2023 পান চাষের সঠিক ও সহজ পদ্ধতি | 2023 Paan Cultivation Method in Bangla

বাঙালির এক ঐতিহ্যবাহী কালচার সুপারি আর মিষ্টি জর্দা দিয়ে ঠোঁট লাল করে পান চিবোনো। দুপুরের গরমে উদরপূর্তি করে নেমন্তন্ন খেয়ে গাছতলায় তালপাতার পাখার বাতাস খেতে খেতে আয়েশ করে পান চিবোনোর দৃশ্য ইট, পাথরের শহুরে জীবন থেকে হারিয়ে গেলেও, গ্রামের দিকে এখনও প্রচলিত।

পানের কথা উঠলে আমার মনে পড়ে যায় বিংশ শতকের গোড়ার দিকের শরৎবাবুর দেবদাস আর চুনিলালের বন্ধুত্বের কথা। তারা সাদা ধূতি, সাদা পাঞ্জাবি পরে, হাতে চামেলি ফুলের মালা লাগিয়ে, গায়ে সুগন্ধি মেখে নাচ দেখতে চন্দ্রমুখীর আসরে যেতো।

তাদের মুখভর্তি থাকতো কস্তুরি মাখা পান। আজও বাঙালি পান খেয়ে, পানের পিকে সাদা পাঞ্জাবি লাল করে। পান নিয়ে জিকির করেছেন কবি আলাওল। মধ্যযুগীয় এই কবি তার পুঁথি সাহিত্যে বলেছেন, “অধর রাতুল কৈল তাম্বুল রসে”।

জানি কিছুই বুঝতে পারেন নি। তবে অমিতাভ বচ্চন স্যারের ‘ডন’ সিনেমার কথা মনে আছে? সেখানে তিন পান খাওয়া প্রসঙ্গে গেয়েছেন, ‘খাইকি পান বানারাস ওয়াল, খুল য্যায়ে বান্ধ আকাল তালা।’

Paan Cultivation Method in Bangla
Paan Cultivation Method in Bangla

আজ আমরা আপনাদের সাথে পান চাষের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করবো। এতে করে আপনারা সহজেই পান চাষের বিস্তারিত জানতে পারবেন।  এটি আপনাদের পারিবারিক চাহিদা মেটবে এবং চাষাবাদ করে আয় করার সুযোগ লাভ করবেন। আসুন জেনে নিই পান চাষের বিস্তারিত

পান হচ্ছে সুপারির সাথে পান পাতার সংমিশ্রণের একটি প্রস্তুতি। পান পাতা একপ্রকার লতাজাতীয় গাছের পাতা। আর্য এবং আরবগণ পানকে তাম্বুল নামে ডাকতো।

আজ আমরা জানবো সেই পান পাতার চাষ সম্পর্কে। এর চাষাবাদ সম্পর্কে জ্ঞান নিয়ে সম্ভব হলে নিজেই শুরু করে দিতে পারেন পানের চাষ।

পান পাতার ধরন

এই উপমহাদেশে হরেক রকমের পান মিলে। এখানে মিলে বাংলা, মিঠা, সাচি, কর্পূরী, গ্যাচ, নাতিয়াবাসুত, উজানী, মাঘি, দেশী, মহানলী, চেরফুলি, ভাবনা, সন্তোষী, জাইলো, ভাওলা, ঝালি প্রভৃতি জাতের পান। আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পানের চাষ করতে দেখা যায়।

মাটি ও জমি তৈরী

পান চাষের জন্য প্রয়োজন দোআঁশ বা এটেল দোআঁশ মাটিযুক্ত জমি। আর ভূমি হতে হয় উঁচু। তাছাড়া জমির আশাপাশ ছায়াযুক্ত হতে হয়। জমিকে আগাছামুক্ত করে নিতে হয়।

প্রতি ৬০ সেন্টিমিটার পর পর ২০ সেন্টিমিটার চওড়া করে নালা তৈরি করে নিতে হয়। দু’নালার মাঝখানের ভিটিতে চারা রোপণ করতে হয়।

চারা রোপণের আগে ৪০% ফরমালিন বা ১% বোঁর্দো মিশ্রণ দিযে মাটি মোধন করে নিলে গোড়া পচা রোগসহ মাটিবাহিত অন্যান্য রোগ হওয়ার আশংকা কম থাকে।

বরোজ তৈরীঃ

পান চাষে জন্য বরোজ তৈরী করে নিতে হয়। প্রথমে জমির চারপাশে খুঁটি গাড়তে হয়। তারপর তাতে বাঁশের চটা, ছন বা খড় দিয়ে ছাউনি তৈরী করে দিতে হয়। পরে শুকনা কলাপাতা, খেজুর পাতা, সুপাড়ি পাতা এসব দিয়ে চারদিকে বেড়া করে দিতে হয়।

