Nalateswari Shakti Peeth in Bengali - নলহাটেশ্বরী শক্তিপীঠ

নলহাটেশ্বরী শক্তিপীঠ: যে স্থানে সতীর শ্বাসনালীসহ কণ্ঠনালী পতিত হয়েছিল

(Nalateswari Shakti Peeth in Bengali) নলহাটেশ্বরী শক্তিপীঠের বর্তমান অবস্থান কোন স্থানে? দেবী সতীর কোন অঙ্গ এখানে পতিত হয়েছে? নলহাটেশ্বরী শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী কি? কিভাবে আরাধনা করা হয়? এই মন্দিরের তাৎপর্য কি? জানুন সবকিছু বিস্তারিত।

সতী পার্বতীর খণ্ড-বিখন্ড দেহ অংশগুলি পৃথিবীর বুকে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে এক একটি সতীপীঠ অথবা শক্তি পীঠের জন্ম দিয়েছে। তেমনি ৫১ টি শক্তি পীঠের মধ্যে অন্যতম হলো নলহাটেশ্বরী শক্তিপীঠ।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, এই স্থানে দেবীর শ্বাসনালীসহ কণ্ঠনালী পতিত হয়েছিল। নলহাটেশ্বরী মন্দির বীরভূমের নলহাটিতে অবস্থিত। এই মন্দির ৫১ টি শক্তি পীঠের মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি উপপীঠ ও বলা যায়।

Nalateswari Shakti Peeth in Bengali - নলহাটেশ্বরী শক্তিপীঠ
Nalateswari Shakti Peeth in Bengali – নলহাটেশ্বরী শক্তিপীঠ

এখানে প্রতিষ্ঠিত দেবীর নাম কালিকা ও এখানে ভৈরব হলেন যোগেশ। স্থানীয় মানুষজনরা এখানে দেবীকে নলহাটিশ্বরী বলে সম্মোধন করে থাকেন। স্থানীয় অনেকেই জানেন না যে, এটি সতী পীঠ এর মধ্যে একটি, প্রচারের আলো থেকে এই নলহাটেশ্বরী শক্তিপীঠ অথবা মন্দিরটি এখনো পর্যন্ত অনেক দূরে রয়েছে।

নলহাটেশ্বরী শক্তিপীঠ:

শক্তিপীঠের নাম নলহাটেশ্বরী শক্তিপীঠ
স্থান নলহাটেশ্বরী মন্দির, নলহাটী স্টেশনের নিকট, বীরভূম জেলা, পশ্চিমবঙ্গ
দেশ ভারত
দেবীর অংশ শ্বাসনালীসহ কণ্ঠনালী
শক্তির নাম কালিকা

নলহাটেশ্বরী শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী:

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে জানা যায়, মাতা সতী নিজের বাপের বাড়িতে বাবার কাছে স্বামী মহাদেবের অপমান সহ্য করতে না পেরে, সেই জায়গাতেই দেহ ত্যাগ করেছিলেন।

মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছাতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন, আর সতীর মৃতদেহ দেখে একেবারে ক্রোধে উন্মাদ পাগল হয়ে ওঠেন।

সেই অবস্থায় দেবীর মৃতদেহ কাঁধে করে তুলে নিয়ে তান্ডব নৃত্য শুরু করে দেন। মহাদেবের সেই তাণ্ডব নৃত্য তে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার উপক্রম দেখা দেয়।

এমন পরিস্থিতিতে পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য এবং মহাদেবকে শান্ত করার জন্য শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহটি ৫১ টি খন্ডে বিভক্ত করে দিয়েছিলেন।

সেই খন্ড-বিখন্ড দেহ অংশগুলি যে যে জায়গায় পতিত হয়েছিল, সেই সেই স্থানে একটি করে সতী পীঠ এর প্রতিষ্ঠা হয়েছে। বলা যেতে পারে অনেক হাজার বছর আগে কামদেব প্রথম মায়ের স্বপ্ন এ আদেশ পেয়েছিলেন।

মায়ের আদেশে তিনি ব্রাহ্মণী নদীর তীরে ললাট পাহাড়ের নিচে যেখানে মায়ের কন্ঠনালী পড়েছিল তার উপরেই দেবী নলহাটেশ্বরী মন্দির স্থাপন করেছিলেন। এছাড়া আরো বলা হয় যে, এখানে পাথরের টিলাতে সীতার চুল আঁচানোর দাগও আছে ও কড়ি খেলার গর্তও আছে, লোকমুখে শোনা কথা অনুসারে রাম এখানে কিছু কাল অস্থায়ী ভাবে বসবাস করেছিলেন।

নলহাটেশ্বরী মন্দির নির্মাণ:

লোকোমুখে শোনা কথা অনুযায়ী আনুমানিক ৫০০ বছর আগে পাইকপাড়া গ্রামের ব্যবসায়ী রাম শরন শর্মা কে দেবী স্বপ্ন দেন যে, তিনি এখানে খোলা আকাশের নিচে রয়েছেন তাকে যেন প্রতিষ্ঠা করা হয় খুব শীঘ্রই। স্বপ্নের আদেশ অনুসারে রাম শরন শর্মা এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

পাহাড়ের মাঝে একটি গাছের নিচে মায়ের প্রস্তুরীভূত দেহাংশটি পড়েছিল সেখানেই তিনি মন্দিরটি স্থাপন করেন। এছাড়া এই মন্দির থেকে একটু দূরে যেতেই যকধরী নদী বয়ে চলেছে। যার আসল নাম হলো ব্রাহ্মণী নদী।

