জলন্ধর শক্তিপীঠ: যেখানে সতীর ডান বক্ষ (স্তন) পতিত হয়েছিল, ইতিহাস জানুন

(Jalandhar Shakti Peeth in Bengali) জলন্ধর শক্তিপীঠের বর্তমান অবস্থান কোন স্থানে? দেবী সতীর কোন অঙ্গ এখানে পতিত হয়েছে? জলন্ধর শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী কি? কিভাবে আরাধনা করা হয়? এই মন্দিরের তাৎপর্য কি? জানুন সবকিছু বিস্তারিত।

সতী পার্বতীর মৃত দেহটি ৫১ টি খন্ডে বিভক্ত করা হয়েছিল, যখন তিনি স্ডানীর অপমান সহ্য করতে না পেরে নিজের প্রাণ ত্যাগ করেন এবং তার সাথে সাথে সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে তান্ডব লীলায় মেতে উঠেছিলেন স্বয়ং মহাদেব।

Jalandhar Shakti Peeth in Bengali - জলন্ধর শক্তিপীঠ
Jalandhar Shakti Peeth in Bengali – জলন্ধর শক্তিপীঠ

মহাদেবকে শান্ত করতে না পেরে বিশ্বসংসার ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মুখে পতিত হয়। কোনরকম উপায় না দেখে শ্রী বিষ্ণু সুদর্শন চক্রের সাহায্যে সতী দেবীর দেহ খন্ড-বিখন্ড করে দেন, যাতে দেবাদীদেব মহাদেব শান্ত হতে পারেন।

জলন্ধর শক্তিপীঠ:

শক্তিপীঠের নাম জলন্ধর শক্তিপীঠ
স্থান জলন্ধর, পাঞ্জাব
দেশ ভারত
দেবীর অংশ ডান বক্ষ (স্তন)
শক্তির নাম ত্রিপুরমালিনী

জলন্ধর শক্তি পীঠের ভৌগলিক গুরুত্ব:

সেই দেহখন্ড গুলি বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল। পৃথিবীর বুকে পড়া মাত্রই প্রস্তর খণ্ডে পরিণত হয় সতীর দেহের খন্ড-বিখন্ড অংশ গুলি। আর সেই বিশেষ বিশেষ স্থান গুলি পরিণত হয় এক একটি সতী পীঠে।

এমন করে ৫১ টি সতীপীঠ গড়ে উঠেছে, প্রত্যেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী দের কাছে খুবই পবিত্র জায়গা গুলি। সতীর এই ৫১ টি শক্তিপীঠের মধ্যে অন্যতম সতী পীঠ হল জলন্ধর শক্তিপীঠ অথবা ত্রিপুর মালিনী শক্তিপীঠ যেটা ভারতের পাঞ্জাবে অবস্থিত।

পাঞ্জাবের জলন্ধর স্টেশনের থেকে দেবী তলব এর দিকে গেলে এই তীর্থস্থান দেখতে পাওয়া যায়। এখানে দেবীর ডান স্তন পতিত হয়েছিল। দেবীর নাম এখানে ত্রিপুর মালিনী আর ভৈরব হলেন ভীষণ। আর সেই কারণে দেবীর নাম অনুসারে এই শক্তি পীঠের নাম ত্রিপুরমালিনী শক্তি পীঠ।

জলন্ধর শক্তি পীঠের ইতিহাস: 

এই শক্তিপীঠ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তার নতুন করে বলার কিছু নেই। এখানে একটা বড় আকারের কুয়া আছে, যার বয়স এই মন্দিরের বয়সেরই সমান। তাই এই মন্দিরকে তলব মন্দিরও বলা হয়। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রের দ্বারা দেবীর দেহ খন্ড-বিখন্ড হওয়ার সময়ে এই জলন্ধরে পড়েছিল দেবীর ডান স্তন।

আবার অন্যদিকে দেখা যায় কালিকাপুরাণ মতে জলন্ধরেই দেবীর দুটি স্তনই পড়েছিল। এই সতী পীঠে দেবী পূজিত হন ত্রিপুর মালিনি রূপে, আর দেবীর ভৈরব হলেন ভীষণ আবার অন্য মত অনুসারে জানা যায় যে, এই সতী পীঠে দেবীর নাম বিশ্বমুখ

জলন্ধর শক্তি পীঠের পৌরাণিক কাহিনী:

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, বহু কাল আগে জলন্ধর নামে এক অসুর ছিল। আর তার স্ত্রীর নাম ছিল বৃন্দাদুতি। জানা যায় যে, এই অসুর ব্রহ্মার কাছে যে বর পায়, সেই বর অনুসারে যতদিন তার স্ত্রীর সতীত্ব অক্ষুন্ন থাকবে ততদিন তার মৃত্যু হবে না।

আর এই ভাবেই সেই অসুর স্ত্রীর সতীত্বের জোরে স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল দখল করে নেয়। এরপর একদিন নারদ মুনির মুখে দেবী পার্বতীর রূপের বর্ণনা শুনে দেবিকে প্রাপ্তির আশায় কৈলাস আক্রমণ করে বসে সেই অসুর জলন্ধর।

