বর্গভীমা শক্তিপীঠ: যেখানে সতীর বাম পায়ের গোড়ালি পতিত হয়েছিল

(Bargabhima Shakti Peeth in Bengali) বর্গভীমা শক্তিপীঠের বর্তমান অবস্থান কোন স্থানে? দেবী সতীর কোন অঙ্গ এখানে পতিত হয়েছে? বর্গভীমা শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী কি? কিভাবে আরাধনা করা হয়? এই মন্দিরের তাৎপর্য কি? জানুন সবকিছু বিস্তারিত।

প্রতিটি তীর্থস্থান হিন্দু ধর্মাবলম্বী দের কাছে অনেক খানি পবিত্র আর এখানে যাওয়ার জন্য সারা জীবন ধরে অপেক্ষা করেন অনেকেই। তবে আবার অনেকেই একের অধিক বার এই সমস্ত তীর্থ স্থানে ঘুরে থাকেন। কেননা অন্যান্য তীর্থ স্থানের পাশাপাশি ৫১ টি শক্তি পীঠে ঘুরে অনেকখানি শান্তি অনুভব করা যায়।

Bargabhima Shakti Peeth in Bengali - বর্গভীমা শক্তিপীঠ
Bargabhima Shakti Peeth in Bengali – বর্গভীমা শক্তিপীঠ

তাই তো জীবনের কিছুটা সময় এই সমস্ত শক্তি পীঠে কাটাতে পারলেই জীবনকে ধন্য বলে মনে করেন ভক্তগণ। এখানে দেবী কপালি, ভিমরূপা নামে পুজিত হন এবং দেবীর ভৈরব হলেন সর্বানন্দ।

বর্গভীমা শক্তিপীঠ:

শক্তিপীঠের নাম বর্গভীমা শক্তিপীঠ
স্থান বর্গভীমা মন্দির, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিমবঙ্গ
দেশ ভারত
দেবীর অংশ বাম পায়ের গোড়ালি
শক্তির নাম কপালিনী

বর্গভীমা মন্দিরের ভৌগলিক গুরুত্ব:

এই মন্দিরটি পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত তমলুক শহরে অবস্থিত, তমলুক স্টেশন থেকে মন্দিরে দূরত্ব মাত্র ৩ কিলোমিটার। এই তীর্থস্থানে আসতে গেলে অর্থাৎ এই শক্তি পীঠে যদি আপনি আসতে চান তাহলে ট্রেনে করে এলে হাওড়া থেকে তমলুক স্টেশন আসতে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা সময় লাগে।

সকালবেলা ট্রেনে করে আসা ভালো, কেননা মন্দির চত্ব্বর ঘুরে দেখতে আপনার অনেকটাই সময় লাগবে। তাই হাতে সময় নিয়ে আসলে আপনার জন্যই ভালো। স্টেশন থেকে গাড়ির ব্যবস্থা করে মন্দিরে আসা যায় সরাসরি।

বর্গভীমা শক্তিপীঠ এর পৌরাণিক কাহিনী:

সতীর ৫১ টি শক্তি পীঠের মধ্যে অন্যতম শক্তিপীঠ হল তমলুকের দেবী বর্গভীমা। সতীর “বাম পায়ের গোড়ালি” পড়েছিল এই স্থানে। এই বর্গভীমা মন্দির প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে অনেক অলৌকিক কাহিনী।

কাহিনী অনুসারে জানা যায়, ময়ূর বংশ রাজা তাম্র ধ্বজের রাজত্বে প্রত্যেকদিন জ্যান্ত মাছের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল এলাকার ধীবরদের অর্থাৎ জেলেদের। সেই কথা অনুসারে এক জেলে রমণী প্রতিনিয়ত জ্যান্ত মাছের যোগান দিয়ে আসছিলেন রাজ পরিবারে।

কিন্তু হঠাৎ করেই ঘটে একটি ঘটনা, কেননা সেই জেলে রমনী অর্থাৎ জেলের স্ত্রী লক্ষ্য করেন যে তার  জাগানো (জিয়ানো) সবকটি মাছ মরে যাচ্ছে। তখন তিনি কি করবেন বুঝে উঠতে না পেরে মনের দুঃখে বনের মধ্যে বসে কাঁদতে শুরু করেন। কেননা রাজ পরিবারে জ্যান্ত মাছেরই যোগান দিতে হবে।

