ন্যাশনাল জল মিশন, ভারত সরকারের জল সংরক্ষণের ও জল সংগ্রহের মিশন। প্রতি বছর মাথাপিছু জলের প্রাপ্যতা হ্রাস, ভূগর্ভস্থ জলের পরিমাণ কমে যাওয়া, দীর্ঘমেয়াদি খরা এবং অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে বন্যার সৃষ্টি, জল সংরক্ষণ এবং স্টোরেজ এগুলো হচ্ছে ন্যাশনাল জল মিশনের অন্তর্ভুক্ত বিষয়।
জলের সঠিক ব্যবস্থাপনার সাথে একটি জাতির সুস্থতা, সমৃদ্ধি, পরিবেশের ভারসাম্য সবকিছুই নির্ভর করে। কারণ জলের অপর নামই জীবন। জল ছাড়া বেচে থাকা অসম্ভব।
তাই ন্যাশনাল জল মিশন জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। জল সম্পদের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়ে থাকে।
হিমালয়ের হিমবাহের হ্রাসের কারণে হিমালয়ের বরফ গলে যাচ্ছে, যার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বৃষ্টির ঘাটতির কারণে দেশের অনেক জায়গায় খরা দেখা দিচ্ছে, আবার দেশের বিভিন্ন স্থানে অতিবৃষ্টিপাতের তীব্রতা বৃদ্ধির কারণে বন্যার পরিমাণ বেড়েছে।
দেশের সবস্থানের জলের অবস্থা সমান নয়, জলবায়ু, আবহাওয়া এবং পরিবেশের অন্যান্য উপাদানের তারতম্যের কারণে জল বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।
এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রয়োজন সঠিক জল ব্যবস্থাপনা, যাতে কোন অঞ্চলে জলের সংকট বা আধিক্য না দেখা দেয়, জলের ভারসাম্য বজায় থাকে।
সুপ্রিয় পাঠক আমাদের আজকের আলোনার উদ্দেশ্য ন্যাশনাল জল মিশন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা। চলুন দেরী না করে মূল আলোচনায় যাওয়া যাক।
ন্যাশনাল জল (জল জীবন) মিশন থাকার উদ্দেশ্য কী?
ন্যাশনাল জল মিশনের মূল উদ্দেশ্য জলের সংরক্ষণ করা, জলের অপচয় হ্রাস করা।
জলের সংস্থানগুলি এমনভাবে পরিচালনা করা যাতে সারা দেশে জলের সমান বন্টন হয়। এতে করে কোন অঞ্চল জলের সংকটে ভুগবে না, আবার কোন অঞ্চল জলাবদ্ধতায় থাকবে না।
ন্যাশনাল জল মিশনের উদ্দেশ্য মাধ্যমে ২০% জল ব্যবহারের দক্ষতা বৃদ্ধি করা।
নগর অঞ্চলের জলের প্রয়োজনের একটি বড় অংশ অপরিশোধিত জলের পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে পূরণ করতে হবে।
নিম্ন-তাপমাত্রা বিশোধন প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে উপকূলীয় শহরগুলির জলের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাত এবং নদীর প্রবাহের পরিবর্তনশীলতার মোকাবিলার জন্য পরিবেশ দূষন কমাতে হবে, এবং নদী এবং সাগরের জলের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে যাতে বন্যা, অঞ্চল তলিয়ে যাওয়ার মত দূর্যোগ না ঘটে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। জল ব্যবস্থাপনার কৌশলগুলি নিশ্চিত করার জন্য রাজ্যগুলির সাথে পরামর্শ করা প্রয়োজন হলে অবিলম্বে তা করতে হবে।
মাটির উপরে এবং নীচে জলের স্টোরেজ বাড়াতে হবে, বৃষ্টির জলের কার্যকর সংগ্রহ করতে হবে, যাতে তা পানীয় হিসেবে ব্যবহার করা যায়, সাথে অন্যান্য প্রয়োজনেও ব্যবহার করা যায়।
