জ্বালামুখী শক্তিপীঠ: যেখানে সতীর জিহ্বা পতিত হয়েছিল, জ্বলন্ত অগ্নিশিখা

(Jwalamukhi Shakti Peeth in Bengali) জ্বালামুখী শক্তিপীঠের বর্তমান অবস্থান কোন স্থানে? দেবী সতীর কোন অঙ্গ এখানে পতিত হয়েছে? জ্বালামুখী শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী কি? কিভাবে আরাধনা করা হয়? এই মন্দিরের তাৎপর্য কি? জানুন সবকিছু বিস্তারিত।

জ্বালামুখী সতী পীঠ: সতীর দেহর ৫১ টি খন্ড বিখন্ড অংশগুলি ভারতের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে পড়ে, তা ছাড়াও ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল। আর যেখানে যেখানে পড়েছিল সেখানে সেখানে গড়ে উঠেছে এক একটি সতীপীঠ। জ্বালামুখী সতী পীঠের মন্দিরটি ভারতের হিমাচল প্রদেশ রাজ্যের কাংড়া উপত্যকায় অবস্থিত।

৫১ টি সতী পিঠের মধ্যে এটি একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ শক্তিপীঠ, পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এখানে সতীর জিহ্বা অথবা জীভ পতিত হয়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী অম্বিকা এবং ভৈরব হলেন উন্মত্ত।

Jwalamukhi Shakti Peeth in Bengali - জ্বালামুখী শক্তিপীঠ
Jwalamukhi Shakti Peeth in Bengali – জ্বালামুখী শক্তিপীঠ

আবার এখানে দেবী অম্বিকা কে অনেকেই সিদ্ধিদা বলেও চিনে থাকবেন। জালামুখী সতী পীঠে সর্বদাই সাতটি জ্বলন্ত অগ্নিশিখা দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে। যে ৭ টি জলন্ত অগ্নি শিখাকে দেবী অম্বিকা রূপে পূজা করে থাকেন ভক্তরা।

সতীর মৃতদেহ দেখে উন্মাদে পরিণত হয়েছিলেন মহাদেব। আর কাঁধে করে দেবীর দেহকে তুলে নিয়ে তান্ডব নৃত্য শুরু করেন। এর ফলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দিয়ে মাতার সতীর দেহটি ৫১ টি খন্ডে বিভক্ত করে দেন।

আর এই খন্ড গুলি যেখানে যেখানে পড়েছিল সেখানে সেখানে তৈরি হয়েছে এক একটি সতী পীঠ। সেই রকম ভাবেই সতীর জিহ্বা ভূপতিত হয়ে জন্ম হয়েছে এই জ্বালামুখী সতীপীঠ অথবা জ্বালামুখী শক্তি পীঠের।

জ্বালামুখী শক্তিপীঠ:

শক্তিপীঠের নাম জ্বালামুখী শক্তিপীঠ
স্থান জ্বালামুখী, কাঙ্গড়া, হিমাচল প্রদেশ
দেশ ভারত
দেবীর অংশ জিহ্বা
শক্তির নাম সিদ্ধিদা (অম্বিকা)

জ্বালামুখী শক্তি পীঠের ভৌগোলিক গুরুত্ব ও ইতিহাস:

জ্বালামুখী শক্তি পীঠের ভৌগোলিক গুরুত্ব অনুসারে জানা যায় যে, হিমাচল প্রদেশের কাংড়া উপত্যকা থেকে প্রায় 30 মাইল দক্ষিনে সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় দুই হাজার (২,০০০) মিটার উচ্চতায় এই শক্তিপীঠ অবস্থিত। সতী দেবী এখানে ভক্তদের কাছে নানা রকম নামে পরিচিত, যেমন:- সিদ্ধিদা, লণ্ঠনওয়ালি মাঈ, জ্বালাদেবী, ইত্যাদি।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, কাংড়ার রাজা ভূমিচাঁদ কাতোচ ছিলেন দেবী দুর্গার ভক্ত। তিনিই প্রথম স্বপ্নে আগুনের শিখাযুক্ত পবিত্র এই জায়গাটির দর্শন পান এবং তার সাথে সাথে মায়ের অস্তিত্বও অনুভব করেছিলেন। তারপরে তিনি এই জায়গাটি খুঁজে বের করেন আর এখানে মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি নিজেই।