কৈলাসে শিব আর অসুর সৈনদের মধ্যে মহা যুদ্ধের সময় যখন বৃন্দার সতীত্বের তেজ জলন্ধরের প্রাণ রক্ষা করছিল, সেই সময় কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, ভগবান বিষ্ণু জলন্ধর অসুরের রুপ ধরে বৃন্দার সতীত্ব ভঙ্গ করার পরই ত্রিশুলে জলন্ধর অসুরের মস্তক ছিন্ন করে তাকে বধ করেন শিব।

তারপর আর কি সম্পূর্ণ বিষয়টা জানার পর ভগবান বিষ্ণুকে শিলা হবার অভিশাপ দেন বৃন্দা, আর নিজের দেহ ত্যাগ করে পর জন্মে তুলসী দেবী রূপে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আবার অন্য আরেকটি কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, ভগবান বিষ্ণু দেব শিল্পী বিশ্বকর্মা কে দিয়ে জলন্ধর অসুরের মৃত মায়াবী শরীর গঠন করে বৃন্দাকে দেখালে বিধবা হয়েছে ভেবে, শাঁখা সিঁদুর পরিত্যাগ করে সতী ধর্ম বিসর্জন করেন।

আর তারপরে জলন্ধর অসুরের বধ করা হয়। যদিও এ বিষয়ে আরো অনেক কাহিনী রয়েছে, তাদের সঠিক কাহিনী নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে।

অনেক গুলি কাহিনীর মধ্যে গণেশ পুরান মতে জানা যায় যে, একসময় তুলসী দেবী গনেশকে বিবাহ করার জন্য সব সময়ের জন্য বাধ্য করতেন, থাকলে গণেশের অভিশাপে অসুর কুলে জন্ম হয় তুলসী দেবীর, আর অন্যদিকে ভগবান বিষ্ণুকে বৃন্দা অভিশাপ দেওয়ার পর অভিশাপ ফিরিয়ে নিলে আংশিক রূপে শিলাতে পরিণত হন ভগবান বিষ্ণু, সেই কারণেই তাকে বলা হয় শালগ্রাম শিলা। যে শালগ্রাম শিলা অনেকের মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।

জলন্ধর সতী পীঠ এর মাহাত্ম্য:

এইসব কাহিনী অনুসারে এর পরে যা ঘটেছিল তা এই সতী পীঠের সাথে বিশেষভাবে জড়িত। কাহিনী অনুসারে জানা যায়, এই ত্রিপুর মালিনী শক্তি পীঠে সমাধি দেওয়া হয়েছিল জলন্ধর অসুর কে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান মতে জানা যায়, সমাধী দেওয়ার সময় জলন্ধর অসুরের মাথা ছিল বিপাশা নদীর উত্তর দিকে, মুখ ছিল জ্বালামুখী শক্তি পীঠের দিকে।

শতুদ্র ও বিপাশা নদীর মধ্যে ছিল অসুরের পিঠ। ত্রিপুর মালিনি দেবীর মন্দির অনেক খানি সুন্দর, বলতে গেলে চোখ জুড়ানো মন্দির। মন্দিরের প্রবেশ পথে রয়েছে একটি কুণ্ড।

এর পাশাপাশি এই শক্তি পীঠে অবস্থিত মা বৈষ্ণবী দেবীর মন্দির। সামনে রয়েছে দেবী ত্রিপুর মালিনীর মন্দির, মন্দিরের ডান পাশে রয়েছে ভৈরব মন্দির। স্থানীয় মানুষজনরা এই ভৈরবকে কাল ভৈরব বলেও ডাকেন। মন্দিরে নিয়ম রয়েছে যে, একটি করে প্রদীপ সকলকেই জ্বালাতে হয়।

মন্দিরের গর্ভে রয়েছে লক্ষী, সরস্বতী, মা বৈষ্ণবদেবীর তিনটি মূর্তি। এর পাশাপাশি মন্দিরের পাশে ঢাকা একটা ঘরে মায়ের শয্যা স্থান রয়েছে, অর্থাৎ মায়ের বিছানা সাজানো রয়েছে। লোকোমুখি শোনা কথা অনুসারে জানা যায় যে, দুপুরের ভোগ গ্রহণ করার পর সেই বিছানাতে বিশ্রাম গ্রহণ করেন সতী দেবী।

শক্তি পীঠের কাহিনী গুলি সত্যিই মনমুগ্ধকর। শোনা মাত্রই মনে হয় এক ছুটে সেখানে গিয়ে দর্শন করে আসি। চোখ জুড়ানো মন্দিরের পরিবেশ, শক্তি পীঠের দর্শন, সবকিছু মিলিয়ে জীবন যেন সার্থক হয়ে যায়। তবে আপনিও যদি মনে করেন যে এমন তীর্থ স্থানে গিয়ে জীবনের কিছুটা সময় কাটাবেন, তাহলে অনায়াসেই যেতে পারেন। কেননা এমন জায়গায় আপনি স্বর্গসুখও অনুভব করতে পারেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top