(Bakreshwar Shakti Peeth in Bengali) বক্রেশ্বর শক্তিপীঠের বর্তমান অবস্থান কোন স্থানে? দেবী সতীর কোন অঙ্গ এখানে পতিত হয়েছে? বক্রেশ্বর শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী কি? কিভাবে আরাধনা করা হয়? এই মন্দিরের তাৎপর্য কি? জানুন সবকিছু বিস্তারিত।
সুদর্শন চক্র দিয়ে যখন সতীর দেহটি ৫১ টি খন্ডে বিভক্ত করা হয়েছিল, তখন সেটি পৃথিবীর বুকে ৫১ টি জায়গায় পতিত হয়েছিল। আর পরবর্তীতে সেই সব জায়গায় গড়ে উঠেছে ৫১ টি শক্তি পীঠ।
তেমনি এই সমস্ত শক্তি পীঠের মধ্যে একটি অন্যতম শক্তিপীঠ হল বক্রেশ্বর শক্তিপীঠ কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, এই স্থানে সতীর দুই ভ্রুর মধ্যবর্তী স্থান পতিত হয়েছিল।
বক্রেশ্বর শক্তিপীঠ:
শক্তিপীঠের নাম | বক্রেশ্বর শক্তিপীঠ |
স্থান | বক্রেশ্বর মন্দির, পাপহর নদীতীরে, সিউড়ি শহর থেকে ২৪ কিমি, দুবরাজপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ৭ কি.মি., বীরভূম, পশ্চিমবঙ্গ |
দেশ | ভারত |
দেবীর অংশ | ভ্রু যুগলের মধ্যবর্তী অংশ |
শক্তির নাম | মহিষমর্দিনী |
বক্রেশ্বর শক্তি পীঠের ভৌগোলিক গুরুত্ব:
বক্রেশ্বর শক্তিপীঠ পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার পাপহর নদীর তীরে অবস্থিত। সিউড়ি শহর থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরে এবং দুবরাজপুর রেল স্টেশন থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
বক্রেশ্বরের অধিষ্ঠিত দেবী হলেন মহিষাসুরমর্দিনী অথবা মহিষমর্দিনী আর এখানের ভৈরব হলেন বাবা বক্রেশ্বর অথবা বক্রনাথ।
বক্রেশ্বর শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী:
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী নিজের বাপের বাড়িতে যখন বাবার কাছে স্বামীর অনেক অপমান সহ্য করতে না পেরে সেখানে দেহত্যাগ করেছিলেন তখন মাতা সতীর দেহত্যাগের খবরে মহাদেব পাগল হয়ে দেবীর মৃতদেহ কাঁধে করে নিয়ে তান্ডব নৃত্য শুরু করেন।
মহাদেবের সেই তান্ডব নৃত্য তে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দিয়ে মাতা সতীর দেহটি ৫১ টি খন্ডে খন্ডিত করেন।
সেই দেহ খন্ড গুলিই পৃথিবীর বুকে যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠিত হয়। আর সেই হিসাবে বলা হয় যে, এই স্থানে দেবী সতীর দুই ভ্রুর মধ্যবর্তী স্থান পতিত হয়েছিল।
বক্রেশ্বর শক্তিপীঠের আরো অন্যান্য পৌরাণিক কাহিনী:
প্রতিটি শক্তিপীঠ, তীর্থস্থান কে ঘিরে রয়েছে অনেকগুলি পৌরাণিক কাহিনী, যা শুনতে সত্যিই খুবই রোমাঞ্চকর লাগে। আর এই সমস্ত ঘটনা শুনে অনেকেই প্রভাবিত হয়ে এই মন্দিরে ছুটে আসেন দেবীর দর্শন করতে, পূজা দিতে এবং নিজের মনের ইচ্ছা জানাতে।
লোকোমুখে শোনা কথা অনুযায়ী জানা যায় যে, এই জঙ্গল থেকেই অষ্টবক্র মুনি একটি শিবলিঙ্গের সন্ধান পান, ও এই লিঙ্গের সামনে গভীর সাধনায় মগ্ন হন।
এইভাবে অনেক বছর তিনি শিবের কঠিন সাধনা করেছিলেন তার উপর সন্তুষ্ট হয়ে মহাদেব তাকে শারীরিক বিকৃতি থেকে মুক্তি লাভের বর দিয়েছিলেন।
