বেল অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং উপকারী ফল। এটি কাচা এবং পাকা দুই ভাবেই খাওয়া যায়। এর দুই ভাবেই এর উপকারিতা সমান। বিভিন্ন রোগে বেলের শরবত খুব উপকারি। বেলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন রয়েছে। ভিটামিন এ, সি এবং বিভিন্ন খনিজ উপাদান যেমন ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম রয়েছে। বেল গাছ অনেক বড় ধরনের একটি বৃক্ষ। বেল গাছে ফল আসতে অনেক সময় লাগে বলে এর উৎপাদন কম । উৎপাদনের তুলনায় চাহিদা বেশি বলে বাজারে পাকা বেল খুব চড়া দামে বিক্রি হয়ে থাকে।
আমাদের বাংলাভূমি সাইটে নিয়মিত আমরা আপনাদের সাথে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করে থাকি। এর ফলে আপনারা কৃষি জমি, শিক্ষা, অর্থনীতি এসব বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে থাকেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রয়োজনে আপনারা এ সকল তথ্য থেকে উপকৃত হয়ে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় আজ আমরা আপনাদের সাথে বেল চাষের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব। এতে করে আপনারা সহজেই বেল চাষের বিস্তারিত জানতে পারবেন।
চলুন দেখে নেই বেল চাষের বিস্তারিতঃ
জমি ও মাটিঃ
বেল একটি কষ্ট সহিষ্ণু গাছ তাই এটি যে কোন মাটিতে জন্মাতে পারে। জমি নির্বাচন করার ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে জমি যেন উজ্জ্বল রৌদ্র যুক্ত না হয়। মাটি যেন সুনিষ্কাশিত হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
চারা তৈরিঃ
বেলের চারা তৈরি করা হয় সাধারনত বীজ থেকেই। বেল গাছ পর পরাগায়িত গাছ বলে এতে মাতৃগাছের গুনাগুন বজায় থাকে না। তাই এর জন্য গুটি কলম বা কুড়ি সংযোজন পদ্ধতির মাধ্যমে খুব উন্নত জাতের চারা উৎপাদন করতে হয়।
বেল গাছের গোড়ার চারপাশে যে শিকড় থাকে তা থেকে অনেক কুড়ি বের হয়, সে সব কুড়ি মাটি সহ সাবধানে তুলে আনতে পারলেই নতুন চারা তৈরি করা যায়।
বেলের চারা উৎপাদনে কলম পদ্ধতিঃ
বীজ থেকে যে বেল গাছ হয় তা থেকে ফলন পেতে অনেক সময় লাগে । এত দীঘ© সময় অপেক্ষা করা অনেক কষ্টসাধ্য। তাই এখন বিভিন্ন কলমের মাধ্যমে বেলের চারা উৎপাদন করা হয়। মূলের কাটিং করে এয়ার লেয়ারিং করে বা ফাটল কলমের মাধ্যমে বেলের বংশ বৃদ্ধি করা হয়। কলমের মাধ্যমে উৎপাদিত চারা থেকে ফলন দ্রুত পাওয়া যায়।
জমি তৈরি ও চারা রোপণ:
বেল চাষ করার জন্য বাগানে পর্যাপ্ত জায়গা থাকতে হবে। এক চারা থেকে আরেক চারার দূরত্ব ১০ মিটার হতে হবে। নির্ধারিত দূরত্বে জমি ৫০ সেমি চওড়া ও ৫০ সেমি গভীর করে গর্ত করতে হবে।
প্রতি গর্তে গোবর সার ১০ কেজি, টিএসপি ২৫০ গ্রাম , এমওপি সার ১৫০ দিয়ে মাটিতে ভালোভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে দিতে হবে। এই গর্তে ৮-১০ দিন পর একটি করে চারা রোপণ করতে হবে। চারা লাগানোর পর যদি বর্ষা না হয় তাহলে চারার গোড়ায় জল সেচ দিয়ে মাটি ভালো করে ভিজিয়ে দিতে হবে।
সার প্রয়োগঃ
চারা রোপণ করার পর পরের বছর থেকে প্রতি গাছ অনুযায়ী ১৫-২০ কেজি পচা গোবর সার ব্যবহার করতে হবে। প্রয়োজনীয় পরিমান সার না দিলে অনেক সময় বেল কচি অবস্থায় ঝরে পড়তে পারে। তাই গাছে ফল ধরার পর মাটির সাথে কিছু পরিমান ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি সার মিশিয়ে দিতে হবে।
সেচ ও জল নিষ্কাশনঃ
ভালো গুণগত মান সম্পন্ন বেল উৎপাদনের জন্য সেচের প্রয়োজন হয়। বেল গাছে ফাল্গুন থেকে চৈত্র মাসের মধ্যে ফুল ও ফল ধরে। তাই সেই সময় থেকে বর্ষা আসার আগ পয©ন্ত জল সেচ দিতে হবে প্রতি ১০-১৫ দিন পর পর।
আগাছা ও নিড়ানিঃ
বেল গাছে প্রয়োজনীয় আগাছা ও নিড়ানির ব্যবস্থা করতে হবে। ঝড়ো বাতাসে চারা যেন হেলে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। চারার গোড়ায় ১০-১৫ সেমি দূরে একটি কাঠি পুতে দিতে হবে তাহলে চারা হেলে পড়ার সম্ভাবনা থাকবে না। কোন কারণে কোন চারা যদি মারা যায় তাহলে সেখানে নতুন চারা লাগিয়ে দিতে হবে যত দ্রুত সম্ভব।
বেলের চারার গোড়ায় যেন কোন আগাছা না জন্মে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাই নিয়মিত নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে। চারা অবস্থায় যদি এক থেকে দুই মিটারের মধ্যে কোন ডালপালা গজায় তাহলে তা ছেটে দিতে হবে । এই ডালপালা ছেটে দিলে গাছের কাঠামো ঠিক থাকে।
বেল চাষে বাগানে ধৈঞ্ছা গাছ চাষ করা যেতে পারে তাহলে আগাছা দমন ভালো হয়।
পোকা মাকড় ও রোগ দমনঃ
বেল গাছে সাধারনত যে পোকা দেখা যায় তা হলো মাইট। এই পোকার আক্রমনে পাতার উপর একটি চকচকে দাগ পড়ে এবং পাতা কুকড়ে যায়। প্রয়োজনীয় মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করে এই পোকা দমন করা যায়। তাছাড়া বেল গাছে আর তেমন কোন মারাত্নক কোন পোকার আক্রমণ দেখা যায় না।
ফসল সংগ্রহঃ
বীজের গাছে ফল আসাতে প্রায় ৮-১০ বছর সময় লাগে। তবে কলমের গাছে খুব কম সময়ে ফল আসে। কলমের গাছে ৫-৬ বছরের মধ্যেই ফল আসে। তবে গাছের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ফলন ভালো হয়। গাছের বয়স ১০ বছর পার হলে ফলন ভালো হয়।
গাছে ফুল ধরার পর থেকে ফল পাকার সময় পর্যন্ত প্রায় এক বছর সময় লাগে। বেল গাছে সাধারনত মার্চ থেকে এপ্রিল মাসের দিকে ফুল আসে আর পরের বছর ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে ফল পাকে। ফল সব পেকে যাবার পর একটি একটি করে ফল বোটা সহ পাড়তে হবে । ফল মাটিতে ফেলা যাবে না।
ফলনঃ
সাধারনত একটি পূর্ণবয়স্ক বেল গাছ থেকে বছরে ১৫০-২০০ টি বেল পাওয়া যায়।