লাউ আমাদের দেশের একটি অন্যতম সু্স্বাদু সবজি। লাউ সব ধরণের মাটিতে জন্মে। সাধারণত লাউ শীতকালে চাষ করা হয়ে থাকে। লাউয়ের পাতা নরম ও সবুজ বিধায় পাতা ও ডগা শাক হিসেবে এবং লাউ ভাজি ও তরকারি রান্না করে খাওয়া হয়। লাউয়ের চেয়ে এর শাক পুষ্টিকর বেশি। লাউ লতানো উদ্ভিদ তাই সারা বছরই চাষ করা যায়।
আমাদের বাংলাভূমি সাইটে নিয়মিত আমরা আপনাদের সাথে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করে থাকি। এর ফলে আপনারা কৃষি জমি, শিক্ষা, অর্থনীতি এসব বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে থাকেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রয়োজেনে আপনারা এ সকল তথ্য থেকে উপকৃত হয়ে থাকেন।
এরই ধারাবাহিকতায় আজ আমরা আপনাদের সাথে লাউ চাষের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব। এতে করে আপনারা সহজেই লাউ চাষের বিস্তারিত জানতে পারবেন।
চলুন দেখে নেই লাউ চাষের বিস্তারিতঃ
মাটিঃ
জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ এটেল দোআঁশ ও দোআঁশ মাটি লাউ চাষের জন্য ভালো হয়।
জলবায়ুঃ
লাউ চাষের জন্য উপযোগী মৌসুম হলো শীতকাল। বেশি গরম ও না আবার বেশি শীত ও না এমন আবহাওয়া লাউ চাষের জন্য ভালো।
বীজ বপন ও চারা উৎপাদনঃ
লাউ চাষের জন্য পলিথিন ব্যাগে চারা তৈরি করাই উত্তম। এতে বীজের খরচ কম পড়ে। পলিথিন ব্যাগে চারা উৎপাদন করে রোপণ করলে হেক্টর প্রতি ৮০০-১০০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
বীজতলা তৈরি ও বীজ বপনঃ
লাউ চাষের জন্য পলিব্যাগে চারা উৎপাদন করে নিলে ভালো হয়। স্বাভাবিক ভাবে আলো বাতাস থাকে এমন জায়গা নির্বাচন করতে হবে। বেড ২০-২৫ সেমি উঁচু করতে হবে।
বীজ বপনে জন্য ৮×১০ সেমি আকারের পলিব্যাগ দরকার। অর্ধেক মাটি ও অর্ধেক গোবর মিশিয়ে বা এক তৃতীয়াংশ কম্পোস্ট সার মিশিয়ে মাটি তৈরি করতে হবে। বীজ গজানোর জন্য মাটির জো ঠিক রাখতে হবে। মাটিতে জো না থাকলে জল দিয়ে জো করে নিয়ে পলিব্যাগ ভরতে হবে।
অঙ্কুরোদগমঃ
লাউয়ের বীজের খোসা কিছুটা শক্ত বিধায় অঙ্কুরোদগম হতে সময় লাগে। সহজে অঙ্কুরোদগমের জন্য পরিষ্কার জলে ১৫-২০ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে অথবা শতকরা ১% পটাশিয়াম নাইট্রেট দ্রবণে একরাত ভিজিয়ে তারপর পলিব্যাগে বীজ বপন করতে হবে।
চারার পরিচর্যাঃ
চারা অঙ্কুরোদগম হওয়ার পর বেডে চারার সঠিক ভাবে পরিচর্যা করতে হবে। শীতের সময় চারা গজাতে সমস্যা হয়। এজন্য শীতের সময় বীজ গজানোর আগে প্রতি দিন রাতে বেড ঢেকে রাখতে হবে।
দিনের বেলাতে খোলা রাখতে হবে। বেডে চারার চাহিদা অনুসারে জল দিতে হবে। চারার গায়ে যেন জল না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। জল দেওয়ার ফলে পলিব্যাগের মাটি চটা বাধলে চটা ভেঙে দিতে হবে।
মাদা তৈরিঃ
মাদার মাটি ঢলো চুন দিয়ে শোধন করে নিতে হবে। মাদা প্রতি ১০০ গ্রাম। মাদার দূরত্ব মাদা থেকে মাদা ৬ হাত / ৭ হাত। মাদার গর্ত ১২ ইঞ্চি, প্রস্থ ১ হাত / ১ হাত।
সার প্রয়োগঃ