অষ্ট বক্র মুনির নাম অনুসারে সেই শিবলিঙ্গের নামকরণ হয় বক্রনাথ এবং ডিহি গ্রাম বক্রেশ্বর নামে পরিচিতি পায়।
বক্রেশ্বর জায়গাটির সাথে অষ্টবক্র মুনির জন্ম কাহিনী জড়িত রয়েছে। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী এই জায়গাটি আগে সম্পূর্ণ জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল এবং এখানে হতে গোনা কয়েকটি পরিবার ছাড়া আর কারোর বসবাস ছিল না।
তখন এই জায়গাটির নাম ছিল “ডিহি”। এরপর জানা যায় যে, অষ্টবক্র মুনির মায়ের নাম সুজাতা দেবী ও বাবার নাম ছিল কহোর মুনি।
যিনি বেদ জ্ঞানে খুবই পারদর্শী ছিলেন। অষ্টবক্র যখন মায়ের গর্ভে ছিলেন, তখন তার বাবা তার মাকে প্রতিদিন বেদ পাঠ করে শোনাতেন। গর্ভে থাকাকালীন রোজ বেদ পাঠ শুনে তিনি জন্মের আগেই বেদ সম্পর্কে অনেক ভাল মত জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছিলেন।
এই রকম ভাবেই একদিন কহোর মুনি তার স্ত্রীকে বেদ পাঠ করে শোনাচ্ছিলেন তখন তার গর্ভস্থ সন্তান বলে ওঠে, “বাবা আমি আপনার থেকে প্রতিদিন বেদ পাঠ শুনে এই শাস্ত্রের জ্ঞান অর্জন করেছি, আজ আপনি অন্যমনস্ক হয়ে ভুল বেদ পাঠ করছেন। আমি বুঝতে পেরে আপনাকে সেটা জানাচ্ছি”।
এই কথা শুনে অষ্টবক্র মুনির বাবা খুব অপমান বোধ করেন এবং তার গর্ভস্থ সন্তানকে অভিশাপ দেন “অষ্টাঙ্গ বিকৃত হোক” এমন বলে। এরপর সেই সন্তান শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন ও তার নাম হয় অষ্টবক্র।
এইভাবে দিন কাটতে থাকে, সেই সময় জনক নামে এক রাজা ছিলেন, তিনি তার রাজসভায় শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এবং ঘোষণা করেছিলেন যে তাকে শাস্ত্র বিষয়ে নানা জ্ঞান শুনিয়ে খুশি করতে পারবে, তার আর জীবনে কোন কিছুর অভাব থাকবে না।
এই ঘোষণা শুনে কহোর মুনি অর্থাৎ অষ্টবক্র মুনির বাবা অভাবের তাড়না থেকে মুক্তি পেতে সেই রাজ সবাই উপস্থিত হন। পরে রাজার সভা পন্ডিতের কাছে পরাজিত হয়ে তারই সেবায় কহোর মুনি কে নিযুক্ত করা হয়।
তিনি সেই রাজ সভায় বন্দী হয়ে যান, তারপর কালের নিয়মে সময় এগিয়ে যেতে থাকে, আর কহোর মুনির ছেলে বড় হতে থাকে। অষ্টবক্র মাত্র ১২ বছর বয়সেই সর্বশাস্ত্র বিষয়ে পণ্ডিত হয়ে ওঠেন। বড় হয়ে মা সুজাতার কাছে বাবার বন্দী দশার কথা শুনে অষ্টবক্র সেই রাজার দরবারে গিয়ে উপস্থিত হন।
কিন্তু রাজ সভায় প্রবেশ করার জন্য তার কোন অনুমতি দেওয়া হলো না। তখন ভালো অষ্ট বক্র পন্ডিতের সাথে তর্কযুদ্ধে তাদের আহ্বান জানাই এবং সবায় উপস্থিত সবাইকে তর্কে পরাজিত করে তার পিতা কহোর মুনিকে বন্দী দশা থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন।
এদিকে সন্তানের এই সাফল্যে কহোর মুনি খুব খুশি হন এবং আশীর্বাদ করেন “সমঙ্গ” নদীর জলে স্নান করলে তার যে অঙ্গে বিকৃতি ঘটেছে তা দূর হয়ে যাবে। “সমঙ্গ” অর্থাৎ সমান গতিতে বয়ে চলে যে নদী। এইরকম জলাধারের খোঁজ করতে করতে অষ্টবক্র ডিহি নামক এই গ্রামে এসে হাজির হন।
তারপর সেই স্থানে ঘুরতে ঘুরতে পূর্ব দিকে জঙ্গলের মধ্যে তিনি আটটি কুন্ডের সন্ধান পেয়েছিলেন। তারপর তিনি লক্ষ্য করলেন যে, তার মধ্যে সাতটি কুণ্ডের জল গরম আর একটি কুণ্ডের জল খুবই ঠান্ডা। তিনি সেই কুণ্ডের জল যেখানে এসে মিশছে সেখানে জলে স্নান করেন, ফলে তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে যায়, তিনি আবার স্বাভাবিক হয়ে ওঠেন।
এই বক্রেশ্বর শক্তি পীঠে বাবা বক্রেশ্বর কে কেন্দ্র করে এখানে আরো পাঁচটি শিবলিঙ্গ রয়েছে, সেগুলি হল:- ১) কুবেরেশ্বর, ২) জ্যোতির্লিঙ্গেশ্বর, ৩) সিদ্ধেশ্বর, ৪) কালারুদ্রশ্বর ও ৫) জম্ভশ্বর। এর পাশাপাশি এইসব মন্দিরের পাশেই রয়েছে এই উষ্ণ জল কুন্ডগুলি, সেগুলি হল:- ১) ভৈরবকুণ্ড (৬৫ ডিগ্রি), ২) ক্ষারকুন্ড (৬৬ ডিগ্রি), ৩) অগ্নিকুণ্ড (৮০ ডিগ্রি), ৪) সৌভাগ্য কুণ্ড, ৫) জীবৎস কুণ্ড, ৬) ব্রহ্মা কুণ্ড, ৭) সূর্য কুন্ড (৬১ ডিগ্রি), ৮) শ্বেত কুণ্ড। এই কুণ্ড গুলোতে স্নান করলে অনেক রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
প্রতিটি প্রস্রবণ এর কাছে শিবলিঙ্গ আছে, শ্বেত গঙ্গার কাছে এক পুরনো বটগাছের তলায় ভগ্ন হরগৌরী মূর্তিও রয়েছে। আর আমরা আগেই জানলাম যে, এই আটটি কুন্ডর মধ্যে সাতটি হল উষ্ণ জলের কুন্ড ও একটি হল শীতল জলের কুন্ড। এই সব কুন্ডের জলে সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, সিলিকেট, ক্লোরাইড, বাই কার্বনেট ও সালফেট পাওয়া যায়।
এছাড়াও এই জলে রেডিওঅ্যাকটিভ উপাদানও পাওয়া যায়। দুধ কুণ্ড বলে আরও একটি কুণ্ড রয়েছে, যার তাপমাত্রা ৬৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সকালের দিকে এই কুন্ডের জলে ওজন ঘনীভূত হয়ে সাদা সরের মতো পদার্থ সৃষ্টি করে। এই কুণ্ড গুলির পিছনেও রয়েছে একটি করে পৌরাণিক কাহিনী।
বক্রেশ্বর মন্দিরের দেবীর রূপ:
বক্রেশ্বর মন্দিরে দেবী মহিষমর্দিনীর মূর্তিটি পিতলের এবং মূর্তির রূপটি দশভূজা দুর্গার। যারা এখানে সেবায় আছেন তাদের থেকে জানা যায় যে, এই পিতলের দশভুজার মূর্তির নিচে একটি গর্তের ভিতর মায়ের দেহংশটি রাখা আছে, অর্থাৎ সতীর দুটি ভ্রুর মধ্যবর্তী স্থান যেটা এই স্থানে পতিত হয়েছিল।
এছাড়া জানা যায় যে, কালা পাহাড়ের আক্রমণের কারণে মা দুর্গার ১৮ হাত মূর্তিটিকে পুকুরে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল, অনেক পরে বর্তমান মন্দির থেকে দূরে ধরমগড় নামের একটি জায়গায় আচার্যদের দুর্গ মন্দির সংলগ্ন পুকুর থেকে একটি পাথরের আঠারো হাত মূর্তি উদ্ধার হয়েছিল।
দীর্ঘদিন মাটির নিচে থাকায় মূর্তি টি কিছুটা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে ঠিকই, তবে সেটা অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। মূর্তির নিচে এবং উপরে চাল চিত্রাকারে বৈষ্ণবী, কৌমরি, ইন্দ্রানী, বারাহি সহ নয়টি শক্তিমূর্তি রয়েছে।
এই মন্দিরে শিবরাত্রি উপলক্ষে প্রচুর ভক্তদের সমাগম দেখা যায়। এ ছাড়া শিবরাত্রি উপলক্ষে এই স্থানে বিশাল বড় মেলা বসে, যেখানে স্থানীয় মানুষজন থেকে শুরু করে দূরদূরান্ত থেকে আগত ভক্তগণ পুণ্যার্থী সেই মেলাতে খুবই আনন্দ উপভোগ করে থাকেন।