আমাদেরকে মাছে-ভাতে বাঙালি বলার চেয়ে ডালে-ভাতে বাঙালি ডাকা বেশি যুক্তিযুক্ত। প্রতিবেলায় ভাতের সাথে মাছ থাকুক আর না থাকুক, ডাল অবশ্যই থাকতে হবে। এদিক থেকে মসুর ডাল বেশি জনপ্রিয়।
বাঙালির পাতে ওঠার আগে মসুরের ডাল তার যাত্রা শুরু করে গ্রীসে। তাও তেরো হাজার বছর পূর্বে। মসুরের ডাল মুখরোচক খাদ্য হওয়ার পাশাপাশি ও পুষ্টিকরও।
বাসাবাড়ি, হোটেল বা যেকোনো বিয়ের আসরে খেতে বসলে ডাল আইটেম থাকবেই। কাঁচা মরিচ ও ধনেপাতা কুঁচি দেয়া একবাটি মসুরের ডাল দুপুরের ভাতের তৃপ্তি বাড়িয়ে দেয়।
আজ আমরা মসুরের ডাল এর উপকারিতা এবং এটি সহজে কীভাবে চাষাবাদ করা যায় সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।
আমাদের বাংলাভূমি সাইটে নিয়মিতভাবে আমরা আপনাদের সাথে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করে থাকি। এর ফলে আপনারা জমি, শিক্ষা, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানলাভ করে থাকেন। জীবনের নানা প্রয়োজনের সময়ে এসকল তথ্য থেকে উপকৃত হয়ে থাকেন।
আজ আমরা আপনাদের সাথে মসুরের ডাল চাষ করা নিয়ে আলোচনা করবো। এতে করে আপনারা সহজেই মসুরের ডাল চাষ নিয়ে বিস্তারিত জানতে পারবেন। এটি আপনাদের মসুরের ডাল পারিবারিক চাহিদা মেটবে এবং চাষীরা আয় করার সুযোগ লাভ করবেন।
মসুরের ডালের উপকারিতা
লক্ষ্য করলে দেখবেন যেকোনো সুষম খাদ্যের তালিকায় মসুরের ডাল নিজের অবস্থান করে নিয়েছে। এই মসুরের ডাল শরীরে এনার্জি বাড়ানোর পাশাপাশি, শরীরকে বিভিন্ন ভয়াবহ রোগ থেকে বাঁচিয়ে রাখে।
মানুষের শরীরের প্রধান যন্ত্র হৃদপিণ্ড। হৃদপিণ্ড যতক্ষণ সচল ততক্ষণ আমরা বেঁচে থাকি। এই হৃদপিণ্ডের দেখাশোনা করে মসুরের ডাল। মসুরের ডাল রক্তের কোলেস্টেরল কমায়।
এতে রক্ত পাম্প করার সময় হৃদপিণ্ডকে বেশি কষ্ট পেতে হয় না। ফলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমে। আর মসুরের ডালে থাকা ম্যাগনেসিয়াম হার্টের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
কার্যক্ষমতা যত বাড়ে হার্টের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও তত বাড়ে। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য মসুরের ডাল আশীর্বাদ স্বরূপ। এটি রক্তের সুগার কমায়। ফলে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ থাকে না।
আর যারা অলরেডি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, নিয়মিত মসুরের ডাল খাওয়ার মাধ্যমে ইনসুলিন নেয়ার মাত্রা কমিয়ে আনা যায়। মসুরের ডাল খাদ্য হজমে সহায়তা করে। এতে পেটে গ্যাস, অম্বল হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে।
মসুরের ডালের এমন বহু উপকার আছে। সব নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব। চলুন জেনে আসি মসুরের ডালের চাষ পদ্ধতি। মসুরের ডাল চাষ করতে প্রথমে ডালের সঠিক বীজ নির্বাচন করতে হবে।
বীজ নির্বাচন
মসুরের ডালের জনপ্রিয় কয়েকটি জাত হচ্ছে- বারি মসুর-১, বারি মসুর-২, বারি মসুর-৩, বারি মসুর-৪। বারি মসুর-১ জাতটির বীজের আকার অন্যান্য জাতসমূহের চেয়ে একটু বড়।
আবার রান্নাও হতেও সময় অল্প নেয়। মাত্র ১০-১১ মিনিটের মাথায় রান্না হয়ে যায় এই ডাল। উক্ত জাতের বীজগুলো হেক্টর প্রতি ১.৫-১.৮ টন পর্যন্ত ফসল উৎপাদন করতে পারে।
আর এদের জীবনকাল দুইমাসের চেয়ে কিছু কম। অর্থাৎ ১১০ দিনের মাথায় ফসল সংগ্রহ করা যায়। বারি মসুর-৪ ডালের জাতটির বীজের রং লালচে বাদামি হয়।
জাতটি মরিচা ও স্টেমফাইলিয়াম ব্লাইট রোগ প্রতিরোধ করতে সক্ষম। ফলে ফলন ভালো পাওয়া যায়।
মাটি নির্বাচন
মসুরের ডাল চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী মাটি হচ্ছে বেলে দো-আঁশ মাটি। ডাল জাতীয় বেশিরভাগ ফসলই বেলে দোআঁশে ভালো ফলন দেয়।
