(Patiram Shakti Peeth in Bengali) পতিরাম শক্তিপীঠের বর্তমান অবস্থান কোন স্থানে? দেবী সতীর কোন অঙ্গ এখানে পতিত হয়েছে? পতিরাম শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী কি? কিভাবে আরাধনা করা হয়? এই মন্দিরের তাৎপর্য কি? জানুন সবকিছু বিস্তারিত।
বিশ্বের সংসার ত্রি-শক্তির কৃপায় সুষ্ঠুভাবে চলছে, আর এই ত্রি শক্তি হলো ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর। হিন্দু ধর্মাবলম্বী দের কাছে এক একটি তীর্থস্থান এক একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং মাহাত্ম্য বহন করে। অনেকে আবার একটি তীর্থস্থানে বহুবারও গিয়েছেন।
তেমন সব তীর্থস্থান এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য হলো সতীর ৫১ টি শক্তি পীঠের মধ্যে বিরাট শক্তিপীঠ, আবার অনেকেই এই শক্তিপীঠকে পতিরাম শক্তিপীঠ বলে জানেন। সতীর দেহ অংশগুলি যখন পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়েছিল তখন এই স্থানে দেবীর বাম পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল পতিত হয়েছিল।
উত্তরবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় রয়েছে এই শক্তিপীঠ। তবে সেখানে একটি প্রাচীন মন্দির এবং মায়ের শ্বেত পাথরের মূর্তিও রয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে সেখানে মায়ের শিলারূপ নেই, সেখানে দেবী মনসা নামে পুজিতা হন দেবী, তবে এই মনসা সর্পের দেবী নন।
পতিরাম শক্তিপীঠ:
শক্তিপীঠের নাম | পতিরাম শক্তিপীঠ |
স্থান | পতিরাম দক্ষিণ দিনাজপুর, পশ্চিমবঙ্গ |
দেশ | ভারত |
দেবীর অংশ | বাম পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল |
শক্তির নাম | অম্বিকা মা বিদ্যেশ্বরী পতিরাম |
বিরাট / পতিরাম শক্তিপীঠের ভৌগোলিক গুরুত্ব:
পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট শহরের ৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণে বানগড় গ্রামে এই শহরে ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছিল।
শহরটির নাম হল উমাবন অথবা ঊষা বন। এখানে একটি বৌদ্ধমঠ ও ছিল। আবার এর সামান্য দূরে হরিরামপুর নামে একটি স্থানে শাম্মী বৃক্ষ রয়েছে।
যে স্থানে পান্ডবেরা অজ্ঞাতবাসের সময় তাদের অস্ত্রশস্ত্র গুলি লুকিয়ে রেখেছিলেন, যা গোটা ভারতে একটি রয়েছে।
বিরাট শক্তি পীঠ অথবা পতিরাম শক্তি পীঠের অবস্থান:
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এবং প্রমাণের উপরে ভিত্তি করে যদি এগোনো যায় তাহলে এই শক্তি পীঠের সন্ধান পাওয়া যায়, যেটা সেটা হল বর্তমানে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট ব্লকের পতিরাম অঞ্চলে অবস্থিত।
পতিরামের কুমারগঞ্জ রোড সংলগ্ন, স্থানীয় ভাষায় এটি বিদ্যেশ্বরী মন্দির নামে সকলের কাছে খুবই জনপ্রিয়।