এমন ভাবে কাঁদতে থাকলে কিছুক্ষণ পরে সেখানে একটি মহিলা এসে তাকে জিজ্ঞাসা করেন যে, কি হয়েছে ? সে কেন কাঁদছে ? তখন সেই জেলের স্ত্রী জানান যে তার সমস্ত সমস্যার কথা। এরপর জেলের স্ত্রী কে সেই মহিলা বলেন যে, সামনে কিছুটা এগিয়ে গেলেই যে বন অথবা জঙ্গল পড়বে সেখানে একটি জলের কুণ্ড আছে।

সেই জল যদি মাছের গায়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে মাছ গুলি আবার জ্যান্ত (জীবিত) হয়ে উঠবে। আর এও বলেন যে, সেই জেলের স্ত্রী যেন এই কথা ঘুনাক্ষরেও কাউকে না বলেন। তখনই সেই জেলের স্ত্রী সেই কুন্ডের জল মাছের গায়ে ছিটিয়ে হাতে নাতে ফল দেখতে পেলেন।

আর এইভাবে সে প্রতিনিয়ত রাজাকে জ্যান্ত শোল মাছ দিয়ে আসতে লাগলেন। বেশ কিছুদিন এমন ভাবে চলার পর রাজার মনে সন্দেহ জাগে, রোজ কি করে জেলের স্ত্রী এইভাবে জ্যান্ত মাছের যোগান দিয়ে চলেছে। এমন কি অসময়েও একই ভাবে জ্যান্ত মাছের যোগানে দেওয়ার রহস্যটা কি ?

তা জানার জন্য তিনি আর আগ্রহ চেপে রাখতে পারলেন না, তারপর সেই জেলের স্ত্রীকে খুব জোরাজোরি করার পর প্রথমে সেই জেলের স্ত্রী কিছু বলতে না চাইলেও তাকে ভয় দেখানো হয় এবং জোর করে রাজা আসল সত্যিটা জানতে পারেন। এরপর রাজা ঠিক করেন যে, তিনি নিজেই একবার হাতেনাতে পরীক্ষা করে দেখবেন।

সেইমতো ওই জেলের স্ত্রী কে নিয়ে রাজা জলের কুন্ডের কাছে গেলে দেখতে পান জলের কুন্ডু সেখানে নেই। সেখানে পড়ে রয়েছে একটি পাথরের উপরে শিলা খন্ড। রাজা ফিরে আসেন এবং আর দেবীকে স্বপ্নে দেখতে পান, আর স্বপ্নে আদেশ পান যে, তার মন্দির প্রতিষ্ঠা করার কথা বলছেন দেবী।

তারপর রাজা সেখানেই একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন যা আজকে দেবী বর্গভীমা মন্দির রূপে পরিচিত সকলের কাছে। সেই পাথরের উপরে শিলাখণ্ড আজও দেবী মূর্তি হিসেবেই পূজিত হন। আর সেই থেকে আজও দেবী বর্গভীমার ভোগের অন্যতম পদ হলো শোল মাছের টক।

বর্গভীমা মন্দির এর আরো একটি পৌরাণিক কাহিনী:

আরো একটি জনশ্রুতি অনুসারে জানা যায় যে, এক সওদাগর রূপনারায়ণ নদীপথে ব্যবসা করতে যাওয়ার সময় একবার ত্রাম্বলিপ্ত বন্দরে নামেন।

এরপর তিনি লক্ষ্য করেন নগর দিয়ে এক ব্যক্তি সোনার কলসি নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। তাকে জিজ্ঞাসা করে সওদাগর জানতে পারেন ত্রাম্বলিপ্ত তে আশ্চর্য একটি কুণ্ড (কুয়ো) আছে। যেখানে পিতল এর জিনিস ডোবালে সেটি সোনায় পরিণত হয়ে উঠে আসে।

কৌতুহলী সওদাগর সেই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করে জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত অলৌকিক সেই কুয়োর সন্ধান পান। তারপর সমস্ত তামার পত্র সোনায় পরিণত করে সেগুলো বিক্রি করে অনেক অর্থ উপার্জন করেন। তারপর ব্যবসা করে ফেরার পথে তিনি সেই কুয়োর পাশে বর্গভীমা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।

বর্গভীমা মন্দির (শক্তিপীঠ):

এছাড়াও মন্দিরের একেবারে পাশেই রয়েছে একটি পুকুর। কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, পুকুরে ডুব দিয়ে যে যা হাতে পেতেন তা মন্দিরের পাশে যে কেলি কদম্ব বা কাট কলকে গাছ রয়েছে সেখানে সুতো দিয়ে বেঁধে দিতেন মনস্কামনা পূরণ করার জন্য।

তারপর মনের ইচ্ছা যদি পূরণ হয়ে যায়, তাহলে তারা সেই মন্দিরে এসে পূজা দিয়ে যেতেন। তবে এই এলাকা বর্গী হামলার হাত থেকে রেহাই পায়নি। তবে বর্গীরা এই মন্দির ধ্বংস করতে এসে পিছুপা হন। পরে তারাও এখানে পূজা দেন অর্থাৎ এখানে মায়ের মহিমা তারাও দেখতে পেয়েছেন।

এরপর কালা পাহাড় মন্দির ধ্বংস করতে এসে দেবীর চরণে আশ্রয় নিয়ে ক্ষমাভিক্ষা চেয়েছিলেন। এমনকি এর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া রূপনারায়ণ নদ সমস্ত কিছুকে গ্রাস করলেও কোন প্রকার ক্ষতি হয়নি এই বর্গভীমা মন্দিরের।

বর্গভীমা মন্দিরে পূজা অর্চনা:

এ মন্দিরে বলতে গেলে সারা বছর ধরে পূজা-অর্চনা চলে, তার পাশাপাশি কালী পূজার দিন দেবীর বিশেষ পূজা অর্চনার ব্যবস্থা করা হয়। মন্দিরের অন্যতম ঐতিহ্য অনুসারে ঐদিন দেবী মাকে রাজবেশ পরানো হয়। তন্ত্র মতে এখানে পুজা  হয়।

আর ভোগে থাকে শোল মাছ ছাড়াও ৫ রকমের মাছ, পাঁচ রকম ভাজা, পাঁচ রকমের তরকারি, এই সমস্ত দেবীকে ভোগ হিসাবে নিবেদন করা হয়। এছাড়াও রয়েছে ভাত, পোলাও, ফ্রাইড রাইস, খিচুড়ি, নানান ধরনের মিষ্টি প্রভৃতি নৈবেদ্য।

অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার শক্তির একমাত্র দেবী ছিল এই বর্গভীমা অর্থাৎ দেবী বর্গভীমা ছাড়া আর অন্য কোন শক্তির দেবতার পূজা করা হতো না। পরবর্তীকালে পুরোহিতদের বিধান অনুযায়ী আগে দেবী বর্গভীমার পূজা করা হবে তবেই অন্য পূজা শুরু করা হবে। আজও বারোয়াড়ি দুর্গাপূজা অথবা কালীপূজার আগে দেবী বর্গভীমার পূজা দেন এখানকার স্থানীয় মানুষজন।

এছাড়াও কালীপূজার দিন সন্ধ্যাবেলায় রীতিমতো শোভাযাত্রা করে সমস্ত বারোয়াড়ি পূজা উদ্যোক্তারা দেবী বর্গভীমার পূজা দিয়ে তারপরে তারা পূজা শুরু করেন। অলৌকিক নানান কাহিনী থাকলেও ঐতিহাসিক দিক থেকেও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় এই মন্দির।

তবে আগেই বলা হয়েছে যে, এখানে সারা বছর ধরে পূজা-অর্চনা চলে তাই শুধুমাত্র কালীপূজা অথবা দুর্গাপুজোই নয়, দেবী বর্গভীমা সারা বছর ধরে এখানে পূজিতা হয়ে আসছেন। বহু ভক্তগণ দূর-দূরান্ত থেকে থেকে এবং দেশের বাইরে থেকেও এই মন্দিরে ছুটে আসেন মায়ের কাছে পূজা দেওয়ার টানে।

এই মন্দিরের কাহিনী, স্থানীয় মানুষজন দের অনেক খানি প্রভাবিত করেছে। এর পাশাপাশি এই মন্দিরের কথা দূর দূরান্ত পর্যন্ত এমন কি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। যার ফলে সারা বছর ধরে এখানে ভক্তদের সমগম চোখে পড়ার মতো। মন্দির প্রাঙ্গনে অগণিত ভক্তদের ভিড়, পূজা- অর্চনা আর দেবীর কাছে নিবেদন করা ভোগ- প্রসাদ সবকিছু মিলিয়ে এই শক্তিপীঠ সকল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে অনেকখানি গুরুত্বপূর্ণ এবং অতি পবিত্র একটি তীর্থক্ষেত্র।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top