যান্ত্রিক জীবনের কচকচানিতে হয়রান!একটু শান্তিতে ছুটি কাটাতে চাইলে কলকাতার কাছেই রয়েছে গ্রাম্য পরিবেশে ঘেরা একটি ইতিহাসের ছাপ সমৃদ্ধ রাজবাড়ি।
রাজকীয় আদব কায়দায় থাকতে কার না ভালো লাগে? হ্যাঁ রাজবাড়ি তে পুরনো থামের গন্ধ অন্দরমহল এলাহী খাওয়া দাওয়া, একদিন/দু’দিনে উপভোগ করুন রাজবাড়ির পরিবেশ। অথবা বাইরের পরিবেশ ও ঠাকুরদালানের সৌন্দর্য দেখে দিনের দিন ফিরে আসতে পারবেন।
কলকাতা থেকে ৬৬ কিলোমিটার দূরে হুগলি খন্যানে অবস্থিত ইটাচুনা রাজবাড়ি এখন বেশ জনপ্রিয় ভ্রমণ প্রেমীদের কাছে।ইটাচুনা হুগলী জেলার একটি গ্রাম।
ইতিহাস:
ফিরে দেখা যাক ইতিহাসের দিকে।মধ্য অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলায় মরাঠি বর্গীদের মুহুর্মুহু আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তখনকার বাংলার শাসক নবাব আলীবর্দী খাঁন।
১৭ শতকের সময়ের কথা যখন মারাঠা কতৃর্ক বর্গীরা বাংলা আক্রমণ করে।১৭৪২ সালে বাংলার জমি ও করের দাবিতে এই আক্রমণ হয়। তারপর এরা এখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে, এখানকার ভাষা আদব কায়দায় নিজেদের তৈরি করে নেয়। এদের পদবী ছিল কুন্দন।
এই কুন্দন পদবী পরিবর্তিত হয়ে এখন কুন্ডু পদবী প্রচলিত হয়েছে।১৭৬৬ সালে নারায়ণ কুন্ডুর দৌলতে এই বিশাল রাজবাড়ির নির্মাণ হয়।ইট ও চুনের মিশ্রণে তৈরি বলে এর নাম ইটাচুনা রাজবাড়ি।
₹ হোম লোন • ₹ পার্সোনাল লোন • ₹ বাইক লোন • ₹ কার লোন • ₹ বিজনেস লোন • ₹ শিক্ষা লোন
যা বর্তমানে একটি ভ্রমণ স্থান ও হোম স্টে তে পরিণত হয়েছে।ইটাচুনা রাজবাড়িটি “বর্গী ডাঙ্গা” নামেও পরিচিত”
কীভাবে যাবেন?
কলকাতা থেকে হাওড়া-বর্ধমান মেনলাইনের ট্রেন ধরে খন্যান স্টেশনে নামতে হবে।সেখান থেকে টোটো করে রাজবাড়ি পৌঁছে যেতে পারেন।
গাড়িতে গেলে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে আপনাকে যেতে হবে। আজাদ হিন্দ ধাবা বাঁদিকে রেখে তার পরের দিকের রাস্তা ধরতে হবে। সেখান থেকে পৌঁছে যান বোসিপুর।
সেখান থেকে ১৯ কিলোমিটার ড্রাইভ করে যান হালুসাই। এখান থেকে ১০ মিনিটের দূরত্বেই রয়েছে ইটাচুনা রাজবাড়ি।
থাকার ব্যবস্থা:
ইটাচুনা রাজবাড়িতে গিয়ে হোম স্টে করতে চাইলে প্রথমে আপনাকে ইটাচুনা রাজবাড়ির অফিশিয়াল সাইটে গিয়ে ঘর বুকিং করতে হবে।সাইটেই ঘরের বা কক্ষের নাম ও মূল্য সহ ছবি দেওয়া থাকে।
কক্ষগুলি পরিবারের মা পিসিমাদের নামে নামকরণ করা হয়েছে। যেমন বড় মা,মেজ মা,ঠাকুরমার ঘর,বড় বৌদি, গিন্নী মা, ছোট বৌদি, বড়ো পিসি, জ্যাঠামশাই,বড়দা, কাকাবাবু,বিলাস মঞ্জরী। মঞ্জরী ৬জন একসাথে থাকার জন্য।
প্রতিটা কক্ষ তার নিজের মহিমায় সুন্দর। পুরনো আসবাব, ভিন্টেজ গন্ধ, পুরনো টেলিফোন, হুঁকো স্ট্যান্ড, পার্সিয়ান কার্পেট রাজকীয় ব্যাপারে একদম পরিপূর্ণ একটি প্রাসাদ।২০ বিঘা জমিতে ২৪টি রুম রয়েছে স্টে করার জন্য।
এছাড়াও রয়েছে একটু কম টাকায় মাড হান্ট যেমন মাধবীলতা, ঝুমকালতা,কনকলতা, অপরাজিতা ইত্যাদি। এখানে ১৫০০ টাকা থেকে ৮৪০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে।
রাজবাড়ির সৌন্দর্য ও খাওয়া দাওয়া:
রাজবাড়িতে পাঁচটি মহল্লা রয়েছে। একটি নৃত্যকলা হল,একটি গ্রাম আদালতঘর, রান্নাঘর,গেস্ট হাউস ও মহিলাদের অন্দরমহল। এছাড়াও মন কাড়বে ইটাচুনা রাজবাড়ির ঠাকুরদালান,অন্দরমহল,কাছাড়ি মহল, খিড়কি মহল,বাগান।