আর হ্যাঁ এখানে একটা কথা বলে রাখা জরুরী যে, এই শক্তি পীঠে দেবী অম্বিকা মা বিদ্যেশ্বরী নামে পরিচিত হয়ে থাকেন, আর এখানে ভৈরব হলেন অমৃতাক্ষ। আর সেই নদীর পূর্ব পাড়ে রয়েছে মায়ের মন্দির, মায়ের মন্দিরের উত্তরে রয়েছে অমৃতাক্ষ ভৈরব ও পিছনে রয়েছে ভৈরব কুণ্ড।
মন্দির থেকে সামান্যটা এগিয়ে গেলে একটু দূরেই রয়েছে মহাশ্মশান। আগে শ্মশানটি দেবীর মন্দিরের কাছাকাছিতেই ছিল, কিন্তু কালের চক্রে নদী গতিপথ পরিবর্তন করেছে, সেই কারণে নদী দূরবর্তী হয়েছে আর এর পাশাপাশি নদীর সাথে শ্মশান ও দূরে সরে গিয়েছে।
পতিরাম শক্তিপীঠ এ দেবীর মাহাত্ম্য:
সতীকে নিয়ে যখন মহাদেব কাঁধে করে মহা তান্ডব নৃত্য শুরু করেছিলেন, তখন শ্রীবিষ্ণু কোন উপায় না দেখে দেবীর দেহকে সুদর্শন চক্র দিয়ে ৫১ টি খন্ডে বিভক্ত করে দেন।
আর সেই দেহ অংশ গুলির মধ্যে এই স্থানে দেবীর পায়ের অর্থাৎ বাম পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল গঠিত হয়েছিল। মন্দিরটি কূর্মাকৃতি, মন্দিরে কোন মূর্তি নেই।
এছাড়া দেবীর বেদীটি শুভ্র লাল পাড় শাড়িতে ঢাকা রয়েছে। বছর বছর প্রচুর শাড়ি জমা হলেও আশ্চর্যের বিষয় হলো বেদীর উচ্চতা বছরের পর বছর একই অবস্থায় থাকে।
এই বেদীতেই অন্ন ভোগ সহ দেবীর নিত্য পূজার আয়োজন করা হয়। লোকোমুখে শোনা কথা অনুসারে জানা যায় প্রতি বছর ভাদ্র মাসের কৌশিকি অমাবস্যা তিথিতে নদীপথে দেবীকে পূজা করতে আসতেন ভবানী পাঠক।
আরও জানা যায় যে, জনৈক্য মুরারি মোহন ভট্টাচার্য দেবী কামাখ্যার নির্দেশে গৃহত্যাগ করেন এবং কামাখ্যা ধামে ১২ বছর কঠিন সাধনা করতে থাকেন। পরবর্তীতে দেবীর নির্দেশে আত্রেয়ী নদীর তীরে তিনি আসেন। পরে দেবী তাকে ওই স্থানে গার্হস্থ্য ধর্ম পালন করার নির্দেশ দেন।
একদিন সন্ধ্যার সময় আত্রেয়ীর নদীর তীরে গভীর জঙ্গলে তিনি উজ্জ্বল আলোক ছটা দেখে বুঝতে পারেন যে, সেখানেই দেবীর অবস্থান রয়েছে।
এরপর জঙ্গল পরিষ্কার করে দেবীর স্থান আবিষ্কার করেন এবং নিত্য সেবা পুজো শুরু করে দেন। পরবর্তীতে তার এক কন্যার জন্ম হয়। কন্যার নাম রাখেন বিদ্যেশ্বরী। বিদ্যেশ্বরী বাবাকে পুজোর কাজে সাহায্য করত।
বাবা যখন অসুস্থ থাকে সে একদিন আসে দেবীকে সন্ধ্যা প্রদীপ দিতে। তারপর থেকে তার আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি অর্থাৎ সে হারিয়ে যায়।
রাত্রি তৃতীয় প্রহরে মোহনকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বিদ্যেশ্বরী জানায় সে মহামায়ার সঙ্গে লীন হয়ে গিয়েছে। তার পরনে লাল পাড়ের শাড়িটি দেবীর স্থানে ছড়ানো আছে।
দেবীর মন্দির ঘিরে আরো একটি পৌরাণিক কাহিনী:
এই মন্দিরটিকে কেন্দ্র করে আরো একটি কাহিনী রয়েছে, সেটি হল জনৈক্য পুরোহিত মায়ের বেদী থেকে কাপড় সরাতে গেলে সর্প ধ্বংসনে তৎক্ষণাৎ মারা যান।
তাই দেবীর ইচ্ছে অনুসারে ভক্তদের মানত করা শাড়ি একবার বেদী তে বিছানো হলে পরে তা আর তোলা হয় না, মায়ের মহিমা এমনই এই মন্দিরে।
