Legal Procedures of Divorce in Bengali: বিবাহবিচ্ছেদ (ডিভোর্স) শব্দটি শুনতে ভাল না হলেও বিবাহ যদি সুখের না হয় সেক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদেই রুপ নেয় সম্পর্ক।
ভারতে বিবাহবিচ্ছেদের প্রক্রিয়া বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদনের ফাইলিং থেকে শুরু হয়ে তালাকের চূড়ান্ত আদেশের ঘোষণার সাথে শেষ হয়।
ডিভোর্সের পদ্ধতি টি ছয়টি ধাপে বিভক্ত যা হ’ল – পিটিশন দাখিল করা, সমন পেশ করা, প্রতিক্রিয়া, বিচার, অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ এবং চূড়ান্ত আদেশ।
বিচ্ছেদ একটি আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুরু হয়ে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই শেষ হয়ে থাকে।
সুপ্রিয় পাঠক, আমাদের আজকের আয়োজনে থাকছে ভারতে ডিভোর্সের আইনি প্রক্রিয়া এবং ডিভোর্সের ধরন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য। চলুন দেরী না করে মূল আলোচনায় যাওয়া যাক।
ভারতে ডিভোর্সের আইনি পদ্ধতি এবং প্রকারভেদ:-
বিবাহবিচ্ছেদ কি?
ডিভোর্সের আইন অনুযায়ী আদালতে একটি পিটিশন দাখিল করে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বৈবাহিক সম্পর্কেই ইতি ঘটানোকে বিবাহবিচ্ছেদ বলে।
যখন কোনও আদালত বিবাহবিচ্ছেদের ডিক্রি পাস করে, তখন এটি স্বামী বা স্ত্রীর বৈবাহিক চুক্তির অবসান ঘটায় এবং স্বামী স্ত্রীর মধ্যে আর কোন সম্পর্ক থাকেনা।
স্বামী ও স্ত্রীকে পৃথক করার পাশাপাশি সম্পত্তির বিভাজন, সম্পদ এবং সন্তানের কাস্টডি বা অভিভাবকত্বের বিষয়টিও জড়িত। ভারতে ডিভোর্সের পদ্ধতি এবং আইন ও ধর্ম অনুযায়ী আলাদা হয়ে থাকে।
বিচ্ছেদের কারণ এবং ধরণ অনুযায়ী বিচ্ছেদের প্রক্রিয়াতে কিছু পরিবর্তন দেখা যায়।
ভারতে বিবাহবিচ্ছেদের ধরন
পারস্পরিক বিবাহবিচ্ছেদ– হিন্দু বিবাহ আইন অনুসারে পারস্পরিক বিবাহবিচ্ছেদটি ধারা ১৩-বি দ্বারা পরিচালিত হয়। নামটি থেকে বোঝা যায়, পারস্পরিক বিবাহবিচ্ছেদে উভয় পক্ষ অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে দুজন একমত হন এবং শান্তিপূর্ণভাবে পৃথক হওয়ার বিষয়ে তাদের সম্মতি প্রকাশ করেন।
স্বামী ও স্ত্রীকে একমত হয়ে তাদের সম্পর্কের গোপনীয়তা এবং শিশুর কাস্টডি সম্পর্কিত বিষয়গুলির পূর্ব নির্ধারণ করে থাকেন। পারস্পরিক বিবাহবিচ্ছেদ করার জন্য কেবল দুটি বিষয়ের প্রয়োজন হয়, একটি হল পারস্পরিক সম্মতি এবং অন্যটি হল বিচ্ছেদের পূর্বে তাদের কমপক্ষে এক বছরের জন্য আলাদা থাকতে হবে।
কনটেস্টেড বিবাহবিচ্ছেদ– স্বামী স্ত্রী যেকোনো একজন যদি বিবাহবিচ্ছেদ করতে জোর করেন তো সেক্ষেত্রে এই ধরনের বিচ্ছেদকে বলা হয় কনটেস্টেড বা প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ বিবাহ বিচ্ছেদ বলা হয়ে থাকে।
হিন্দু বিবাহ আইন, ১৯৫৫ এর ১৩ অনুচ্ছেদে এই জাতীয় একপক্ষীয় বিচ্ছেদের প্রচেষ্টা। তবে যেহেতু একপক্ষ বিচ্ছেদের জন্য আদালতে ফাইল পেশ করে, যার জন্য সকল তথ্য-প্রমাণ এবং বিচ্ছেদের উপযুক্ত কারণ আদালতে পেশ করতে হয়।
বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে নিষ্ঠুরতা, ধর্মান্তরিত হতে জোর করা, নিরপেক্ষতার অভাব, সংক্রামক রোগ অথবা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সাত বছরেরও বেশি সময় সম্পর্ক বা দেখা না হলে এক পক্ষ বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করতে পারবে।
অপরিবর্তনীয় বিচ্ছেদ- অপরিবর্তনীয় বিবাহ বিচ্ছেদের সহজ অর্থ হ’ল স্বামী, স্ত্রী যখন একসাথে সুখে এবং স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারছেন না, যখন সম্পর্কটি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যায় যেখান থেকে বিবাহবন্ধন টিকিয়ে রাখা অসম্ভব, তখনকার এই অবস্থাকে বিবাহের অপরিবর্তনীয় বিচ্ছেদ বলা হয়।
এই অবস্থায় স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে কোনও স্নেহ, ভালবাসা থাকেনা, দম্পতিরা পৃথকভাবে জীবনযাপন করে থাকেন, প্রায়ই ঝগড়া হয়, স্বামী, স্ত্রীর মধ্যে যে কোনও একজনের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক থাকে যার ফলে বিয়ে টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
বিবাহবিচ্ছেদের কারণসমূহ
বিবাহের মত বৈধ, সামাজিক চুক্তিবদ্ধ সম্পর্ক কোন তুচ্ছ কারণে সাধারণত ভেঙে যায়না। এর পেছনে থাকে গুরুতর কারণসমূহ।
এই কারণের মধ্যে রয়েছে পরকীয়া ও ব্যভিচার – এটি একটি ফৌজদারি অপরাধ যেখানে বিবাহবন্ধনের বাইরে স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে কোন একজনের অন্য কারো সাথে বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক থাকে।
নিষ্ঠুরতা- এটি একটি ইচ্ছাকৃত গর্হিত কাজ,যখন স্বামী বা স্ত্রী একজন আরেকজনের উপর নির্যাতন চালায়, যার মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ, জীবন বা মানসিক স্বাস্থ্য হুমকির সম্মুখীন হয়, তখন সেটা নিষ্ঠুরতা।
এর মধ্যে মানসিক বা শারীরিকভাবে ব্যথা, গালি দেওয়া, নির্যাতন করা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। আর এরকম ঘটনার জন্য দম্পতিরা বিচ্ছেদের মত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
আলাদা থাকা- যখন কোনও স্বামী স্ত্রী ফিরে আসার কোনও উদ্দেশ্য ছাড়াই ইচ্ছাকৃতভাবে একে অন্যকে ত্যাগ করে, তখন এটাকে আলাদা থাকা বা সেপারেশন বলে। দুই বছরেরও বেশি সময় আলাদা থাকা, কোন যোগাযোগ না থাকার জন্য বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেওয়া বৈধ।
ধর্মান্তরিত করা- হিন্দু বিবাহে স্বামী, স্ত্রী এর মধ্যে যদি কেউ হিন্দু না থাকে আর একজন আরেকজনকে ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে তবে তা বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হিসেবে গণ্য হবে।
মানসিক ব্যাধি – মানসিক ব্যাধি, মনের অস্থিরতা, মানসিক অসুস্থতা বা এই জাতীয় মানসিক ব্যাধি যদি স্বামী বা,স্ত্রী কারো থেকে থাকে, এবং তা তাদের দাম্পত্য জীবনকে অস্বাভাবিক ও আক্রমণাত্মক করে তোলে, তবে এর জন্য বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
