ভদ্রকালী শক্তিপীঠ: যে স্থানে সতীর গোড়ালির হাড় পতিত হয়েছিল

(Bhadrakali Shakti Peeth in Bengali) ভদ্রকালী শক্তিপীঠের বর্তমান অবস্থান কোন স্থানে? দেবী সতীর কোন অঙ্গ এখানে পতিত হয়েছে? ভদ্রকালী শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী কি? কিভাবে আরাধনা করা হয়? এই মন্দিরের তাৎপর্য কি? জানুন সবকিছু বিস্তারিত।

হিন্দু ধর্মে দেব দেবীদের সংখ্যা নিহাত কম নয়। তার সাথে সাথে তীর্থস্থান ও রয়েছে অনেক। হিন্দু ধর্মে তেমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান হল ৫১ টি শক্তি পীঠের মধ্যে এই ভদ্রকালী মন্দির অথবা প্রাচীন থানেশ্বর, বর্তমান কুরুক্ষেত্র।

দেবী ভদ্রকালী মহাশক্তি একটি বিশেষ রূপ হিসাবে পুজিতা হয়ে থাকেন। পুরান অনুসারে মহিষাসুরমর্দিনী, চন্ডী ও ভদ্রকালী একই এবং অভিন্না। মহাভারতে ভদ্রকালী দুর্গার অপর নাম।

Bhadrakali Shakti Peeth in Bengali - ভদ্রকালী শক্তিপীঠ
Bhadrakali Shakti Peeth in Bengali – ভদ্রকালী শক্তিপীঠ

কালিকা পুরান, দেবীপুরাণ অনুসারে ও ভদ্রকালী দুর্গারই রূপান্তর অথবা দেবী দুর্গার আরেকটি রূপ। আবার সরস্বতীকেও ভদ্রকালী নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। কিন্তু এখানে দেবী পার্বতীকেই ভদ্রকালী হিসেবে পূজা করা হয়।

ভদ্রকালী শক্তিপীঠ:

শক্তিপীঠের নাম ভদ্রকালী শক্তিপীঠ
স্থান শ্রী দেবীকূপ ভদ্রকালী শক্তিপীঠ মন্দির, কুরুক্ষেত্র, হরিয়ানা
দেশ ভারত
দেবীর অংশ গোড়ালির হাড়
শক্তির নাম সাবিত্রী

ভদ্রকালী মন্দিরের ভৌগলিক গুরুত্ব:

দেবীর দেহ অংশগুলি পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে, তেমনি ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের বর্তমান কুরুক্ষেত্র তে এই সতীপীঠ অবস্থিত।

এখানে দেবীর গোড়ালির হাড় (গুল্ফ) পতিত হয়েছিল এই শক্তি পীঠের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নাম সাবিত্রী এবং পীঠরক্ষক ভৈরবের নাম স্থানু।

ভদ্রকালী মন্দির এর প্রতিষ্ঠা:

তমলুকের শক্তি পীঠের প্রাচীন নাম ছিল বিভাস, দেবী পার্বতী এখানে বর্গভীমা অথবা ভীমরূপা নামে অধিষ্ঠিত, আর ভৈরব সর্বানন্দ এবং অনেকের মত অনুসারে কপালী নামে পরিচিত। পায়ের গোড়ালির হাড় পড়েছিল এখানে।

তবে ঠিক কত বছর আগে এই মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়েছিল তা সঠিক করে নির্দিষ্ট তারিখ আজও পর্যন্ত জানা যায়নি। তবে কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ চলাকালী সময় এ এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।

ভদ্রকালী মন্দিরের পৌরাণিক কাহিনী:

এছাড়াও কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, সতী পার্বতী বাবার অমতে গিয়ে মহাদেবকে বিবাহ করার পর মহাদেব খুবই খুশি হলেও সতীর বাবা দক্ষ রাজা খুবই রেগে গেলেন। আর সেই কারণে একবার নিজের বাড়িতে দক্ষযজ্ঞ এর আয়োজন করলেন দক্ষ রাজা।

নিমন্ত্রিত ছিলেন সকল দেবদেবী ছাড়াও অনেকেই শুধুমাত্র নিমন্ত্রিত ছিলেন না পার্বতী ও মহাদেব। এমন ঘটনায় খুবই অপমান বোধ করে পার্বতী সেখানে উপস্থিত হয়ে এই কথা জানতে চাইলে দক্ষ রাজা সতী দেবীর সামনে তার স্বামী মহাদেবকে অনেক অপমান করতে শুরু করেন।

সতী স্বামীর এই অপমান সহ্য করতে না পেরে বাপের বাড়িতেই সেই দক্ষযজ্ঞে নিজের প্রাণ ত্যাগ করেন অর্থাৎ আত্মাহুতি দেন, এমন ঘটনায় একেবারে পাগলপ্রায় হয়ে যান মহাদেব। সেই স্থানে পৌঁছানো মাত্রই দেবীর প্রাণহীন দেহ কাঁধে করে তুলে নিয়ে তিনি তান্ডব নৃত্য তে মেতে ওঠেন। এমন তান্ডব নৃত্য চলার ফলে পৃথিবীতে প্রলয় সৃষ্টি হয়। সেই প্রলয়ে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।

এমন অবস্থায় দেবতাদের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার হয়, এই পরিস্থিতি তে বিষ্ণু অন্য কোন উপায় না দেখে, তার সুদর্শন চক্র পাঠিয়ে দেন, যাতে দেবীর দেহ খন্ড-বিখন্ড করা যায় আর দেবাদিদেব মহাদেব কে শান্ত করা যায়। যার ফলে পৃথিবীতে যে প্রলয় ঘটছে সেই প্রলয় থেমে যাবে। সেই সুদর্শন চক্র দেবীর দেহকে ৫১ টি খন্ডে বিভক্ত করে একান্নটি জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়।

আর সেই ৫১ টি দেবীর দেহাংশ গুলি পৃথিবীর বুকে যেখানে যেখানে পতিত হয়েছিল সেখানে সেখানে পড়া মাত্রই প্রস্তর খন্ডে পরিণত হয় সতীর দেহ অংশ গুলি। তারপর পরবর্তীতে সেই জায়গা গুলি এক একটি শক্তি পীঠ অথবা সতী পীঠে পরিণত হয়, পরবর্তীতে গড়ে ওঠে মন্দির, শুরু হয় দেবীর আরাধনা।

কালীপুজো উপলক্ষে এই মন্দিরে খুব আড়ম্ভর পূর্ন ভাবে পূজা-অর্চনা করা হয়। যার ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পুণ্যার্থী, ভক্তদের ভিড় সমাগম চোখে পড়ার মতো। এছাড়াও দেশের বাইরে থেকেও পর্যটক দের আনাগোনা প্রায় লেগেই থাকে বললেই চলে।

এই মন্দিরের নিয়ম অনুসারে শ্যামা পূজার দিন অর্থাৎ কালী পূজার দিন একপ্রকার সারারাত ধরে চলে মায়ের পূজা, যাদের বাড়িতে পূজা হয়ে থাকে, তারা সবাই ঘট নিয়ে শোভাযাত্রা সহকারে নাচ গান বাজনার মধ্যে দিয়ে ভদ্রকালীর মন্দিরে আসেন এবং পুজো দেন এরপর নিজ নিজ এলাকাতে গিয়ে শ্যামা পূজায় মেতে ওঠেন।

এই পূজা উপলক্ষে এবং যেহেতু এটি একটি শক্তি পীঠ সেই কারণে মানুষের ঢল নামে অজস্র ধারায় ঝর্ণার মত। দেবীর কাছে মনের ইচ্ছা জানিয়ে ভক্তি ভরে পূজা দিলে সকলের মনের ইচ্ছা পূরণ হয়, আর তাই সেই বিশ্বাস অনুযায়ী এখানে ভক্তদের সমাগম সারা বছর ধরে যা থাকে তার সাথে সাথে কালীপুজোর সময় এই মন্দিরে ভক্তদের ভিড় আরও বেড়ে যায়।

মন্দিরের চারিদিকের পরিবেশ আর মন্দিরের শান্ত পরিবেশ আপনাকে মুগ্ধ করবে। অনেকের বিশ্বাস অনুসারে এখানে সতী দেবী মহাদেবের সাথে বিরাজ করছেন। তিনি সকল ভক্তদের মনের ইচ্ছা পূরণ করার জন্য এই জায়গায় অধিষ্ঠিত রয়েছেন, সকলকে সুরক্ষিত রাখেন দেবী।

এছাড়াও স্থানীয় মানুষজন দের কাছে এই মন্দিরটি একটি পবিত্র তীর্থস্থান। যেখানে প্রতিনিয়ত তারা পূজা অর্চনা করার জন্য আসেন। কাছাকাছি সতীর এমন একটি শক্তি পীঠ অথবা সতী পীঠ পেলে অনেকেই যেতে চাইবেন, তাই না !  সেখানে দেবীর দর্শন করতে ও মনের ইচ্ছা জানাতে পারেন। ৫১ টি শক্তি পীঠের মধ্যে ভদ্রকালীর মন্দির অর্থাৎ বর্তমান কুরুক্ষেত্রের এই শক্তিপীঠ অথবা সতী পীঠ সকলের কাছে খুবই পবিত্র একটি তীর্থস্থান।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top