রামেশ্বরম জ্যোতির্লিঙ্গ বা রামনাথ স্বামী মন্দির (Rameshwaram Jyotirlinga Temple): ভারত হলো ধর্মপ্রধান দেশ। তার সাথে সাথে এখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বিভিন্ন ধরনের মন্দির স্থাপন কে ঘিরে অনেক কাহিনী জানেন। ভারত ধর্মীয় বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিকতার দেশ। বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা নিয়ে দেখলে সেটা উপলব্ধি করা যায় যে কোন এক অলৌকিক শক্তির অদৃশ্য উপস্থিত সবসময় লক্ষ্য করা যায় ভারতের আধ্যাত্মিক ও ধর্ম ও কেন্দ্র গুলির চারপাশে।
তেমনই প্রতিদিন মন্দিরের পেছনে যেমন পৌরাণিক কাহিনী ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে তেমনি কিন্তু সেই মন্দিরের চারিপাশে কোন এক অলৌকিক শক্তির উপলব্ধি করা যায়। তেমনি উত্তরে কেদারনাথ এবং দক্ষিণে রামেশ্বরম একই সরলরেখায় অবস্থান করছে। তার সাথে সাথে আরো অনেক গুলি শিব মন্দির মিলিত হয়েছে এই একই সরলরেখায়, যা কিনা সত্যিই বিস্ময়কর।
রামনাথ স্বামী অথবা রামেশ্বরম ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের রামনাথপুর জেলার পাম্মান দ্বীপে অবস্থিত। একটি সরলরেখা দ্বারা ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত অনেকে রামেশ্বর ব্রিজ বলেও চেনেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং বিশেষত সমুদ্র ও তার দুদিকে দুটি ভিন্ন রং দেখলে অবাক হতে হয়। সমুদ্র সৈকতও ভীষণ সুন্দর যা কিনা ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা।
রামনাথ স্বামী জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরের ইতিহাস ও পৌরাণিক কাহিনী:
রামায়ণের রাম যেমন রাবণকে যুদ্ধ তে হত্যা করেছিলেন কিন্তু রাবণ ছিলেন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ এবং খুবই বড় একজন শিব ভক্ত। তাই রাবনকে হত্যা করে ব্রহ্ম হত্যার জন্য দায়ী হয়ে পড়েন শ্রী রামচন্দ্র এবং সেই মহাপাপ থেকে মুক্তি পেতে তিনি ভারতের মাটিতে পা রেখে একটি শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করে তার আরাধনা শুরু করেন।
শ্রীরাম তারা স্থাপন করা সেই বিশেষ শিবলিঙ্গটি হলো এই রামেশ্বর শিবলিঙ্গ যা কিনা দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের একটি অন্যতম। এই শিবলিঙ্গ শ্রী রামনাথ স্বামী হিসেবেও পরিচিত।
মহাভারতের ন্যায় সনাতন ধর্ম শাস্ত্র গুলি যে শুধুমাত্র মহাকাব্য নয়, তার একটি অক্ষর সত্যি তা উপলব্ধি করা যায় রাম যে সেতু বানিয়েছিল হনুমানদের সাথে নিয়ে সেটাতে ১৯৮০ সালের আগে কিছুদূর পর্যন্ত হাটাও যেত কিন্তু ১৯৮০ সালের একটি ভয়াবহ সামুদ্রিক ঝড়ে এটি সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস হয়ে যায়।
পদ্মপুরাণ অনুসারে দুটি কাহিনী আমরা পাই:
১) যেমন ধরুন লঙ্কা পাড়ি দেওয়ার সময় শ্রীরামচন্দ্র যখন পাথর দিয়ে সেতু নির্মাণ করতে চাইলেন তখন এই বিশাল কাজটি সঠিক ভাবে সম্পাদন করার জন্য তিনি বালি দ্বারা একটি শিবলিঙ্গ তৈরি করে পূজা করে মহাদেবকে প্রসন্ন করেছিলেন। আর সেই শিবলিঙ্গ তিনি লঙ্কা থেকে উদ্ধার করে ফেরার সময় সীতাকে দেখিয়েছিলেন।
২) আরেকটি কাহিনী অনুসারে মহর্ষি পুলসের বংশধর রাবণ তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণ। তাই শ্রীরামচন্দ্র শীতাকে উদ্ধার করার জন্য রাবণকে হত্যা করেছিলেন যেটা কিনা ব্রহ্ম হত্যা ছিল। তাই লঙ্কা ত্যাগ করে সীতা রাম যখন রামেশ্বর দ্বীপে আসেন তখন ঋষি অগস্ত তাকে শিব পূজার বিধান দিয়েছিলেন।
শ্রীরামচন্দ্র হনুমানকে কৈলাসে পাঠান শিবলিঙ্গ আনার জন্য। কিন্তু তার দেরি দেখে সীতা বালির সাহায্যে একটি শিবলিঙ্গ তৈরি করেন এবং সেই শিবলিঙ্গ তেই পূজা শুরু করে দেন রামচন্দ্র। এখন অবস্থা ইতিমধ্যে হনুমান শিবলিঙ্গ নিয়ে ফিরে আসেন।
তার মন খারাপ হয়ে যায়, যে তার আসতে দেরি হয়ছে বলে বালি দিয়ে শিব লিঙ্গ তৈরি করে পূজা শুরু করে দিয়েছে রামচন্দ্র ! তখন শ্রীরামচন্দ্র ভক্তের ইচ্ছা বুঝতে পেরে সেই হনুমানের আনা শিবলিঙ্গ তে আবার পুজো করেন। তারপর পুজো শেষে সীতা সেই বিগ্রহ সারাতে বললে সেটা সরানো যায়নি।
পরে সীতা যে বালির শিবলিঙ্গটি গড়েছিলেন তার নাম রাখা হলো রামলিঙ্গম আর তার ভক্ত হনুমান যে শিবলিঙ্গ এনেছিলেন তার নাম রাখা হলো বিশ্ব লিঙ্গম। সেই মতো ঘটনা অনুসারে প্রথমত রামলিঙ্গম এর পুজোর পর তবেই কিন্তু বিশ্ব লিঙ্গমের পূজা করা হয়।
এছাড়া এই হনুমান দ্বারা আনা বিশ্ব লিঙ্গম বিদ্রোহ আজও এই মন্দিরে বিশ্বনাথ নামে পরিচিত। তাছাড়া এই মন্দিরের প্রধান দেবতা রামনাথ স্বামী হলেও ভক্ত হনুমানের মনের সন্তুষ্টির জন্য তার আনা লিঙ্গতেই প্রথম পূজা করা হয়।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং তার সাথে আধ্যাত্মিক তাৎপর্য এই দুটি মিলে স্থানটি তীর্থযাত্রীদের স্বর্গ রাজ্য বললে কম বলা হবে না। স্বামী বিবেকানন্দের কাছে খুবই প্রিয় জায়গা ছিল এই রামেশ্বরম। জীবনে দুবার এসেছিলেন তিনি এই রামেশ্বরমে।
তবে যাই হোক না কেন, এই রামেশ্বরম মন্দিরে নানা দেবদেবী প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। সারা বছর তাদের পূজা পার্বণ করা হয় এখানে। উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠানের মধ্যে মহা শিবরাত্রি হল অন্যতম। পূজা অর্চনা প্রায় সকল উৎসবই হয় এই মন্দিরে। তাছাড়া বাইরে থেকে কোনরকম আক্রমণের শিকার হতে হয়নি এই ঐতিহ্যগত রামেশ্বরম জ্যোতিরিঙ্গ মন্দির কে।
যা কিনা রামনাথ স্বামী নামে পরিচিত। আর সেই কারণে এটি সব সময় সমুউন্নত থেকেছে। এই মন্দিরের কয়েক লক্ষ একর জমি রয়েছে বছরের ব্যয় প্রায় ৭ কোটি টাকা। মন্দিরের বিশাল রত্নভাণ্ডার রয়েছে যা কিনা প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হয়ে চলেছে। প্রতিদিন ৩০০ গরিব দুঃখী মানুষকে এখানে ভোজন করানো হয়।
৫ একর জায়গা জুড়ে রয়েছে মাকরা পাথরে তৈরি এই প্রাচীন রামেশ্বরম শিব মন্দির। প্রাচীন রামেশ্বরম শিবমন্দির গর্ভ গৃহে একসঙ্গে রয়েছে ১২ টি শিবলিঙ্গ। বিভিন্ন ভিন্ন ভিন্ন জনশ্রুতি অনুসারে কারো কারো মতে এই মন্দিরটি ত্রেতা যুগে প্রতিষ্ঠিত সীতার শিবচতুর্দশী ব্রত উদযাপনের জন্য রামচন্দ্রের অনুরোধে দেব শিল্পী বিশ্বকর্মা রামেশ্বরম জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন বলে ধারণা।
আবার অনেকেই এই মন্দিরটিকে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের সাথে এক সময় তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন। মন্দিরটির আদল ও অনেকটা পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের মতোই দেখতে, নির্জন এলাকায় একটু উঁচু ঢিবির উপরে এই মন্দিরের পরিবেশটি কিন্তু খুবই সুন্দর যা কিনা যেকোন মানুষের মন জয় করে নেবে।
উৎসবের মরশুম ছাড়া জনসমাগম সেভাবে হয় না বললেই চলে। কেননা কোলাহলহীন ছায়াঘেরা এই মন্দির চত্বরে বসে থাকতেও মন্দ লাগবে না আপনার। তাছাড়া জনশূন্যহীন এই মন্দিরে উৎসব ছাড়া মানুষের চলাচল খুবই কম।
এছাড়া মহা শিবরাত্রি উপলক্ষে এই মন্দিরে বেশ বড় আকারে মহা শিবরাত্রি উৎসব পালন করা হয়। যার জন্য অনেক দূর থেকে ভক্ত ও পর্যটকরা এসে এখানে ভিড় জমান। খুবই নির্জন আর ছায়াযুক্ত এলাকায় এই রামেশ্বরম মন্দির টি যার চারিপাশটা একেবারেই নিস্তব্ধ যেখানে কোনরকম ব্যস্ততা পূর্ণ জীবনযাত্রা ছোঁয়া নেই বললেই চলে।
সেই কারণে সচরাচর এখানে তেমন জনসমাগম দেখা যায় না। দেবাদিদেব মহাদেবের উৎসব অনুষ্ঠান অনুযায়ী এখানে পূজা পার্বণ ভালোভাবে হয়ে থাকে। যদি আপনি রোমাঞ্চকর পরিবেশ পছন্দ করেন তাহলে এই রামেশ্বরম অথবা রামনাথ স্বামী জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির ও মন্দিরের চারিপাশ আপনার ভ্রমণের জায়গা হতে পারে।