এছাড়া দেখা যায় মন্দিরের সামনে একটি ছোট নাট মন্দির আছে, যেখানে নেপালের রাজার দেওয়া অসংখ্য ঘন্টা ঝুলানো আছে। মন্দিরের উত্তর দিকে দেয়ালে দেখা যায় দেবী অম্বিকার প্রতীক রুপি এক অনির্বাণ দিব্য অগ্নিশিখা। যা কিনা কখনো নেভে না, এমনটাই জানা গিয়েছে ইতিহাস অনুসারে।

আবার মূল অগ্নিশিখা ছাড়াও আরো ছয়টি অগ্নিশিখা দেখা যায় এই মন্দিরের মধ্যেই। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী মানুষ বিশ্বাস করেন আজও যে এই সাতটি অগ্নিশিখা আসলে দেবীর সাতটি রূপ। দেবীর এই ৭ টি রূপ হল করালি, কালি, মনোজবা, সুলোহিতা, সুধম্রবর্ণা, স্ফুলিঙ্গিনী ও বিশ্বরূপা।

জ্বালামুখী শক্তি পীঠ এর ইতিহাস:

জ্বালামুখী সতি পীঠ এই মন্দির নিয়ে রয়েছে অনেক পৌরাণিক কাহিনী ও ইতিহাস। ইতিহাসের পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে অনেক কাহিনী। ইতিহাস অনুযায়ী সম্রাট আকবর নাকি একবার কোন এক বদমাশ লোকের বুদ্ধিতে দেবীর মাহাত্ম্য প্রমাণ করার জন্য মন্দিরের কাছাকাছি এক ঝরনার বাঁক মন্দিরের দিকে ঘুরিয়ে দেন, যাতে অগ্নিশিখা গুলি নিভে যায়, কিন্তু তারপরেও জলের সংস্পর্শে এসেও সেই অগ্নিশিখা না নেভায় আকবর দেবীর মাহাত্ম্য বুঝতে পারেন।

পরবর্তীতে দেবীর কাছে মানসিকভাবে আত্মনিবেদন করে দেবীর জন্য তামার উপর সোনার প্রলেপ দেওয়া ছাতা তৈরি করিয়ে দেন তিনি এবং তার পাশাপাশি তিনিই কিন্তু মন্দিরের চূড়াটি সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দিয়েছিলেন।

এরপর ১৮০৯ সালে মহারাজ রঞ্জিত সিংহ এই মন্দির পরিদর্শন করেন। তার ছেলে খরক সিং মন্দিরে একজোড়া ভাঁজ করা রুপার দরজা নির্মাণ করেছিলেন। এ ছাড়া ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী জানা যায় যে, ফিরোজ তুঘলক এই মন্দির ধ্বংস করতে সচেষ্ট হলে বহু মৌমাছি এসে তাকে ও তার সৈন্যদের কে আক্রমণ করে এবং সেই আক্রমণের ফলে মন্দির ধ্বংস করার কাজ থেকে তারা বিরত হন, আর ফিরে যেতে বাধ্য হন।

জ্বালামুখী সতীপীঠ এর মাহাত্ম্য:

জ্বালামুখীর এই মন্দিরটি সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় দুই হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত। যেখানে পৌছাতে গেলে অনেকটাই দুর্গম পথ পেরিয়ে যেতে হয়। পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত এই মন্দিরটি দক্ষিণদ্বারী অর্থাৎ এই মন্দিরের দরজা দক্ষিণমুখী।

মন্দিরের চূড়া গম্বুজ আকৃতির এবং সেটি সম্পূর্ণ সোনা দিয়ে মোড়া। মন্দিরে দেবীর কোন রকম মূর্তি নেই, তবে পাথরের ফাটল দিয়ে অগ্নিশিখা বেরোতে দেখা যায়। আর মনে করা হয় যে এই জায়গাতেই সতী দেবীর জিহ্বা পড়েছিল।

মূর্তির বদলে এই অগ্নিশিখা গুলিকেই দেবী রূপে পূজা করা হয়। তাছাড়া সাতটি অগ্নিশিখা দেখা গেলেও কোন কোন সময় ৯ টি অগ্নিশিখা ও দেখা গিয়েছে এমন টাই বলেছেন অনেকেই। তবে এমনটা কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ঘটে, নয়টি অগ্নি শিখার আলাদা আলাদা নামকরণও করা হয়েছে।