নাটমন্দির,বাতিস্তম্ভ, ঝাড়বাতি সজ্জিত এই বাড়ির আনাচে কানাচে ইতিহাসের গন্ধ।বাড়ির দোতলায় রয়েছে টানা বারান্দা আর তার পাশেই অতিথিদের থাকার ঘর।
পেছন দিকে সিলিং থেকে টাঙানো পুরোনো দিনের দুটি টানা পাখা। সঙ্গে ছেলেদের ও মেয়েদের জন্যে আলাদা আলাদা টয়লেট।
ঠাকুরদালানে সাদা ও লাল রঙের কাজ করা দেবদেবীর মূর্তি। অর্ধচন্দ্রাকৃতি তিন খিলানের এই মন্দির।বৈষ্ণবমতেই পুজো হয় এখানে। মন্দিরের তিন দিক ঘেরা লাল রঙের বাড়ি ও বারান্দা।
প্রাচীনকালে অন্দরমহলের ছোট ছোট জানালা দিয়ে মহিলারা কবিগান যাত্রা পালা দেখত যা এই ঠাকুরদালানের সামনের প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়।এই ঠাকুরদালানে আড়াইশো বছর ধরে শ্রীধর দেবের পুজো হয়ে আসছে।
তবে সন্ধ্যা বেলায় আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয়ে এই মন্দিরের আরতি সব থেকে বিশেষ দর্শনীয়। ঘন্টাধ্বনি ও আলোর রোশনাই যেন রাজবাড়ির পরিবেশে মায়ার সৃষ্টি করে।তবে বিশেষ করে দোলযাত্রা, বসন্ত উৎসব, জন্মাষ্টমী মহা সমারোহে পালিত হয়।
ঠাকুরদালান ধরে একটি রাস্তা পাশে গিয়েছে সেখান থেকেই বাগানে যাওয়া যায়। সেখানে প্রথমেই যা চোখে পড়ে তার হল “চা ঘর”।
বিভিন্ন ফুল, কর্পূর, হরিতকী,আমলকি ফলের গাছ এছাড়াও গ্রামের কায়দায় হাঁস মুরগি ছাগল পালিত হয়।
সঙ্গে রয়েছে একটি পুকুর। গ্রামবাংলার ঐতিহ্য সংস্কৃতি মেশানো এই ভ্রমণ স্থান কিন্তু অতুলনীয়। যখন অতিথিরা আসেন তখন প্রদর্শক দ্বারা তাদেরকে এই বাড়িটি ঘুরিয়ে দেখানো হয়।
তবে যারা দিনের দিন ঘুরে চলে আসেন তাদের অন্দরমহল ঘুরে দেখানো হয় না।সোনাক্ষী সিংহ আর রণবীর সিংহের ‘লুটেরা’ ছবির শুটিং এই বাড়িতেই হয়েছিল।
রাজবাড়ির সামনে গেটের বিপরীতে রয়েছে শিবমন্দির। কিন্তু মন্দিরটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। কারণ শিব মন্দিরে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করার সময় প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যু ঘটে।এই মন্দিরে জটাধারী শিবে মূর্তি স্থাপিত রয়েছে।
ইটাচুনা রাজবাড়ির কথা আসতেই যে জিনিসটি সব থেকে আকর্ষণীয় সেটি হল রাজবাড়ির আদলে এলাহী খাওয়া। সকালের জলখাবার থেকে দুপুরের খাবার এবং রাতের নৈশভোজের সবটাই পরিবেশিত হয় কাঁসার থালা বাটি তে পঞ্চব্যঞ্জন সহকারে সাজিয়ে।
সকালে লুচি আলুরদম বেগুন ভাজা মিষ্টি কলা এবং দুপুরে সরু চালের ভাত ভাজা তরকারি মাছ মাংস সহযোগে পরিবেশন করা হয়, নিরামিষ এর ব্যবস্থাও রয়েছে।
রাতে রুটি ভাত দুটোই পাওয়া যাবে এবং সঙ্গে আরও অনেক কিছু সহযোগে মিষ্টি পাঁপড় চাটনী রয়েছে খাবারে। এখানকার অতিথি আপ্যায়ন এর সমাদর কিন্তু অনেকেই করেন।
ফেরার পথে দেখে পাবেন ব্রহ্মময়ী কালী মন্দির, পান্ডুয়ার মিনার ,আর মসজিদের ধ্বংসাবশেষ, ইমামবাড়া,ব্যান্ডেল চার্চ।এখানকার পাণ্ডু রাজার সঙ্গে দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ খলজির তুমুল যুদ্ধ হয়।
কিন্তু যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পাণ্ডুরাজ সপরিবার আত্মহত্যা করেন। বিজয়স্তম্ভ হিসাবে এই মিনারটি নির্মাণ করেন বিজয়ীরা।
পরতে পরতে ইতিহাস, রাজবাড়ির ঐতিহ্য,দালান, স্তম্ভ সব মিলিয়ে এক অনন্য অভিজ্ঞতা।শেষে এটুকুই বলতে হয় যে আজকালের ব্যস্ততার মাঝে শহরের সীমানা পেরিয়ে মেঠো পথ সবুজের প্রান্তরে একটু শান্ত মনোরম পরিবেশে সময় বা ছুটি কাটাতে চাইলে ইটাচুনা রাজবাড়ি সত্যি অসাধারণ একটি স্থান।