বড় আকারের সেচ কর্মসূচি গ্রহণ করাও এই মিশনের লক্ষ্য যা স্প্রিংকলার, ড্রিপ সেচ এবং রিজ এবং ফুরো সেচের মাধ্যমে জমিতে জলের অভাব দূর করবে।
ন্যাশনাল জল মিশন প্রকল্পটি ২ভাগ নিয়ে গঠিত। একটি ভাগ মিশনের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল, গবেষণা ও বিকাশ যা এই মিশনের জন্য প্রয়োজন হবে, এছাড়াও মিশন পর্যবেক্ষণ এবং এই মিশনটি পরিচালনার জন্য বিভিন্ন কমিটির গঠন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কাজ করে।
মিশনের নথির দ্বিতীয় খণ্ডে ৬ টি পৃথক উপ-কমিটি দ্বারা উৎপন্ন জল বিষয়ক প্রতিবেদনের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। উপ-কমিটিগুলি হল:-
“সারফেস ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট কমিটি” সম্পর্কিত উপ-কমিটি,”বিভিন্ন উদ্দেশ্যে কমিটির জন্য জলের দক্ষ ব্যবহার” সম্পর্কিত উপ-কমিটি, “গার্হস্থ্য এবং শিল্প জল পরিচালনা কমিটি সম্পর্কিত উপ-কমিটি, “নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো কমিটি” সম্পর্কিত উপ-কমিটি “ভূগর্ভস্থ ব্যবস্থাপনা কমিটি” সম্পর্কিত উপ-কমিটি, “বেসিন স্তরের পরিকল্পনা ও পরিচালনা” সম্পর্কিত উপ-কমিটি।
এই মিশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক ছিল জলসম্পদ তথ্য সিস্টেম (ডাব্লুআরআইএস) প্রতিষ্ঠা করা। এটি পাবলিক ডোমেনে জল সংস্থান সম্পর্কিত একটি বিস্তৃত ডাটাবেস রাখার মিশনের লক্ষ্য পূরণ করে।
ন্যাশনাল জল মিশন পুরষ্কার ২০১৯
ন্যাশনাল জল মিশনের মিশন দলিল অনুসারে, মিশনের ৫টি লক্ষ্য এবং ৩৯টি কৌশল রয়েছে। অন্যতম কৌশল হ’ল সংস্থাগুলিকে পুরষ্কারের মাধ্যমে উৎসাহিত করা।
এই মিশনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে টেকসই জল ব্যবস্থাপনায় জলের দক্ষতা অর্জন, এবং জল সংরক্ষণে উৎকর্ষতার জন্য সম্মানের জন্য ‘ন্যাশনাল জল মিশন পুরষ্কার’ প্রদান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জনগণের ডোমেইনে বিস্তৃত জলের ডাটাবেস – এই পুরষ্কারের বিজয়ীরা হলেন জল সম্পদ বিভাগ, অন্ধ্র প্রদেশ সরকার এবং সেচ ও সিএডি বিভাগ, তেলঙ্গানা সরকার।
জল সম্পদের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের মূল্যায়ন – এই পুরষ্কারের বিজয়ীরা হলেন পরিবেশ পরিকল্পনা ও সমন্বয় সংস্থা (ইপিসিও), পরিবেশ অধিদপ্তর, ভোপাল।
জল সংরক্ষণ, বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের জন্য নাগরিক এবং রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপের প্রচার – বিজয়ীরা হলেন জলসম্পদ বিভাগ, রাজস্থান সরকার এবং পাঞ্জাব সরকার মাটি ও জল সংরক্ষণ বিভাগ অতিরিক্ত শোষণযুক্ত অঞ্চলগুলি সহ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে মনোনিবেশ করা প্রতিষ্ঠান – বিজয়ীরা হলেন অম্বুজা সিমেন্ট ফাউন্ডেশন এবং তেলঙ্গানা সরকার রাজ্য ভূগর্ভস্থ জল বিভাগ।
জল জীবন মিশনের লক্ষ্য কী?