বহু যুগ আগে এই নদী নাকি মন্দিরের পাশে দিয়েই বয়ে যেত। একসময় এই জায়গাটি ছিল খুবই ঘন জঙ্গলে এবং জঙ্গলের জীবজন্তুতে পরিপূর্ণ ছিল।

বলা হয় দিনের বেলা কেউ আসতে পারতো না। এখানে সূর্যের আলো এসেও পৌঁছাত না, এতটাই ঘন জঙ্গল ছিল এই স্থানে। মায়ের পূজা করতে কেবলমাত্র কাপালিক ও তন্ত্রসাধকরা আসতেন এই জায়গায় আর পূজো দিয়ে যেত তখনকার লুট কারীরা অর্থাৎ ডাকাত দলের সকলে।

সেই সমস্ত ডাকাতরা কোথাও লুটপাট করার জন্য ডাকাতি করার জন্য গোপন রাস্তা দিয়ে এসে মায়ের পূজা দিয়ে যেত। যাতে তাদের সেই কাজ সম্পন্ন হয় ভালোভাবে। পরবর্তী কালে এর পরিস্থিতি অনেকখানি বদলে যায়।

পুরনো মন্দির সংস্কার করা হয়, আশেপাশের জঙ্গল পরিষ্কার করা হয়। এই মন্দিরের ভৈরব যোগেশ্বর মন্দিরের ভিত খোড়ার সময় একটি পাথর পাওয়া যায় যেখানে নারায়নের পদচিহ্ন খোদাই করা ছিল। এই পাথরটিকে মন্দিরে গাঁথাই করা আছে। এখানে মাটির নিচে কিছু জায়গায় কথা বলা হয়, যেখানে নাকি বর্গীরা অর্থাৎ লুণ্ঠনকারীরা আশ্রয় নিত।

এছাড়াও মন্দিরের চারিদিকে অনেকগুলি গর্তের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। সেই গর্তগুলি সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, যেখানে মানুষ পড়ে গেলে আর তার সন্ধান পাওয়া যায় না, গর্ত গুলির এতটাই গভীর ছিল। স্থানীয় বিশ্বাস অনুযায়ী এই গর্ত অথবা সুরঙ্গ গুলো আসলে মন্দিরে যাওয়ার গোপন রাস্তা।

নলহাটেশ্বরী মন্দিরে দেবীর রূপ:

প্রতিটি মন্দিরে দেবীর আলাদা আলাদা রূপ থাকে। তাই এই মন্দিরে দেবী ত্রিনয়নী ও তার জিহ্বা টি সোনা দিয়ে তৈরি। মন্দিরের অভ্যন্তরে দেবীর দেহাংশ যা কিনা প্রস্তরীভূত হয়ে রয়েছে, সেটা খুবই সুরক্ষিত ভাবে রক্ষিত আছে।

প্রত্যেকদিন দেবীকে স্নান করিয়ে মঙ্গল আরতি করার আগে দেবীর প্রস্তরীভূত অঙ্গ ভক্তদের দর্শন করানোর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকে।

এখানে নারায়নের পদচিহ্ন আঁকা যে শিলাটি মন্দিরের গাঁথা আছে, আগে তাকে প্রণাম জানিয়ে তারপর দেবীর পূজা শুরু করা হয়ে থাকে। প্রত্যেকদিন দেবীকে অন্ন ভোগ প্রদান করা হয়ে থাকে।

নলহাটেশ্বরী শক্তিপীঠে পূজা অর্চনা:

যেহেতু এটি একটি শক্তিপীঠ, স্থানীয় মানুষজন খুবই ভক্তির সাথে এখানে পূজা অর্চনা করে থাকেন। তাছাড়া ও এখানে দুর্গা পূজার সময় মাকে দুর্গা রূপে, কালী পূজার সময় মাকে বিশেষ পুজোর ব্যবস্থা করা হয়। বিশেষ বিশেষ অমাবস্যা তিথিতে মন্দিরে হোম যজ্ঞের ব্যবস্থা থাকে।

তবে বিশেষ উৎসবের মধ্যে শিবরাত্রিতে দেবী মন্দির ও ভৈরব শিবের মন্দিরে হলুদ সুতো দিয়ে বেঁধে যোগসূত্র স্থাপন করা হয়। তবে শুধুমাত্র কালী পূজার দিনে মায়ের ভোগ হয় রাত্রেবেলা।

এছাড়া এখানে বলি প্রথা এখনো চালু রয়েছে বলেও জানা যায়। প্রথা মেনে দূর্গা পূজার নবমী ও কালীপুজোর দিন নিশ্চিতভাবে বলি হয় এই মন্দিরে।

সারা বছর ধরে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত এমন কি ভিন রাজ্য থেকেও বহু ভক্তরা ভিড় জমান মায়ের মন্দিরে। মানত করে, বিয়ে, পৈতের মত শুভ অনুষ্ঠান সেরে থাকেন অনেকেই এই মন্দিরে মায়ের সামনে।

সেই জন্য এখানে মূল মন্দিরের কোন পরিবর্তন না হলেও যাত্রীদের সুবিধার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা এখানে করা হয়েছে। দর্শনার্থীদের জন্য বর্তমানে ৩০ টি যাত্রী নিবাস তৈরি করা হয়েছে।

সাধু সন্ন্যাসীদের জন্য আলাদা আলাদা ভাবে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে শৌচালয় সহ আরো অন্যান্য বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা। মন্দিরের আশেপাশে জঙ্গল কিছুটা পরিষ্কার করা গেলেও, তারপরেও ঘন জঙ্গল সেভাবেই রয়েছে। তাই এখানকার সবুজে ঘেরা পরিবেশ আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *