গুরু গোবিন্দ সিং জয়ন্তী 2024 (Guru Gobind Singh Jayanti 2024 Date Time and Significance) 2024 গুরু গোবিন্দ সিং জয়ন্তী ইতিহাস এবং জানুন গুরু গোবিন্দ সিং জয়ন্তী কেন পালন করা হয়? গুরু গোবিন্দ সিং জয়ন্তী তাৎপর্য কি? ভারতীয়দের জন্য গুরু গোবিন্দ সিং জয়ন্তী গুরুত্ব কতটা? জানুন সবকিছু এখানে।
আমাদের ভারতবর্ষ সর্বধর্ম সমন্বয়ের একটি দেশ। যেখানে বিভিন্ন ধরনের ধর্মাবলম্বীরা বসবাস করেন। যেমন বাঙ্গালী দের বারো মাসে তেরো পার্বণ, তেমনি অন্য ধর্মের মানুষ দের উৎসবেরও সমারোহ চোখে পড়ে এখানে। তেমনি সব উৎসবের মধ্যে একটি হল গুরু গোবিন্দ সিং জয়ন্তী উৎসব। শিখ ধর্মের দশম এবং শেষ গুরু, গুরু গোবিন্দ সিং এর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে গুরু গোবিন্দ সিং জয়ন্তী উদযাপন করা হয়।
এছাড়া এই উৎসবটি প্রকাশ পর্ব নামেও পরিচিত। সাধারণত ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারি মাসে শিখ ধর্মের এই উৎসব পালন করা হয়। শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ প্রচুর উৎসাহ উদ্দীপনা সাথে এই দিবসটি পালন করে থাকেন ও গুরুর পথ অনুসরণ করার শপথ নিয়ে থাকেন অনেকেই।
তো চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক, গুরু গোবিন্দ সিং জয়ন্তীর ইতিহাস সম্পর্কে:
গুরু গোবিন্দ সিং জয়ন্তীর ইতিহাস 2024:
ইতিহাস অনুসারে জানা যায় যে, ১৬৬৬ সালে বিহারের পাটনায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন গুরু গোবিন্দ সিং। গুরু গোবিন্দ সিং ছিলেন শিখ ধর্মের দশম গুরু, একজন আধ্যাত্মিক নেতা, যোদ্ধা, কবি এবং তার সাথে তিনি ছিলেন দার্শনিক। নবম গুরু তেজ বাহাদুর ও মাতা গুজরীর একমাত্র সন্তান ছিলেন এই গুরু গোবিন্দ সিং। তাছাড়া তার প্রথমদিকে নাম ছিল গোবিন্দ রাই।
মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব এর আদেশে গুরু গোবিন্দ সিং এর পিতা আর শিখদের নবম গুরু গুরু তেগ বাহাদুর এর মৃত্যুদণ্ডের পর মাত্র নয় বছর বয়সে গুরু গোবিন্দ সিং কে শিখ সম্প্রদায়ের দশম গুরু হিসাবে নির্ধারিত করা হয়।
এছাড়া পিতার মৃত্যুর পর গোবিন্দ সিং শিখদের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন। তার পাশাপাশি মুঘলদের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা কর্তার ভূমিকায় তিনি অবতীর্ণ হন।
গুরু গোবিন্দ সিং এর উপদেশ এবং দর্শন, শিখ সম্প্রদায়ের জীবনে এক ঐতিহাসিক গুরুত্ব পালন করে থাকে। তার শিক্ষা ও দর্শনের মাধ্যমে শিখ সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মুঘলদের হাত থেকে শিখ সম্প্রদায়ের মানুষদের রক্ষা করার জন্য তিনি লড়াই করেছিলেন।
১৬৯৯ সালে তিনি খালসা সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন। এরপরেই তিনি তার সমস্ত অনুসারীদের নাম দিয়েছিলেন সিং। ১৭০৮ সালের ৭ ই অক্টোবর গুরু গোবিন্দ সিং এর মৃত্যু হয়। তিনি তার মৃত্যুর আগে গুরু গ্রন্থ সাহেবকে শিখ ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
গুরু গোবিন্দ সিং জয়ন্তীর তাৎপর্য 2024:
যেহেতু আমরা জানি যে, গুরু গোবিন্দ সিং ছিলেন শিখদের একজন দশম গুরু। একজন মহান যোদ্ধা এবং আধ্যাত্মিক গুরু, যার বীরত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিশ্ব জানে। তিনি শিল্পকলার প্রেমীক ছিলেন। অনেক গুলি কবিতাও রচনা করেছিলেন।
শিখ সম্প্রদায়কে নিজের সন্তান হিসেবে দেখাশোনা করতেন এই গুরু গোবিন্দ সিং। তাঁর দর্শন তার লেখা এবং কবিতা এর মানুষদের অনুপ্রাণিত করে এবং তার পাশাপাশি আরো অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে থাকে।
গুরু গোবিন্দ সিং সম্প্রদায়ের মানুষরা গুরু দ্বারে যান, সেখানে গুরু গোবিন্দ সিং এর স্মরণে প্রার্থনা সভা হয়। গুরুদ্বার থেকে শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয় এবং কীর্তন হয়। এই দিন দরিদ্রদের সেবা করার রীতিও প্রচলিত আছে শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে।