গর্তে পচা গোবর, কচুরিপানা দিয়ে মাটি চাপা দিয়ে দিতে হবে ৭ দিন। প্রতি মাদায় সার টিএসপি ১০০ গ্রাম , খইল ১০০ গ্রাম, পটাশ ৫০ গ্রাম,বোরন ২০ গ্রাম, জিপসাম ১০০ গ্রাম। মাদায় দিয়ে মাটি ভালো করে উলট পালট করে দিতে হবে। ৮-১০ দিন পর পর বীজ অথবা চারা লাগানো যাবে।
সেচ দেওয়াঃ
লাউ গাছে প্রচুর পরিমাণে জল প্রয়োজন হয়। লাউ গাছের প্রয়োজনীয় জলের অভাব হলে ফল ধারণ ব্যাহত হয় এবং ফল আস্তে আস্তে ঝরে পড়ে।
ভালো ফলন পাওয়ার জন্য নালার মাধ্যমে গাছের প্রয়োজন অনুসারে নিয়মিত সেচ দিতে হবে। নালায় জল দিয়ে জমিয়ে রাখলে গাছ তার প্রয়োজন মতে জল টেনে নিবে। শুষ্ক মৌসুমে লাউ গাছে ৪-৫ দিন পর পর সেচ দিতে হবে।
মালচিং ও বাউনি দেয়াঃ
মালচ অর্থ মাটি ঢেকে দেওয়া, আর মালচিং হলো মাটির আর্দ্রতা সংরক্ষণ করা। মাটির রস ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের বস্তু দিয়ে গাছের গোড়া, সবজি ক্ষেত ও বাগানের বেডের জমি বিশেষ পদ্ধতিতে ঢেকে দেওয়াকে মালচিং বলে।
লাউ গাছ স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে উঠার জন্য বাঁশ বা রশি দিয়ে বাউনীর ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
আগাছা দমনঃ
লাউয়ের চারা লাগানো থেকে শুরু করে ফল সংগ্রহ পর্যন্ত সব সময় জমির আগাছা পরিষ্কার করে রাখতে হবে। লাউ গাছের গোড়ায় আগাছা থাকলে তা খাদ্য প্রদানে বাধা সৃষ্টি করে ও গাছের গোড়ায় রস চুষে নেয়।
এছাড়া কিছু নির্দিষ্ট প্রজাতির ঘাসের কারণে লাউয়ে বোটল গোর্ড মোজাইক ভাইরাস নামের রোগ হয়ে থাকে। তাই ভালো ফলনের জন্য আগাছা পরিষ্কার করে রাখতে হবে।
লাউ গাছের শোষক শাখা অপসারণঃ
লাউ গাছের গোড়ার দিকে যে ছোট ছোট ডগা বের হয় সে গুলোকে শোষক শাখা বলে। এ সকল শাখা গুলো গাছের ফলন ও গাছ বৃদ্ধিতে বাধা হয়ে দাড়ায়। গাছের গোড়ার দিকের ৪০-৪৫ সেমি পর্যন্ত সবগুলো শোষক শাখা কেটে ফেলতে হবে।
রোগ ব্যবস্থাপনাঃ
রোগ বালাই দেখা দিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
লাউয়ের পরিপক্কতা সনাক্তকরণঃ
১. পরিপক্ক লাউয়ের গায়ে প্রচুর শুং থাকবে।
২. লাউয়ের গায়ে নখ দিয়ে হালকা চাপ দিলে খুব সহজেই নখ দেবে যাবে।
৩. লাউয়ের পরাগায়নের ১২-১৫ দিনের মধ্যে ফল সংগ্রহের উপযোগী হয়।
ফলন ও ফসল তোলা
সঠিক ভাবে যত্ন নিয়ে লাউ চাষ করলে প্রতি হেক্টরে ৩৫-৪০ টন এবং প্রতি বিঘায় ৪.৫-৫ টন ফলন পাওয়া যায়। এবং সেই সাথে প্রতি হেক্টরে ৫০০ কেজি পর্যন্ত বীজ ও উৎপাদন করা যায়।
আজ আমরা লাউ চাষ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলাম। আগামীতে আপনাদের সাথে লাউ চাষ নিয়ে আরো কিছু আলোচনা করবো, তাই আমাদের পেজে নিয়মিত চোখ রাখুন। এই লেখাটি অনেকের কাজে লাগতে পারে তাই লেখাটি যতটুকু সম্ভব শেয়ার করুন। যাতে করে এই লেখা থেকে শিক্ষা নিয়ে লাউ চাষ করে অনেকেই আয় করার ব্যবস্থা করতে পারে।
কৃষি নিয়ে আরো অনেক লেখা পেতে আমাদের সাইটের অন্য লেখাগুলো দেখুন। আমাদের লেখা গুলো ভালো লাগলে বা যেকোন মন্তব্য আমাদের ফেসবুক পাতায় লিখুন।