪২,০০০ কোটি টাকা। নগর উন্নয়নের গতিশীলতা বৃদ্ধিতে – 34,000 কোটি টাকা।
জল সরবরাহ, বর্জ্য জল / নর্দমা ব্যবস্থা, ঝড়ের জল ড্রেনেজ সুবিধার জন্য – 30,000 কোটি টাকা।
স্মার্ট সিটিস মিশন – বাস্তবায়ন প্রতিটি শহরে এসপিভি (বিশেষ উদ্দেশ্য পূরণে যানবাহন সুবিধা) প্রতিষ্ঠিত করতে বাকি তহবিল বরাদ্দ করা হয়েছে।
তহবিল এমনভাবে বরাদ্দ করা হয়েছে যাতে সকল খাত সমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।
স্মার্ট সিটিজ মিশন – অগ্রগতি / অর্জনসমূহ
স্মার্ট সিটিজ মিশন অগ্রগতিতে এ পর্যন্ত ১৭ টি শহরে স্মার্ট কমান্ড এবং নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রসমূহ তৈরি করা হয়েছে- এটি বিভিন্ন পরিষেবা নেটওয়ার্কগুলিকে একীভূত করেছে এবং নগর প্রশাসন কেন্দ্রীয়ভাবে এই কেন্দ্রগুলো পর্যবেক্ষণ করতে পারে এবং এটি যেকোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে গতিশীলতা বৃদ্ধি করেছে। স্মার্ট রোডস -২৫ টি শহরে ৬০ টি প্রকল্প সমাপ্ত হয়েছে।
স্মার্ট সৌর প্রকল্প – স্মার্ট সৌর প্রকল্প ১৭ টি শহরে সম্পন্ন হয়েছে।
স্মার্ট বর্জ্য জল প্রকল্প – ১০ টি শহরে ১২ টি প্রকল্প সমাপ্ত হয়েছে। স্মার্ট জল প্রকল্প – ২৪ টি শহরে ৩৮ টি প্রকল্প সমাপ্ত হয়েছে। ভোপাল স্মার্ট সিটি প্রকল্পে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সম্পন্ন হয়েছে।
ইন্টিগ্রেটেড কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যাতে করে তা স্মার্ট সিটির জনগণের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা বাড়ানোর জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। ক্লাউড-ভিত্তিক দুর্যোগ পুনরুদ্ধার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
স্মার্ট সিটিজ মিশন – চ্যালেঞ্জ
নগর এলাকায় শক্তিশালী স্থাপত্য ও ভবন নির্মাণ এবং একই সাথে গাছপালার ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে।
নগর সংস্থা স্বনির্ভর করে তোলা হয়েছে, যাতে তা যেকোন বিপদ ও সমস্যা দ্রুত মোকাবেলা করতে পারে। বিভিন্ন কারণে গণপরিবহনের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে, ক্রমবর্ধমান নগরায়নের প্রয়োজন মেটাতে এটি বাড়ানো দরকার, এবং এই বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে, কিন্তু এটাও খেয়াল রাখা হবে যাতে গণপরিবহন বাড়লে সাথে পাল্লা দিয়ে দূষণের মাত্রাও বৃদ্ধি না পায়।
ক্রমবর্ধমান বায়ু দূষণ, নগরায়নের পরিমাণ বৃদ্ধির কারণে রাস্তায় যানজট বৃদ্ধি হ্রাস করা, ট্র্যাফিক সেবার মান বৃদ্ধি, রাস্তা পারাপারে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধিসহ সব ধরনের পদক্ষেপই থাকবে স্মার্ট সিটিজ মিশনে।
জরুরী কথা
স্বপ্নের ভারত গঠনে সরকার যেসব প্রকল্প হাতে নিচ্ছে তার মধ্যে স্মার্ট সিটিজ মিশন অন্যতম। কোভিড-১৯ মোকাবেলায় এই প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা আরও গতিশীল করেছে।
কারণ কোভিড-১৯ মোকাবেলায় অনলাইন নিয়ন্ত্রণ ও স্মার্ট কন্ট্রোল সিস্টেম উন্নয়নের প্রয়োজন যা স্মার্ট সিটিগুলোতে রাখা হবে। আশা করি স্মার্ট সিটিজ মিশন সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছি। আজকের মত এখানেই বিদায় নিচ্ছি।
স্মার্ট সিটি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানার হলে সরকারি ওয়েবসাইটে https://smartcities.gov.in/ গিয়ে জানতে পারেন।
কেন্দ্র সরকারের সমস্ত যোজনা | Click Here |
পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত প্রকল্প | Click Here |
বাংলাভুমি হোম | Click Here |