এখনো পর্যন্ত অনেক ভক্ত বিশেষ তিথিতে রাতে মায়ের মন্দিরের চারিদিকে লাল পাড় সাদা শাড়ি পড়ে প্রদীপ হাতে নিয়ে কোন রমণীকে প্রদক্ষিণ করতে দেখতে পান বলেও শোনা যায়।
পতিরাম শক্তি পীঠে পূজা ও অনুষ্ঠান:
দেবীর এই মন্দিরে পূজা অনুষ্ঠান হয় খুবই ধুমধাম ভাবে। প্রতিবছরই অন্যান্য মন্দিরের মতো মায়ের অন্ন ভোগ সহ নিত্যদিনের পূজোর ব্যবস্থা রয়েছে।
গোটা বৈশাখ মাস জুড়ে এবং জৈষ্ঠ মাস জুড়ে এখানকার স্থানীয় মহিলারা হরীষ মঙ্গলচন্ডী ব্রত পালন করেন মায়ের মন্দিরে, পুজো দেওয়ার উদ্দেশ্যে।
এছাড়াও দুর্গা পূজার মহাষ্টমী তিথিতে বলি সহ প্রভাতে দেবীকে শ্রী গৌরী রূপে বিশেষ পূজার ব্যবস্থা করা হয়। তারপরে প্রতিবছর পৌষ মাসের বকুল অমাবস্যা তিথিতে তিন দিন ধরে সপ্তশতী যজ্ঞ অনুষ্ঠান এর মধ্যে দিয়ে মায়ের বাৎসরিক পূজা অনুষ্ঠান চলে।
এই পতিরাম শক্তি পীঠে মায়ের মন্দির খোলা হয় সকাল আটটায় (৮:০০) তারপর ভক্তরা সকাল সাড়ে দশটা (১০:৩০) থেকে পুজো দিতে পারেন। আবার দুপুরের সময় একটা ত্রিশে (১:৩০) ভোগ নিবেদন করার পর মন্দির বন্ধ থাকে। আবার খোলা হয় বিকেল সাড়ে চারটের (৪:৩০) সময়। রাত্রেবেলা আবার মন্দির সাতটার (৭:৩০) সময় বন্ধ করা হয়।
তবে বাৎসরিক পূজার দিন সারাদিনই মন্দির খোলা থাকে। বলা যেতে পারে ভোর সাড়ে পাঁচটা (৫:৩০) থেকে রাত ৮ টা (৮:০০) পর্যন্ত। তাই যদি সারা বছরে কোন সময় এই শক্তি পীঠে যান তাহলে এই সময় মেপে আপনাকে দেবী দর্শন করতে হবে। আর যদি বাৎসরিক পূজার সময় যান তাহলে তো তার কথাই নেই, আপনি সারাদিনই মায়ের দর্শন পাওয়ার সুযোগ পাবেন।
যাতায়াত ব্যবস্থা এবং যাত্রী নিবাস:
প্রতিটি তীর্থস্থানে যেতে গেলে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয়। আবার তার সাথে রয়েছে দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়া। তেমনি আপনি যদি এই পতিরাম শক্তি পীঠে যেতে চান, তাহলে কলকাতার শিয়ালদহ থেকে যেকোনো বাসে করে পতিরামের তালতলা মোড় অথবা চৌরঙ্গী মোড়ে নামতে হবে।
বালুরঘাট থেকে পতিরামের বিদ্যেশ্বরী মন্দির আসতে মাত্র ৩০ মিনিট সময় লাগবে আপনার। তাছাড়া মায়ের মন্দির থেকে সামান্য দূরে সরকারি অতিথিশালা রয়েছে, যার নাম “পথসাথী” অর্থাৎ এখানে যারা তীর্থ ভ্রমন করতে আসেন, তাদের জন্য থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।
সবদিক থেকে এই তীর্থস্থান অথবা শক্তি পীঠ আপনার চোখ জুড়িয়ে দেবে, পুণ্য অর্জনের পাশাপাশি দেবীর দর্শন আর চারিপাশটা ঘুরে দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এবং দেশের বাইরে থেকেও পর্যটক, ভক্তগণ, পুণ্যার্থীদের সমাগম লেগেই থাকে সারা বছর।
এছাড়া বাৎসরিক উৎসবে এখানে ভক্তদের ঢল নামে। এই তীর্থক্ষেত্রে ভক্তদের থাকার জন্য সুব্যবস্থা রাখা হয়েছে, তাই আপনি সহজেই এখানে গিয়ে ঘুরে আসতে পারেন কিছুদিনের জন্য।