এই বরোজ পান পাতাকে ছায়া দেয়। আবার প্রবল বাতাসের হাত থেকেও রক্ষা করে। বরোজ তৈরী হয়ে গেলে ভেতরে চারা রোপনের পর প্রয়োজনমত কাঠি দিয়ে বেঁধে দিতে হয়।

বরোজের ভেতরে বেড তৈরী করতে হয়। আর প্রতিটি বেড সাধারণত ১২০ সেন্টিমিটার চওড়া করে তৈরি করতে হয়। চারা রোপণের সময় প্রতিটি বেডে দুই সারি করে চারা রোপণ করতে হয়।

একটি সারি থেকে আরেকটি সারির দূরত্ব ৩০ সেন্টিমিটার করে রাখতে হয়। প্রতি দুই বেডের মাঝে ৩০ সেন্টিমিটারের নালা রাখা রাখতে হয়।

চারা রোপণ

পান পাতা লাগানোর উপযুক্ত সময় বর্ষাকাল। চারা লাগানোর সময় পানের চোখ বা মুকুল মাটির ওপরে রাখতে হয়। আর বাকি অর্ধেক মাটির নিচে।

দ্বিসারি পদ্ধতিতে ৫-১৫ সেন্টিমিটার লম্বা কাটিং লাগে শতক প্রতি ৪০০-৫০০ টি।

সার প্রয়োগ

ভালো ফলন পেতে জমিতে সঠিক মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে জৈব সারের পাশাপশি সুষম মাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে।

প্রতি শতক জমির জন্য খৈল প্রয়োগ করতে হবে ২০ কেজি, এসএসপি ২.৫ কেজি, এমওপি ৬০০ গ্রাম এবং ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে ১.৮ কেজি।

ইউরিয়া প্রতিবারে মোট পরিমাণের এক চতুর্থাংশ প্রয়োগ করতে হবে।

পানে রোগের আক্রমণ

সময়ের সাথে সাথে পানের ক্ষেত বরোজ নানান রোগে আক্রান্ত হয়। এক ধরণের ছত্রাকের আক্রমণে পানের গোড়া পঁচে যায়। এই রোগের আক্রমণ ঠেকাতে বোঁর্দে মিশ্রণ দিয়ে মাটি শোধন করতে হয়।

এতে রোগের আক্রমণ কমে যায়। আর যদি পানের গোড়া পঁচা রোগ বেশি হয় তবে ডায়থেন বা রিডোমিল নামক কিছু ছত্রাক নাশক আছে তা কয়েকদিন পর পর স্প্রে করতে হবে। ছত্রাকের আক্রমণে পাতায় এক ধরনের দাগ পড়া রোগ হয়।

পাতায় যদি ছত্রাকের আক্রমন হয় তবে আক্রান্ত পাতা পুড়িয়ে ফেলতে হয়। পাশাপাশি কুপ্রাভিট বা বাভিস্টিন ছত্রাকনাশক স্প্রে করেও এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

পানের উপকারিতা

প্রধানত দক্ষিণ এশিয়া, উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশসমূহ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানুষ পান খায়। এই পান আগে শুধু মুখের দুর্গন্ধ দূর করার কাজে ব্যবহার করা হতো।

কিন্তু বর্তমানে পানের বহু উপকারিতা চোখে পড়ে। পানের উপকারিতা সমূহ পয়েন্ট আকারে নিচে দিয়ে দিলাম।

১. পান হজমে সহায়তা করে। পান পাতা ছিঁড়ে জলের সাথে সেদ্ধ করে সেই জল পান করলে বদ হজমের সমস্যার সমাধান হয়। জল সেদ্ধ করার সময় সেখানে গোলমরিচও দেয়া যেতে পারে।

২. দেশের বিভিন্ন গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে জানা গেছে, যদি পান গাছের শিকড় বেটে রস খাওয়া যায় তাহলে সন্তান হয় না। ভয়াবহ ব্যাপার। জন্ম নিরোধক বড়ি ছাড়াই জন্মনিয়ন্ত্রণ করা যাবে।

৩. পান পাতার রস মাথায় লাগালে উকুন মরে যায়। উকুনের সমস্যার সমাধান।

৪. যাদের কান পাকার সমস্যা আছে তাদের জন্য পান পাতা আশীর্বাদ। পান পাতার রস বেটে কানের পাকা অংশে দিলে নিরাময় হয়।

৫. দাদ হলে বা চুলকানি হলে সেখানে পানের রস লাগিয়ে দিলে কিছুটা আরাম পাওয়া যায়।

আজ আমরা পান চাষ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলাম। আগামীতে আপনাদের সাথে পান চাষ নিয়ে আরো কিছু আলোচনা করবো, তাই আমাদের পেজে নিয়মিত চোখ রাখুন। এই লেখাটি অনেকের কাজে লাগতে পারে তাই লেখাটি যতটুকু সম্ভব শেয়ার করুন, যাতে করে অনেকে এই লেখা থেকে শিক্ষা নিয়ে পান চাষ করে আয় করার ব্যবস্থা করতে পারে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top