তবে মসুরের ক্ষেত্রে অন্য কোনো মাটি খুব একটা ফলপ্রসূ নয়।
বীজ বপন
অক্টোবর মাসের শেষের দিকে অথবা নভেম্বরের শুরুর দিকে বীজ বপন করতে হয়। বীজ বপন করার সময় ছিটিয়ে অথবা সারি করে দুইভাবেই বীজ বপন করা যায়।
ছিটিয়ে করার সময় বীজ বাড়িয়ে দিতে হয়। আর সারি করে করতে চাইলে প্রতি সারির মাঝে ৩০ সেন্টিমিটারের দূরত্ব রাখতে হয়। প্রতি হেক্টরে ৩০-৩৫ কেজি বীজ লাগে।
সার প্রয়োগ
বীজ বপনের পর জমিতে সার প্রয়োগ করতে হবে।
প্রতি হেক্টর জমিতে ইউরিয়া ৪০-৫০ কেজি, টিএসপি ৮০-৯০ কেজি, এমওপি ৩০-৪০ কেজি প্রয়োগ করতে হবে।
আর অণুজীব সার, যা ফসলের শিকড়ে গুটি আকারে থাকে তা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মতো প্রয়োগ করতে হবে।
যদি জমিতে আগে মসুর চাষ করা না হয়ে থাকে, তবে সেখানে এক কেজি বীজের জন্য ৯০ গ্রাম হারে অণুজীব সার প্রয়োগ করতে হবে। সার ফসলের ফলন বাড়ায়। জমিকে ক্ষতিকর পোকামাকড় থেকে বাঁচিয়ে রাখে।
আগাছা দমন
বীজ বপনের মাসখানেক পর জমিতে নিড়ানি দিতে হবে। আগাছা জন্মালে সেসব পরিষ্কার করে ফেলতে হবে।
অতিরিক্ত আগাছা চারা গাছের বেড়ে ওঠায় সমস্যা সৃষ্টি করে। তাছাড়া পোকামাকড়ের বাসা বৃদ্ধি পায় এসবে।
সেচ
জমিতে রসের পরিমাণ কমলে জল প্রয়োগ করতে হবে। বৃষ্টির অতিরিক্ত জল জমে ফসলের যাতে ক্ষতি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাই অতিরিক্ত জল বের হয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
রোগ দমন
মসুর ডাল চাষের সময় গাছ ও ফসল যেসব রোগে আক্রান্ত হয়- মসুরের গাছের গোড়া পচা রোগ, মসুরের মরিচা রোগ, মসুরের স্টেমফাইলাম ব্লাইট রোগ।
গাছের পাতায় বিভিন্ন আকৃতির ছোট ছোট মরিচা রংয়ের গুটি দেখা দিলে বুঝতে হবে ওটা মরিচা রোগ। এসব গুটি পরে ল গাঢ় বাদামি ও কালো রং ধারণ করে। প্রতিকার করার জন্য টিল্ট-২৫০ ইসি বারো থেকে পনেরো দিন পর পর ২-৩ বার করে স্প্রে করতে হবে।
সবচেয়ে ভালো হয় বারি মসুর-৩ ও বারি মসুর-৪ চাষ করা। এরা মরিচা রোগ প্রতিরোধক জাত। মাটি ভিজা থাকলে গাছের গোড়ায় ছত্রাকের সাদা মাইসেলিয়াম ও সরিষার দানার ন্যায় স্কেলেরোসিয়াম গুটি দেখা যায়।
যার ফলে গাছ হলদে রং ধারণ করে এবং ফসলের গোড়া পচে যায়। জমিতে জলাবদ্ধতা বন্ধ করে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। আর ফসলের গাছের পাতায় যদি সাদা ছত্রাকের জালিকা দেখা যায়, বুঝতে হবে ওটা স্টেমফাইলাম ব্লাইট রোগের কারণে।
রোভরাল-৫০ ডব্লিউপি নামক ছত্রাকনাশক ১০ দিন পরপর ২-৩ বার সেপ্র করলে এই রোগের আক্রমণ কমবে।
ফসল সংগ্রহ ও গুদামজাত
মার্চ মাসে ফসল সংগ্রহ করে ফেলতে হবে। আর তা যথাযথ গুদামজাত করতে হবে। গুদামে রাখার পরও ফসল ভিন্ন পোকামাকড়ের আক্রমণের শিকার হয়।
গুদামজাত করার ক্ষেত্রে ফসল রোদে শুকিয়ে তার আর্দ্রতা কমিয়ে ফেলতে হবে। প্রতি টন ফসলের জন্য ৩০০ গ্রাম ম্যালাথিয়ন বা সেভিন ১০% গুড়া মিশিয়ে দিতে হবে।
এতে পোকার আক্রমণ প্রতিরোদ হবে। আর বীজের জন্য ফসল সংরক্ষণ করতে চাইলে তা টিনের পাত্র বা পলিথিনসহ চটের ব্যাগ অথবা আলকাতরার প্রলেপ দেওয়া মাটির পাত্রে বীজ সংরক্ষণ করতে হবে।
মসুরের ডালের চাষ আমাদের পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি, দেশের অর্থনীতিতেও ভূমিকা পালন করবে।
আজ আমরা মসুর ডাল চাষ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলাম। আগামীতে আপনাদের সাথে মসুর ডাল চাষ নিয়ে আরো কিছু আলোচনা করবো, তাই আমাদের পেজে নিয়মিত চোখ রাখুন। এই লেখাটি অনেকের কাজে লাগতে পারে তাই লেখাটি যতটুকু সম্ভব শেয়ার করুন, যাতে করে অনেকে এই লেখা থেকে শিক্ষা নিয়ে মসুর ডাল চাষ করে আয় করার ব্যবস্থা করতে পারে।