এই মিশনের আওতায় সরকারের লক্ষ্য হ’ল ২০২৪ সালের মধ্যে সমস্ত পরিবারকে নলের জল সরবরাহ করা।জল শক্তি অভিযানএটি ২৫৬ টি জেলায় ১৫৯২ টি স্ট্রেসড ব্লকের উপর জোর দিয়ে জল শক্তি মন্ত্রণালয় দ্বারা পরিচালিত একটি প্রচারণা।
জল জীবন মিশন গুরুত্বপূর্ণ কারণ ১৯৫১ সালে, জলের মাথাপিছু প্রাপ্যতা প্রতি বছর মাত্র ৫০০০ ঘনমিটারেরও বেশি ছিল। ২০১১ সালে এটি ছিল ১৫৪৫ ঘনমিটার। বর্তমানে ভারতে ১৮০ মিলিয়ন পরিবার রয়েছে।
প্রায় ৩৩ মিলিয়ন পাইপযুক্ত পানিতে অ্যাক্সেস পেয়েছে, তবে ১৪৫ মিলিয়নেরও বেশি এই অ্যাক্সেস পায় না। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত মিশনের লক্ষ্য এই ২০২২ সালের মধ্যে এই সমস্ত পরিবারকে জল সরবরাহ করা।
জল জীবন মিশনের বাজেট হচ্ছে, এই মিশনে ব্যয় হবে ৩,৫০,০০০ কোটি টাকা বা প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার।
জল জীবন মিশন গ্রামীণ অর্থনীতিতে কেনো উত্সাহ পাবে? বছরে প্রায় ৭০,০০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে।
জল মিশনের বাস্তবায়নের কোন মন্ত্রণালয় কাজ করছে?
জলশক্তি মন্ত্রনালয় এর বাস্তবায়নের জন্য দায়বদ্ধ। জলসম্পদ, নদী উন্নয়ন ও গঙ্গার পুনর্জীবন মন্ত্রন এবং পানীয় জল ও স্যানিটেশন মন্ত্রনালয়কে একত্রিত করে জলশক্তি মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়েছে।
জলশক্তি অভিযানের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে এটি ৫ টি বিষয়ে আলোকপাত করবে: জল সংরক্ষণ এবং বৃষ্টির জল সংগ্রহ ঐতিহ্যবাহী এবং অন্যান্য জলাশয়গুলির সংস্কার, জলের পুনঃব্যবহার এবং কাঠামোগুলি পরিবর্তন করা,জলাশয় উন্নয়ন এবং নিবিড় বনায়ন করা ন্যাশনাল জল মিশনের মূল লক্ষ্য।
আরো কিছু
ন্যাশনাল জল (জল জীবন) মিশন প্রতি বছরে ৭০,০০০ কোটি টাকা ব্যয়ে সারা দেশের জলের সংকট পূরণ করবে এবং ২০% জল সাশ্রয় করে তা ঘাটতি অঞ্চলে ব্যবহারের ব্যবস্থা করবে।
ন্যাশনাল জল মিশন সম্পর্কে আরো বিস্তারিত তথ্য এবং স্থিতি সরকারি ওয়েবসাইটে nwm.gov.in দেখতে পারেন।
মূলত জল সঠিকভাবে সংরক্ষন করা গেলে ঘাটতি দূর করা সম্ভব হবে। আর দূর্যোগ এড়াতে প্রয়োজন হবে পরিবেশ দূষন রোধ করা যাতে নদী ও সমুদ্রে জলের উচ্চতা বৃদ্ধি না পায়, পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে হিমালয়ের বরফ গলে না যায়।
এ সমস্ত পদক্ষেপই ন্যাশনাল জল মিশনের অন্তর্ভুক্ত। সুপ্রিয় পাঠক আশা করি ন্যাশনাল জল মিশন সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেওয়ার প্রয়াস সফল হয়েছে।