তো চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক সেই ৯ টি অগ্নিশিখার আলাদা আলাদা নাম গুলি সম্পর্কে:

১) মহাকালী, ২) চন্ডী, ৩) হিংলাজ মাতা, ৪) ঊনপূর্ণা, ৫) বিন্ধ্যবাসিনী, ৬) সরস্বতী, ৭) মহালক্ষী, ৮) অঞ্জি দেবী, ৯) অম্বিকা।

এছাড়া অনেকের মত অনুসারে জানা যায় যে, জ্বালামুখী মন্দিরের সাতটি মূল অগ্নিশিখা হল:- 

১) কালী, ২) করালি, ৩) মনোজবা, ৪) সুধূম্রবর্ণা, ৫) সুলোহিতা, ৬) স্ফুলিঙ্গিনি, এবং ৭) বিশ্বরূপা।

তবে পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, বহু প্রাচীনকাল আগে এই হিমালয় পর্বতে রাক্ষসদের বসবাস ছিল, আর তারা দেবতাদের উপরে অনেক অত্যাচার চালাত।

জ্বালামুখী সতীপীঠের পৌরাণিক কাহিনী:

বহু প্রাচীনকাল আগে এই হিমালয় পর্বতে অসুর দের বসবাস থাকা কালীন তারা দেহতাদের উপরে অনেক অন্যায় অত্যাচার চালিয়ে যেতো নির্বিচারে। দেবতারা শ্রীবিষ্ণুর তপস্যা করে রাক্ষসদের ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেন। হিমালয়  পর্বতে অবস্থিত এই অগ্নিকুণ্ড থেকে মা আদ্যাশক্তির সৃষ্টি হয়।

আর এই নয়টি আগুনের শিখার মধ্যে এক একটিকে বিশেষভাবে পূজা করা হয়। পাহাড়ের মাঝখানে অবস্থিত এই অগ্নিশিখা গুলি খুবই শক্তিশালী বলে বিশ্বাস করেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। মন্দিরের মাঝে একটি কুণ্ড ও অবস্থিত রয়েছে। এই কুণ্ডের মাঝেই ভক্তরা পূজা ও হোম- যজ্ঞ করে থাকেন।

তবে যেটা জানা যায় সেটা হল মন্দিরের উত্তর দিকের দেওয়ালে যে জ্যোতি শিখা দেখা যায়, সেটি হলো আদি অগ্নিশিখা, রুপার সিংহাসন বসানো হয়েছে। এই জায়গা টিকেই বলা হয় দেবীর প্রধান গদি অথবা আসন।

যারা দেবীর পুষ্পাঞ্জলি দেন, তারা এই সিংহাসনের সামনেই পুষ্পাঞ্জলি নিবেদন করেন। দেবীকে রাবড়ি, দুধ, মিছরি, প্যাড়া, বিভিন্ন ধরনের ফল ইত্যাদি ভোগ হিসাবে নিবেদন করা হয়ে থাকে।

প্রত্যেকটি সতীপীঠ অথবা শক্তি পীঠে দেবী এবং ভৈরব উপস্থিত থাকেন, দেবী হলেন সতীর রূপ আর ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী। এছাড়া আমরা সকলেই জানি যে, জ্বালামুখী সতীপীঠে দেবী হলেন অম্বিকা অর্থাৎ সিদ্ধিদা এবং ভৈরব হলেন উন্মত্ত।

আবার নবরাত্রি ও শিবরাত্রির সময় এই মন্দিরে বেশ জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে বিশেষ উৎসব পালন করা হয়, আর এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বিশাল বড় মেলা বসে। যেখানে স্থানীয় মানুষজন খুবই আনন্দ উপভোগ করে থাকেন।

এছাড়াও সারা বছর এখানে ভক্তদের আনাগোনা প্রায় লেগেই রয়েছে। তাই আপনিও যদি এমন কোন তীর্থস্থানে ভ্রমণ করতে চান, তাহলে অনায়াসেই যেতে পারেন। যেখানে নিজের দুই চক্ষুকে সার্থক করে আসতে পারেন, এই জ্বালামুখী সতীপীঠের অগ্নিশিখা দর্শন করে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top