সংক্রামক রোগ- কুষ্ঠ একটি সংক্রামক এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগ যা চামড়া ও স্নায়ুর ক্ষত সৃষ্টি করে। এরকম কোন সংক্রামক, ভয়াবহ ছোঁয়াচে রোগ স্বামী বা স্ত্রী কারো থাকলে, এবং তা থেকে রোগ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকলে এর জন্য বিবাহ বিচ্ছদের সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
নিরুদ্দেশ থাকা- স্বামী বা স্ত্রী যদি এক নাগাড়ে ৭ বছর একে অন্যের থেকে নিরুদ্দেশ থাকে তবে তাদের মধ্যে ধর্মমতে সম্পর্ক থাকেনা। এজন্য তারা যদি তখন চায় তবে আদালতে বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করতে পারেন।
বিবাহবিচ্ছেদের আইনি প্রক্রিয়া
হিন্দু বিবাহ আইন, ১৯৫৫ এর ১৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে, বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন স্থানীয় সীমার মধ্যে জেলা আদালতে দাখিল করতে হবে, যা সাধারণ নাগরিকদের আইনি অধিকার।
তবে এক্ষেত্রে কিছু বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। যেমন বিবাহটি ভারতীয় আইন মেনে রেজিষ্ট্রি করা হয়েছিল, উভয়পক্ষে সাক্ষীগণ উপস্থিত ছিলেন।
বিচ্ছেদের আবেদনের পূর্বে তাদের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা হয়েছিল এবং বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে স্বীকৃত কারণগুলো ঘটেছিল যার জন্য উক্ত দম্পতির পক্ষে আর একসাথে থাকা সম্ভব নয়।
এই বিষয়গুলো ঘটে থাকলে স্বামী বা স্ত্রী যেকোন একজন আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে ডিভোর্সের জন্য মামলা করবেন। আদালত সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ পর্যালোচনা করে স্বামী-স্ত্রীকে নিজেদের মধ্যে মীমাংসার জন্য ৬ মাস সময় দেবে।
যাতে এরমধ্যে তারা নিজেদের মধ্যকার ঝামেলা মেটানোর চেষ্টা করে। এই ৬ মাসেও যদি মিল না হয় তবে আদালত ডিভোর্সের পক্ষে চূড়ান্ত আদেশ জারি করে এবং বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ হয়।
শেষ কথা
বিবাহবিচ্ছেদ তখনই ঘটে যখন স্বামী-স্ত্রী আর নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার মত কোন আশা দেখতে না পায়। অশান্তি করে এক ছাদের নিচে না থেকে তাই বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেওয়াই উত্তম।
আদালতে বিচ্ছেদের নোটিশ পাঠানোর পর বিচ্ছেদের কারণ যাচাই করে তারপর আদালত ৬ মাসের সুযোগ দেয় যাতে দাম্পত্য কলহ মিটিয়ে নেওয়া যায়। এরপরেও পরিস্থিতি একই থাকলে চূড়ান্তভাবে বিচ্ছেদের আদেশ জারি করা হয়।
এভাবেই বিচ্ছেদের আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। আশা করি ভারতে বিচ্ছেদের আইনি প্রক্রিয়া ও কারণসমূহ জানানোর প্রচেষ্টা সফল হয়েছে।
সুপ্রিয় পাঠক পোস্টটি পড়ে আপনাদের মতামত জানাতে ভুলবেন না। এরপর কোন বিষয় নিয়ে জানতে চান তা আমাদের কমেন্ট করে জানান। আমরা পরবর্তীতে সে বিষয়ে তথ্য নিয়ে হাজির হব। আজকের মত এখানেই শেষ করছি।
ধন্যবাদ সবাইকে।