গুরু গোবিন্দ সিং তাঁর নিজের জ্ঞানের মধ্য দিয়ে তার সম্প্রদায়ের মানুষদের কাছে পৌঁছে ছিলেন। তাকে স্মরণ করে রাখতে প্রতিবছর শিখ সম্প্রদায়ের মানুষরা তার জন্মবার্ষিকী অত্যন্ত উৎসব উদ্দীপনার সাথে উদযাপিত করে থাকেন।
গুরু গোবিন্দ সিং সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা যাক:
- মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব এর আদেশে গুরু গোবিন্দ সিং এর পিতা অর্থাৎ শিখ দের নবম গুরু গুরু তেগ বাহাদুরের শিরশ্ছেদ এরপর মাত্র নয় বছর বয়সে গুরু গোবিন্দ সিং কে শিখ সম্প্রদায়ের দশম গুরু নির্বাচিত করা হয়।
- একজন ভালো এবং শক্তিশালী যুদ্ধ হওয়ার জন্য তিনি মার্শাল আর্ট শিখেছিলেন। যার কারণে শিখ সম্প্রদায় কে তিনি অনুপ্রাণিত করেছিলেন এই মার্শাল আর্ট শেখার জন্য।
- শৈশবকালে গুরু গোবিন্দ সিং বেস কয়েকটি ভাষা শিখেছিলেন। যেমন ধরুন:- গুরুমুখী, সংস্কৃত, হিন্দি, ব্রজ, উর্দু, ফার্সি ইত্যাদি।
- পরবর্তীতে তিনি তার বাসস্থান পাঞ্জাবের আনন্দপুর সাহেব ছেড়ে দিয়ে রাজা মাত প্রকাশ এর আমন্ত্রণে হিমাচল প্রদেশের নাহান তে চলে যান।
- ১৬৮৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মাত্র ১৯ বছর বয়সে গুরু গোবিন্দ সিং পাহাড়ে ভীম চাঁদ গাড়োয়ালের রাজা ফাতেহ খান এবং অনেক স্থানীয় রাজাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন, সেই যুদ্ধটি কেবলমাত্র একদিন স্থায়ী হয়েছিল এবং গুরু গোবিন্দ সিং বিজয়ী হয়েছিলেন।
- পাওন্তা সাহেব নামে একটি গুরুদ্বার, গুরু গোবিন্দ সিং প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
- বিখ্যাত “পঞ্চ ক” বার্ষিক নীতি ওই একই দিনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই পাঁচটি ক হলো কেশ (চুল), কাংগা (কাঠের চিরুনি), কারা (লোহার বলা), কাচ্চা (হাঁটু পর্যন্ত দৈর্ঘ্যের দড়ি বাঁধা বস্ত্র) এবং কৃপণ (তরোয়াল)।
- এছাড়া খাসা সম্প্রদায় মূলত শিখ সম্প্রদায়, তবে এর মূল লক্ষ্য ছিল সমাজের নিরীহ ও দুর্বল অংশকে অত্যাচার থেকে রক্ষা করা।
- তিনি গুরু গ্রন্থ সাহেব প্রবর্তন করেন, এর মধ্যে গুরু গোবিন্দ সিংহের সমস্ত শিক্ষা রয়েছে।
- ঔরঙ্গজেব দ্বারা নিয়মিত দ্বন্দ্ব নির্যাতনের পরে গুরু গোবিন্দ সিং তাকে ফারসি ভাষায় একটি চিঠি লিখেছিলেন। যেখানে শিখ সম্প্রদায়ের উপর মুঘলদের হিংস্র ও অমানবিক ও অপকর্মের কথা তুলে ধরা হয়েছিল। সেই চিঠিটি এখন জাফরনামা বা বিজয়ের চিঠি নামে খ্যাত।
- এরপর ঔরঙ্গজেব মারা যাওয়ার পর এবং বাহাদুর শাহ সিংহাসনে বসার পরে সেই সম্প্রদায়ের সাথে শাহ বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করেন এবং গুরু গোবিন্দ সিং কে “হিন্দ কা পীর” উপাধি দেন।
- তবে শাহকে নবাব ওয়াজির খান প্ররোচিত করেছিলেন গুরু গোবিন্দ সিংহকে হত্যা করতে।
- এর ফলস্বরূপ ১৭০৭ সালের দুই আক্রমণকারী জামশেদ খান এবং ওয়াসিল বেগকে প্রেরণ করা হয় গুরু গোবিন্দ সিং কে হত্যা করার জন্য।
- তারা দুজন ঘুমন্ত অবস্থায় গুরু গোবিন্দ সিং কে ছুরির আঘাত করে, তবে গুরু গোবিন্দ সিং লড়াই করেন এবং আক্রমণকারীরা নিহত হয়।
- তবে পরবর্তীতে ১৭০৮ সালের ৭ ই অক্টোবর গুরু গোবিন্দ সিং এর মৃত্যু হয়।
গুরু গোবিন্দ সিং কে স্মরণ করে রাখার জন্য প্রতিবছর শিখ সম্প্রদায়ের মানুষরা তার জন্মবার্ষিকী অত্যন্ত আনন্দের সাথে এবং উৎসাহের সাথে পালন করে থাকেন। এই দিন সবাই মানবজাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করেন।
এই দিনটি সেই সম্প্রদায়ের কাছে খুবই উৎসবের দিন, এই দিনে অনেক বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের রান্না- বান্না থেকে শুরু করে আরো অনেক শিখ সম্প্রদায়ের নিয়ম কানুন পালন করা হয়।
তবে তাদের পঞ্চক যা উপরে আলোচনা করা হয়েছে, সে সম্পর্কে তারা সারা বছরই খুবই নিষ্ঠার সাথে নিজেদের জীবনে প্রতিফলিত করে থাকেন। এই দিনে প্রতিটি গুরুদ্বারে শিখ সম্প্রদায়ের মানুষদের ভিড় চোখে পড়ার মতো। সেখানে গিয়ে সকলের মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করে থাকেন তারা।